শিবরাত্রি স্পেশ্যাল : ব্রহ্মাকে যৌনশিক্ষা দিতেই কি শিব ধারণ করেছিলেন ‘অর্ধনারীশ্বর’ রূপ?

শিব পুরাণের কাহিনি থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির সেই আদিম লগ্নে, যখন সবেমাত্র ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে, স্বর্গ-মর্ত-পাতাল-এই ত্রিলোকের বিভাজন হয়েছে, দেবাদিদেবের ইচ্ছেয় আরও দুই দেবতা ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর আবির্ভাব ঘটেছে; তখন প্রয়োজন হল এই ত্রিলোকে বসবাস করার মতো যথেষ্ট জীব-সৃষ্টির। এই জীবসৃষ্টির ভার ব্রহ্মাকে দিলেন স্বয়ং শিব। সৃষ্টির ভার দিলেও শিব কিন্তু ব্রহ্মাকে বলে দিলেন না সৃষ্টি টিকিয়ে রাখার উপায়। ফলে, ব্রহ্মা যা সৃষ্টি করেন, তার সমস্তই কালের নিয়মে একে একে লয় পেতে লাগল, চিরন্তন সৃষ্টির ধারাপথ আর কিছুতেই তৈরি হল না। তখন জীবের যোগান দিতে দিতে ব্রহ্মা একেবারে হয়রান হয়ে গেলেন।

আসলে সৃষ্টির সেই সূচনাকালে, তিন আদি দেবতা ছাড়া কোন দেবীর আবির্ভাব তখনও অব্দি ঘটেনি। তাই ব্রহ্মার চোখে সৃষ্টির মডেল বলতে হাজির ছিলেন কেবলমাত্র বিষ্ণু ও মহাদেবের মতো দুই ‘পুরুষ দেবতা’। ‘নারী’- নামক ভিন্ন লিঙ্গের জীবেরও যে অস্তিত্ব থাকতে পারে, সেটাই ব্রহ্মার জানা ছিল না। তাছাড়া তিনি যেসব জীবের সৃষ্টি করছিলেন তার জন্য নারী সম্ভোগেরও প্রয়োজন হয়নি। কারণ, ব্রহ্মা তাদের মন থেকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাই ব্রহ্মার সৃষ্ট পুরুষেরা তাঁর ‘মানসপুত্র’ নামে পরিচিত। বুদ্ধিমান ব্রহ্মা বুঝতে পারছিলেন যে, মানস-প্রক্রিয়ায় নিরন্তর নিজে জীব সৃষ্টি করে বা নিছক পুরুষ সৃজন করে সৃষ্টি-সামাল দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য কিছু একটা উপায় ভাবতে হবে। কিন্তু সেই বিকল্প উপায় যে কি হবে, অভিজ্ঞতার অভাবে সেটা ঠাহর করতে পারছিলেন না। কাজেই তিনি শরণ নিলেন অগতির গতি স্বয়ম্ভু শিবের।

ব্রহ্মার এই সৃষ্টি-সংকটের কথা শিব যখন ধ্যানযোগে জানতে পারলেন, তখনই তিনি মুশকিল আসান হয়ে ব্রহ্মার সামনে আবির্ভুত হলেন অদ্ভুত এক রূপে। যে রূপ ব্রহ্মা কোনদিন দেখেননি, ব্রহ্মাণ্ড কোনদিন দেখেনি, যে রূপে এক আধারে ধরা দিয়েছেন শিব ও শক্তি অরূপ মাধুরী নিয়ে! ব্রহ্মা দেখলেন একদিকে মোহিনী ও তেজস্বিনী, অন্যদিকে বরদা ও মাতৃময়ী এক ও অভিন্ন নারীকে, সেই নারী একবার আবির্ভুত হচ্ছেন তাঁর চিরপরিচিত শিবের অঙ্গ থেকে আবার সেই অঙ্গেই বিলীন হয়ে যাচ্ছেন পরক্ষণেই। কখনো বা একই অঙ্গের অর্ধেক হয়ে অবস্থান করছেন শিব ও শক্তি পাশাপাশি। অদ্ভুত এই দিব্যদর্শনের মধ্য দিয়ে শিব ব্রহ্মাকে চেনালেন শক্তিরূপিনী নারীকে। জানিয়ে দিলেন সৃষ্টির জন্য যতটা পুরুষের প্রয়োজন, ঠিক ততটাই প্রয়োজন নারীর এবং নারী ও পুরুষে যতটুকুই প্রভেদ থাক না কেন, সৃষ্টিসূত্রে তারা কিন্তু অভেদ। সেইসঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন, ওই যে দিব্যদৃষ্ট নারীপুরুষের অর্ধাঙ্গ অবস্থান, ওটাই আসলে মৈথুন। আর এই মৈথুনের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয় সৃষ্টিচক্র।

তবে, ব্রহ্মাকে যৌনশিক্ষাদানের মধ্য দিয়েই শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপধারণের তাৎপর্য শেষ হয়ে যায় না। বাকি থাকে আরও কিছু গূঢ় তাৎপর্য। শিব ব্রহ্মাকে যে শক্তিরূপ দেখালেন, সেই রূপ তিনি পেলেন কোথায়? এদিকে, শিব আমাদের কাছে দেবাদিদেব, তিনি নিজেকেই নিজে সৃষ্টি করেছেন, তাই তাঁকে বলা হয় ‘স্বয়ম্ভু’। এই যে নিজেকে সৃষ্টি করার প্রেরণা, সেটাই বা পেলেন কোথায়? আসলে, প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে বিরাজিত ছিল প্রকৃতিসত্তা। সেই প্রকৃতিই প্রেরণা, প্রকৃতিই তাঁর স্রষ্টা। তাই পুরুষ হয়েও শিব আসলে চরাচরব্যাপ্ত প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতিতেও তিনি আদি। তাই আদিমকাল থেকেই প্রকৃতির মধ্যেও সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের এমন সৌম্য ও রুদ্ররূপের সহাবস্থান। এদিক থেকে শিব নিজের মূলটিকে, এই মৌল স্বরূপটিকে চিনিয়ে দেবার জন্যও ধারণ করেছিলেন অর্ধনারীশ্বর রূপ।



পার্থসারথি পাণ্ডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.