ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঁধবো রাখী সবার হাতে


হিন্দু সনাতন ধর্মে বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে রাখী পূর্ণিমাও একটি প্রচলিত উৎসব।এটি মূলত শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয়। কিন্তু এখানে কোন দেব-দেবীর বিগ্ৰহ স্থাপিত করা হয় না।না, তো পূজো- অর্চনা করা হয়।এই উৎসবটি ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন হিসেবে রাখী বন্ধন উৎসব নামেই সুপরিচিত। ভাইদূত ও রাখী পূর্ণিমা এই দুটি উৎসব কে কেন্দ্র করে পুরো একটি বছর অপেক্ষায় থাকে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বী মা-বোনেরা। এই দিন বোনেরা সকাল সকাল স্লান করে ভাইদের কপালে চন্দনের তিলক লাগিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধান, দূর্বা,ও ফুল দিয়ে হাতে রাখী/সূতোর ধাগা পরিয়ে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় মঙ্গলময়ী ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন।ঠিক তেমনি ভাইও বোনের হাতে রাখী পরে, বোনের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনার আশির্বাদ দান করেন এবং সারাজীবন বোনকে সকল বিপদের আঁচ থেকে রক্ষা করার দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হয়।এই দিন ভাই’রা তাদের প্রাণের অধিক প্রিয় বোনদের চকোলেট দিয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে,ভালোবাসার উপহার স্বরুপ বিভিন্ন রকমের সওগাতের মাধ্যমে খুনসুটি ও ভালোবাসা ভাগ করে নেই।

আমরা বিভিন্ন পাঠ্য পুস্তক,ও হিন্দুশাস্ত্র মহাভারতেও পড়েছি,যুদ্ধের সময় কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচলের খানিকটা কাপড়ের অংশ ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে যান এবং তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন রুপে স্বীকার করেন। বোনকে সকল বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দেন।আমরা পড়েছি,
পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে যখন তাঁর বস্ত্রহরণ করতে যান তখন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেখানে আবির্ভূত হয়ে রক্ষাকর্তার ভূমিকা নিয়ে ছিলেন এবং দ্রৌপদীর বস্ত্র নিবারণের মাধ্যমে বোনের প্রতি ভাইয়ের কর্তব্য পালন করে ছিলেন। এছাড়াও আরো অনেক পৌরাণিক কাহিনী,উপন্যাস,ও অজস্র গল্প আছে এই রাখীবন্ধনকে ঘিরে।এইভাবেই ভাই-বোনের মধুর সম্পর্কের বন্ধন হিসেবে শ্রাবণ মাসে রাখীবন্ধন উৎসব প্রচলিত হয়ে আসছে পরম্পরা অনুযায়ী বহুযুগ ধরে।

পরে ১৯০৫ সালে ১৬অষ্টোবর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল বর্ণের মানুষ কে নিয়ে রাখী বন্ধন উৎসবের ডাক দেন। কোলকাতার রাজপথ সেদিন ছিল চোখে পড়ার মত। প্রত্যেকে একে অপরের হাতে রাখীর সরু সূতো বেঁধে সম্প্রীতির বার্তা বহন করেছিলেন।মিলন ঘটেছিল সর্বধর্মের।শুধু বোনেরা ভাইদের নয়, সেই দিন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একতাই ছিল রাখি বন্ধনের মূল বিষয়।এই রাখী বন্ধন কে নিয়ে কবিগুরু লিখেছেন, অসংখ্য কবিতা ও গান।তিনি কবিতার মাধ্যমে দেশের যে কোনো বিপদের সময় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে এক হওয়ার আহ্বান করেছিলেন।কারণ একমাত্র আমাদের সংগঠিত শক্তির দৃঢ় বন্ধনেই পারে যে কোন অশুভ সংকেত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।তাই তিনি বলেছিলেন,

এক সূত্রে গাঁথিয়াছি সহস্রটি মন,
এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন।
বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম।।
আসুক সহস্র বাধা, বাধুক প্রলয়,
আমরা সহস্র প্রাণ রহিব নির্ভয়।
বন্দেমাতরম,বন্দেমাতরম।।
আমরা ডরাইব না ঝটিকা- ঝঞ্ঝায়,
অযুত তরঙ্গ বক্ষে সহিব হেলায়।
টুটে তো টুটুক এই নশ্বর জীবন,
তবু না ছিঁড়িবে কভু এই দৃঢ় বন্ধন।
বন্দেমাতরম,বন্দেমাতরম।।

এছাড়াও ১৯২৫ সালে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্ৰ হিন্দু সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রাতঃ স্মরণীয় ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বীজ রোপন করে ছিলেন।যা সংক্ষেপে আর.এস.এস নামে পরিচিত।তিনি রবীন্দ্রনাথের রাখী বন্ধন উৎসব কে স্বয়ংসেবকদের মাঝে পুণ্য মর্যদার রুপ দিয়েছিলেন সঙ্ঘের চতুর্থ উৎসব হিসেবে সামাজিক ভাবে পালন করার। কারণ তিনি মনে করতেন,রাখীর এক টুকরো সাদা সূতোয় পারে একমাত্র সকলের মধ্যে “বসুধৈব কটুম্বকম্” মন্ত্রে একাত্মতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগাতে।তাই কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার স্বয়ংসেবকদের বলেছিলেন, যাদের প্রতি আমাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে, সে ভাই-বোন, মা-বাবা,বন্ধু-বান্ধবী,দেশ-সমাজ,ও মঠ-মন্দিরেই হোক বা প্রাকৃতিক শক্তি,জল,বায়ু,গাছপালা ও ভারতীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্যই হোক সকল কে রাখীর সাদা সূতো পড়িয়ে তাঁদের রক্ষার্থে আমাদের কর্তব্য পালন করার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে।তবেই রাখী বন্ধন উৎসব যথার্থে সব সম্পর্কের মেল বন্ধন হয়ে উঠবে।তারপর থেকে আজ পর্যন্ত রাখী বন্ধন উৎসব রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে ও সমাজের সকল স্তরে সামাজিক ভাবে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মিলন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক শ্রদ্ধেয় কবি দুলাল ধরের একটি কবিতার প্রথম ও শেষ দুলাইন তুলে ধরলাম,

আজ বাঁধবো রাখী সবার হাতে পুন্য প্রভাতে,/উচ্চ নীচের বিভেদ ভুলে চলবো একসাথে।/ঐক্যবোধের মহান প্রতীক এই রাখী বন্ধন,/দেশ-ধর্ম-সমাজ মোরা করবো সুরক্ষণ।

কলমে: কৌশিক দাস
তারিখ: ০৫/০৮/২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.