জেলার নাম মালদহ,  থানা গাজোল , মৌজা 39  , এখানেই অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় মসজিদ , আদিনা মসজিদ ।বলা হয় এই মসজিদ শুধু পশ্চিমবঙ্গের ই নয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। দিল্লি জামে মসজিদের এর পরই এই মসজিদের স্থান। 

আহেদ আলী খানের রচিত “গৌড় পান্ডুয়ার স্মৃতি “নামক একটি গ্রন্থ থেকে জানতে পারা যায় এই আদিনা মসজিদ ও পান্ডুয়া সম্পর্কিত ইতিবৃত্ত কে এর আগে বলে রাখা প্রয়োজন এই আবিদ আলী খান ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে বাংলা সরকারের বিভাগের কর্মচারী এই ব্যক্তি গৌড় পান্ডুয়ার প্রাচীন পুরাকীর্তিগুলোর বিশেষ মেরামতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার সুবাদে দীর্ঘদিন মালদহে অবস্থান করেন।

আদিনার মসজিদ নির্মাণ কার্য ,1364 সাল থেকে আরম্ভ করে 1374 সালে  সম্পূর্ণ করা হয়।  মসজিদটি অপূর্ব কাঠামোতে তৈরি ।  মসজিদের দক্ষিণ পাশে জনসাধারণের নামাজ পড়ার একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল। এখানে আঠারোটি মিম্বার রয়েছে এবং এগুলি প্রতিটি উপরের দিকে পাথরের কাজ করা । কেন্দ্রীয় হলঘরের মাটি থেকে 8 ফুট উপরে আসন রয়েছে যার নাম “বাদশাহো কি তখত” ।  এর পাশে ও বহির্গমনের পথ ছিল পশ্চিমদিকে।  এখানকার মেহরাব অংশ চতুর্দিকে কোরআনের বাণী দিয়ে ঘেরা । এখানে তিনটি মেহরাব এবং দুটি দরজা রয়েছে। যেগুলোতে লেখা এবং ফুল আঁকা রয়েছে যা বিস্ময় সৃষ্টি করে।

  এবার আসি আসল কথায় । আমি হঠাৎ আদিনা মসজিদ নিয়ে কেন আলোচনা করছি?  আমি যদি বলি এই আদিনা মসজিদ আসলে কোন মসজিদই নয় , এটি আসলে একটি মন্দির ?  চলুন দেখা যাক আমার কথার স্বপক্ষে আমি এখানে কী কী যুক্তি খাড়া করতে পারি বা আমি আপনাদের কি প্রমান দিতে পারি যে আদিনা আসলে মসজিদ নয় একটি সম্পূর্ণরূপে মন্দির। আদিনা মসজিদের পশ্চিমে দরজা দিয়ে উঠার সময় দরজার ওপরে একটি বুদ্ধমূর্তি দেখতে পাওয়া যায় যেটি সম্পূর্ণভাবে ছেচে তোলা হয়েছে । দরজা পেরিয়ে দেখা যায় সিকান্দার শাহ এর কবর । 

এই ঘরের যে অংশ সিকান্দার শাহের কবর নামে পরিচিত সেখানে একটি বড় গম্বুজ ছিল যা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।  এই স্থান পেরিয়ে যেতে হয় “বাদশাহো কি তখতে” । প্রবেশ দারের চৌকাঠে বহু নৃত্যরত মুর্তি দেখা যায় । যেগুলোকে চেঁছে তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা যায় । দরজার চৌকাঠ গুলো বিভিন্ন নকশার সজ্জিত সে যুগের হিন্দু ভাস্কর্যে পরিচয় বহন করে।

https://twitter.com/caa_nrc_best/status/1269936005735481346?s=19

এবার আসি মিম্বারের কথায় আসি।  এটি সাধারণ নিয়ম অনুসারে মধ্যে অবস্থিত না । এই মিম্বারের অবস্থান দক্ষিণী এবং এটি দ্বিতল। যাতে উভয় তলের মানুষ তাকে দেখতে পায় এইবার আসি এর নকশার কথায়। অসংখ্য নকশা এবং পদ্ম ফুলের ছড়াছড়ি দেখা যায় এই মিম্বরের নিম্ন তলে । সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে উপরের তলের ছাদ টি ।

এই মিম্বারের সংলগ্ন রয়েছে কেন্দ্রীয় মেহরাবটি। এর আকার বিরাট। সবার উপরে জানলা দেখতে পাওয়া যায়। জানলা দিয়ে একটি দেখা যায় একটি শিবলিঙ্গ পাতলা করে বসানো রয়েছে আর রয়েছে একটি বড় পদ্ম, তার নিচে কোরানের কিছু বাণী , তার নিচে বিভিন্ন প্রকারের অলংকরণ। দুপাশে বড় বড় পদ্মফুল।

 এই চিত্রকলা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো শিবলিঙ্গ পদ্মফুল এবং কোরআনের সহাবস্থান। যদিও এটি মসজিদ তবুও এর স্তম্ভে নকশাগুলি কি প্রচন্ড অমিল , তা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় এবং এটা বোঝা যায় যে এই মসজিদ তৈরির কোন রকম কোন ইঞ্জিনিয়ারিং পরিকল্পনা ছিল না।  হিন্দু বৌদ্ধ এবং জৈন মন্দিরের পাথরগুলি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে অথবা এটি একটি মন্দিরেরই অংশ।  

আদিনা মসজিদের গঠনগত কাঠামোর মধ্যে বিতর্কিত অবস্থান হলো” বাদশাহ কি তখত ” । এর মানে রাজসিংহাসন। কিন্তু এখানে কোন সিংহাসন নেই  বরং মাটি থেকে 8 ফুট উঁচু মঞ্চের মত  বা বারান্দার মত  একটি অনেক বড় স্থান আছে । আবেদ আলী রচিত গ্রন্থের কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ।
আরো একটি বিতর্কিত বিষয় হল বাদশাহ কিতাবকে এর পশ্চিম পাশের দেওয়ালে কালো পাথরের মেহরাব আছে এবং তা সম্পূর্ণ কারুকার্যমন্ডিত এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় কি জানেন? ” স্বস্তিক চিহ্ন ” । এর পাশে ইসলামিক শিলালেখ দেখতে পাওয়া যায় তার সূক্ষ্মতা অনেক  নিম্নমানের ও নবীনতর।

 নামাজ ঘর বা মসজিদের মূল মূল কক্ষের পশ্চিম দিকে দুটো বৃহৎ আকারের সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্ম দেখতে পাওয়া যায় , ঠিক যেমনটি আমরা হিন্দু মন্দিরগুলোতে দেখতে পায় অথবা বৌদ্ধমঠ ওগুলোতে দেখতে পাই । কারণ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে পদ্ম অতীব পবিত্র বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।  শুধু তাই নয় পুরো মসজিদ ভর্তি বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় নানা আকারের পদ্মফুল দেখতে পাওয়া যায় । আমি জানিনা যে বিভিন্ন ওয়েব লিংক গুলিতে কিভাবে আদিনা মসজিদ কে একটি আরবিয় অথবা কোথাও পারসিক স্থাপত্যের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে ? কারণ আদিনা মসজিদ এমন বহু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় যার সঙ্গে মাত্র 1400 বছর আগে সৃষ্ট ইসলাম ধর্ম স্থাপত্য এগুলোর সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না । সব থেকে বড় কথা আবিদ আলী, তার লেখাতে , কোন রকম ভাবেই এই পদ্মফুল, নকশা , স্বস্তিক চিহ্ন এগুলোর অবস্থান এর সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেন নি । উপরন্তু কোন কোন জায়গাতে তিনি এই বলে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে এই সমস্ত নকশা , পদ্মফুল , বিভিন্ন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন মঠ ও মন্দির  থেকে নিয়ে এসে মসজিদটিকে শোভাবর্ধন করা হয়েছে।  কিন্তু এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস না করা একটি ধর্ম কিভাবে কাফেরদের সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতীক নকশা দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে এসে মসজিদটিকে সুসজ্জিত করে তোরে এটি কি তাদের কোরান সম্মত? 

এবার আসি মসজিদের কিবলা ও মিহরাবের কথায়।কিবলা দেয়ালের সন্নিকটে কেন্দ্রীয় ‘নেভ’-এর উত্তর পাশে তিন ‘আইল’ জুড়ে একটি এলাকা এক সারিতে সাতটি মজবুত স্তম্ভের উপর পাথরের প্লাটফরম (মাকছুরা) সুলতান ও তার সঙ্গীদের প্রার্থনার স্থান হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। প্লাটফরমটির পশ্চিম দেয়ালের উত্তর পাশে সুলতান ও তার সঙ্গী-সাথীদের প্রবেশের জন্য দুটি দেউড়ি রয়েছে। গ্যালারির প্লাটফরমটির অবশ্যই পর্দা-পাঁচিল ছিল, যা বর্তমানে বিলুপ্ত। গ্যালারিটির বর্তমান সৌন্দর্য অভ্যন্তরস্থ দশটি পলকাটা স্তম্ভ এবং সামনের দিকে খোদাইকর্ম অলঙ্কৃত, টাইলস ও ‘সুলস’ রীতির হস্তলিখন পদ্ধতিতে শিলালেখ দ্বারা সজ্জিত তিনটি মিহরাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন নকশায় বিভাজিত চিকন স্তম্ভসমূহের উপর মিহরাবগুলির খিলানসমূহ মসজিদের নিচতলার মিহরাবগুলির মতো পলকাটা। প্লাটফরমটি মসজিদের একটি উপর তলা হওয়ায় এ অংশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে, গ্যালারির উপর নির্মিত গম্বুজগুলির উচ্চতা বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হয়।

কেন্দ্রীয় ‘নেভ‘-এর উত্তর পশ্চিম কোণ এবং প্রধান মিহরাবের ডানদিকে রয়েছে এক অনিন্দ্য নিদর্শন চাঁদোয়া শোভিত মিম্বর। ধাপগুলির মধ্যে প্রায় আটটি বর্তমানে বিলুপ্ত, কিন্তু চাঁদোয়া-আচ্ছাদিত অংশের ছোট মিহরাবসহ এর পার্শ্ব দেয়ালে স্বল্পোৎকীর্ণ বিমূর্ত বৈচিত্র্য সৃষ্টিকারী নকশাসমূহ শিল্পীদের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। পববর্তী কিছু কাজেও এ মিম্বরের প্রভাব দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, লখ্নৌতির দরসবাড়ি মসজিদ এবং ছোট পান্ডুয়ার বরী মসজিদ (স্থাপত্য আদর্শের ভিত্তিতে নির্ণীত সময়কাল পনেরো শতকের শেষার্ধ)।

সেক্ষেত্রে কিবলা ও  মিহরাবের দিকে অবলোকন করলে বহু অসঙ্গতি চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে বলে রাখি কিবলা এবং মিরহাব একটি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য অংশ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে । কিবলা নামাজঘরের কারুকার্যময় অংশটিকে নির্দেশ করে।  এটি সাধারণভাবে পশ্চিম দিকে অবস্থান করে এবং এর দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে হয়। তার মধ্যে থাকে মিহরাব। মিহরাব হল নামাজ ঘরের ভিতরে এমন একটি জায়গা আছে কাবা ঘরে সর্বাধিক নিকট।  এর  মধ্য কুলুঙ্গির মতো একটি ছোট ঘর থাকে। যেখানে বসে  ইমাম নামাজে নেতৃত্ব দেয় । এক্ষেত্রে বলে রাখি আদিনা মসজিদের এই নামাজ ঘরের পশ্চিমেও সিকান্দার এর আরও একটি কক্ষ আছে। কিন্তু  ইসলামী রীতি অনুসারে কিন্তু নামাজের পশ্চিমে অতিরিক্ত আর কিছু থাকা উচিত নয় । সবথেকে বড় কথা হচ্ছে নামাজ ঘরের  স্থান পর্যাপ্ত আলো যুক্ত নয় । তার যুক্তি আজ অব্দি কোন ইসলামিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

আদিনা মসজিদের একটি বহুল আলোচিত অনুষঙ্গ হচ্ছে মসজিদের পেছনে সিকান্দর শাহ-এর তথাকথিত সমাধি কক্ষ। সম্ভবত পরবর্তী সময়ের একটি পাথরের শবাধার সমাধি কক্ষের মেঝেতে আবিষ্কৃত হওয়ায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে এ কাহিনী গড়ে ওঠে। কিন্তু এ শবাধার সিকান্দার শাহ-এর সমাধি প্রস্তর হতে পারে না। এর সহজ যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ হলো প্রকোষ্ঠের মধ্য দিয়ে বিরাট প্রস্তর স্তম্ভের অবস্থান এবং শবাধারটির অবস্থান প্রকোষ্ঠের মধ্যবর্তী স্থানে নয়, মেঝের পশ্চিম প্রান্তে। বাদশাহদের কবর সাধারণত এক গম্বুজ বিশিষ্ট দালানে হয়ে থাকে এবং শাসকের দেহটি থাকে প্রকোষ্ঠের মাঝখানে এবং গম্বুজটি তার উপরে স্বর্গীয় খিলান ছাদের (vault) নিদর্শন। বর্তমান ক্ষেত্রে মধ্যস্থানে একটি গম্বুজের পরিবর্তে দালানটির উপর নয়টি সম-আকারের গম্বুজ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজকীয় গ্যালারির একই উচ্চতায় দালানটির স্তম্ভগুলির উপর একটি প্ল্যাটফরম রয়েছে এবং এতে প্রবেশের জন্য দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। প্লাটফরমটির উত্তরপাশের পশ্চিম দিক হতে একটি সংযোগ-স্থাপক ঢালু পথ উপরে এসে মিলেছে। 

সবথেকে বড় কথা মসজিদের ভেতর কোন ব্যক্তির কবর দেওয়া ইসলামবিরোধী। তাহলে আমরা কিভাবে ধরবো যে এটা সিকান্দার সাহেরি শবাধার ? সে উত্তর ও আজ অব্দি সঠিকভাবে কোন ঐতিহাসিক প্রদান করতে পারেনি।

 আদিনা মসজিদের পিছনের দেয়ালে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি অনুসারে এটি 1373 খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ কর্তৃক নির্মিত। যেখানে মসজিদের নকশা গুলি কিন্তু আরো প্রাচীন ও সুক্ষ। একথা আমি বারবার উল্লেখ করেছি ।

 সিকান্দর শাহের মতো সুলতানের পক্ষে, যিনি 1369 খ্রিস্টাব্দে নিজেকে আরব ও পারস্যের সুলতানদের মধ্যে যোগ্যতম এবং পরে ‘বিশ্বাসীদের খলিফা’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, এ ধরনের একটি মসজিদ নির্মাণ ছিল তাঁর সম্পদ ও প্রতিপত্তির স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, একজন সুলতান যিনি নিজেকে দামেস্ক, বাগদাদ, কর্ডোভা অথবা কায়রোর খলিফাদের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি ওই সকল রাজধানী শহরের মসজিদগুলির আকার ও আড়ম্বরের সঙ্গে তুলনীয় একটি মসজিদই নির্মাণ করবেন। এবং ইসলাম অনুযায়ী তা হবে কোনো কাফের মন্দির বা মঠ ধ্বংস করে।

 বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এ যে, শুধু আকার-আয়তনেই আদিনা মসজিদ ওই নগরীসমূহের মসজিদগুলির সঙ্গে তুলনীয় নয়, নকশা ও গুণগত দিকেও এটি বিশ্বের সেরা মসজিদগুলির সমকক্ষ। কারণ নক্সায় কোনো আরবীয় বা বাইজেন্টাইন প্রভাব নেই। বরং রয়েছে সুপ্রাচীন ভারতীয় উপমাদেশের সনাতনী প্রভাব।
মসজিদটির অলঙ্করণ সম্পর্কিত বিষয়াবলি, স্তম্ভসমূহের কাঠামোগত নকশা, পেন্ডেন্টিভ, মিহরাব, সম্মুখ ভাগের টেরাকোটা, টালির অলঙ্করণ এবং হস্তলেখ শিল্পসমৃদ্ধ শিলালেখসমূহের ভগ্নাবশেষ এখনও পরিদৃষ্ট হয়। 

https://twitter.com/rohith_lsiddu/status/1270175358646534144?s=19

উপরিভাগের অন্যান্য অ-লেখ অলংকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় উদ্ভিজ নকশা,  পদ্ম ফুলের নকশা, মূর্তির নকশা, জ্যামিতিক নকশা, বর্ণনাতীত জটিল নকশাসমূহ। এক্ষেত্রে একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। যদিও অবস্থান ও নকশাগত দিক থেকে আলঙ্কারিক বিষয়বস্ত্তর কিছুটা সামঞ্জস্য রয়েছে, তবে কোনো একটি বিষয়ই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অপর একটির সদৃশ নয়। বিশেষত দেব মূর্তি গুলি। সিনকান্দার শাহ কিন্তু গোঁড়া মুসলিম ছিলেন। শোনা যায় তিনি কাফের দের ইসলামের ছায়াতলে আনার জন্য স্টেপ বাই স্টেপ প্ল্যান সাজাতেন। মানে প্রথমে ভালো কথায় আমন্ত্রণ। তারপরে অত্যাচার। 

যদি পাণ্ডুয়রার আদিনা আপনারা ভ্রমণ করে থাকেন । তাহলে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে এই মসজিদ( মন্দির) এর গাত্রে বিষ্ণু, দুর্গা, কার্তিক, গনেশ, কৃষ্ণ ইত্যাদি বহু মূর্তি ক্ষত ও অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাবেন। দুঃখের বিষয় হল যে, বহু হিন্দু বিখ্যাত ঐতিহাসিক এই বিষয় টিকে তাদের লেখনিতে সুপটু ভাবে এড়িয়ে গেছেন। এরম ভারতীয় বহু স্থাপত্য আছে যা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের টানা পোড়েন সমান ভাবে চলে আসছে। এবং সেই বিষয় গুলিতে সেকুলার আত্মঘাতী  হিন্দুরা ও বেঈমান মুসলিম সমাজ বিদেশ থেকে আগত মুসলিমদের পক্ষ নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা যারা এই বিষয় নিজেদের পন্ডিত ভেবে তর্ক করতে আসেন তারা অনেকেই এ বিষয়ের পন্ডিত নন।

সরকারি ফলকে আদিনা মসজিদ তৈরি ব্যক্তির নাম হিসাবে সিকান্দার শাহ এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলে রাখি আবেদ আলী খান যেহেতু নিজে একজন গোঁড়া মুসলিম ছিলেন , তাই  তিনি কোনোভাবেই পক্ষপাতমুক্ত হতে পারেন নি তাঁর গ্রন্থ রচনার সময়। 
ডক্টর সুস্মিতা সোমের লেখনি থেকে জানতে পারা যায় আদিনা মসজিদ আসলে জৈন্য পথপ্রদর্শক আদিনাথের মন্দির পরে যা বৌদ্ধ বিহারে পরিণত হয়েছিল।  কিন্তু সুস্মিতা সোম কোনদিনই পক্ষপাতমুক্ত হয়ে তার লেখালেখি করতে পারেন নি ।এমনকি তিনি তার গ্রন্থে সিকান্দার শাহকে সংস্কারক বলেছেন। অর্থাৎ সিকান্দার সংস্কার করে মসজিদ করেছিলেন ?
 তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এখানে একটি বিশাল হিন্দু মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল যা পরবর্তীকালে মুসলিম আক্রমণের ফলে প্রতিহত হয় এবং  ওই সমস্ত অর্ধনির্মিত মন্দির গুলিকে মসজিদ, দরগা ইত্যাদিতে পরিণত করে । 
ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সরকার কোন এক সময় মন্দিরের অর্থাৎ আদিনা মসজিদের থেকে প্রাপ্ত বেশকিছু লিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন  যে লিপি গুলো সংস্কৃতি ছিল ও যে লিপি গুলোতে শিবের মন্ত্র লেখা  ছিল । অর্থাৎ এর থেকে উপলব্ধি করা যায় আদিনা মসজিদ একটি শিব মন্দির ছিল ।
সবথেকে বিস্ময়কর বিষয় কি জানেন ? মসজিদে প্রবেশের পথ সাধারণভাবে পশ্চিমে হয়।  আদিনা মসজিদের পূর্ব প্রবেশপথ এবং সেই প্রবেশপথ উত্তর দিকে ঘুরে গেছে। আদিনা মসজিদের প্রকৃত প্রবেশপথ সেটি পূর্বমুখী হওয়ার জন্য আমরা এটা বলতেই পারি যে এটা কোন হিন্দু মন্দিরের গর্ভগৃহ। আমরা বাড়িতে তো ঠাকুর রাখি পূর্ব মুখ করে। সাধারণভাবে পূর্বদিক হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী পবিত্র ও শুভ বলে মেনে থাকেন। কারণ পূর্ব দিকে সূর্য উদিত হয়ে আলো দান করে সকল কালিমা ঘোচান।
 সিকান্দর এর শাহী তক্তপোষের পাশেই কষ্টিপাথরের অলংকার দেওয়া দেয়ালের যে উপরিভাগ দেখতে পাওয়া যায় তা ওই ভগ্ন শিবলিঙ্গের অংশবিশেষ।  শিবলিঙ্গ বিহীন একটি গৌরীপট্ট মসজিদের ভিতরে দেখতে পাই।  আমরা মসজিদে পূর্ব ও পশ্চিম  দুটি দুয়ারেই গণেশ মূর্তি দেখতে পাই।  আদিনা মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম প্রাচীরে অবস্থান করছেন তাঁরা। 
আগের পর্বে লেখায় আমি একটি ছবি দিয়েছিলাম –  একটি খাঁজকাটা প্রকৃতি চৈত্য বাক্ষের। পশ্চিম দিকের বাইরে অবস্থান করছে ।দুটি আয়তাকার লম্বা স্তম্ভের উপর রাখা এর শীর্ষদেশও মন্দিরের মত। মধস্তলে একটি বসানো পদ্ম কুড়ি অর্ধাংশে মত সুন্দর কারুকাজ করা এর মধ্যবর্তী স্থানে কোন একটি ভাল মূর্তি ছিল যেদিকে নষ্ট করা হয়েছে পাল সাম্রাজ্য সময়কালে বাংলায় বৌদ্ধ হিন্দু সংস্কৃতির মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিল তাই আমরা সমস্ত চিহ্ন দেখে উপলব্ধি করতেই পারি যে মন্দিরটি সিকান্দার নির্মিত নয় এটি একটি হিন্দু মন্দির এবং বহু পূর্বে নির্মিত হয়েছে আদিনা মসজিদের কোনরকম আরবীয় বা পারসি অথবা বাইজেন্টাইন শিল্প কার্যে উল্লেখ পাওয়া যায় না সমস্ত শিল্পকার জয়ী সনাতন ভাবনা সমৃদ্ধ শুধুমাত্র কিছু কোরআনের আয়াত পাওয়া যায় যেগুলো অত্যন্ত নবনির্মিত আমি আপনাদের বলব কিভাবে এখানে প্রমাণ লোপাট করা হয় এ প্রমাণ পদ্ধতিটি একটা দীর্ঘ বছর ধরে এখানে চলে আসছে এখানকার মুসলিম জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি এবং এখানে যেহেতু অত্যন্ত পুরনো হিন্দু সনাতনী মূর্তি কিছু আছে অনেক মূর্তি এখান থেকে ভেঙ্গে চুরি করে নিয়ে পাচার করা হয়েছে এছাড়া অনেক জায়গায় মূর্তিগুলোকে চেঁচে তুলে দেওয়া হয়েছে আমি সে কথা আমি আগেই বলেছি সবথেকে বড় কথা এখানে পান্ডুয়া যখন মেলা হয় তখন মক্কা-মদিনায় মক্কায় গিয়ে মুসলিমরা যেরকম শয়তানকে পাথর ছোড়ে সেই শয়তানকে পাথর ছোড়া নামে আদিনার গায়ে থাকা হিন্দু মূর্তিগুলোকে তারা পাথর ছুড়ে ধ্বংস করছে আমি একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে আদিনা মসজিদ সেক্টর হিসেবে আখ্যায়িত করা হোক এবং যে সমস্ত বেআইনি কাজ আদিনা মসজিদ এবং তার সংলগ্ন বিভিন্ন মূর্তিগুলোর সঙ্গে এবং কারুকাজগুলো সঙ্গে করা হচ্ছে সেগুলো অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে এবং আইনি ব্যবস্থা বন্ধ করা হোক ।
মুহাম্মদ ঘোরী দিল্লি অধিকার করার পরে কুতুবদ্দিনকে প্রতিনিধি করে  দিল্লিতে নিয়ে যায়। আনুমানিক 1195 খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিনের সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি গৌড় অধিকার করে। গিয়াসউদ্দিন এর পর গৌড় বা লক্ষণাবতী সম্পূর্ন রূপে দিল্লির সুলতানি শাসনের অনন্তর্ভুক্ত হয়।
বাংলার পাঁচশতাধিক বৎসর মুসলিম রাজত্বে ভাতুরিয়া বা  বর্তমান রাজশাহীর রাজা গনেশের নাম উল্লেখ যোগ্য। 1405 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1414  খ্রিস্টাব্দ সময় প্রবল প্রতাপশালী রাজা গণেশ মুসলিমদের কাছে যম হয়ে উঠেছিলেন। তাই মুসলিমদের ইতিহাসে রাজা গণেশ কংস নামে পরিচিত। 
রাজা গনেশের সময়ের বহু উল্লেখযোগ্য কীর্তির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হল – এই সময় তিনি আদিনা মসজিদের সংস্কার করে তাকে কাছারি গৃহে পরিণত করেছিলেন ।স্বল্পকালের রাজত্বে রাজা গণেশ হিন্দুদের কাছে সত্যি বিঘ্ননাশক রূপে পরিচিত হয়েছিলেন ।দুঃখের বিষয় হল তার পুত্র যদু ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম হয় শুধুমাত্র লোভের বশে । নাম নেয় জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ ।
 কথিত আছে যদু জালালুদ্দিন হবার পর জাঠমল নাম নিয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসে।  এই জালালুদ্দিন বা জাঠমল একজন নৃশংস ইসলামী শাসক হিসাবে বাংলার ইতিহাসে পরিচিত। সিকান্দার শাহ হিন্দু বৌদ্ধ মন্দিরটিকে আদিনা তে পরিণত করলেও তার সূক্ষ্ম কারুকাজ কে ধ্বংসপ্রাপ্ত করেননি বা করে উঠতে পারেননি । কিন্তু এই জালালুদ্দিন সিংহাসনে বসেই পিতা গণেশ কতৃক নির্মিত হিন্দু মন্দির গুলিকে মসজিদে পরিণত করেন।  যে সমস্ত মসজিদ গুলি গণেশ পুনরায় হিন্দু মন্দিরের রূপ দান করেছিলেন সেগুলো কে আবার মসজিদে পরিণত করেন এবং সেই সমস্ত মন্দিরগুলোতে যে সূক্ষ্ম কারুকাজ ছিল তার অধিকাংশ ধ্বংস সাধন করেন। এই জালাল এতই অত্যাচারী ছিল যে তার অত্যাচারে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ হিন্দু মুসলমানে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল।তারা কেউ আর নিজ ধর্মে ফিরে আসতে পারেন নি। শুধু তাই নয় আজকের পান্ডুয়া ভ্রমণ করলে আপনারা দেখবেন অধিকাংশ অট্টালিকা ,এলাকা , পুকুর জালাল নামে পরিচিত।

পান্ডুয়া মুর্শিদাবাদ এলাকার একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল । এখানে বলতে গেলে 80 % এর বেশি মুসলমানের বসবাস। প্রায় প্রতিদিনই এখানে হিন্দু বিদ্বেষী এবং ভারতবিদ্বেষী বিভিন্ন কথা শোনা এখন এখানকার রোজনামচার মধ্যে পড়ে।  শুধু তাই নয়, এখানে পাকিস্তানের পতাকা বহুবার উত্তোলন করা হয়েছে ,এ ধরনের খবর আমাদের কাছে উত্থাপিত হয়েছে।
 2001 সালে ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর এখানের 10 থেকে 12 হাজার মুসলিম জমায়েত করে আদিনা মসজিদে নামাজ পড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল । জমায়েত করে নামাজ পড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হল আদিনা মসজিদ কে সম্পূর্ণভাবে মুসলিমদের করায়ত্ত করা । এখানে হিন্দুরা স্বতন্ত্র সংখ্যালঘু এবং তারা লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্বকে বজায় রেখে দিয়েছে।  তার জন্য তারা প্রতিরোধ করতে শুরু করে। এর ফলে পান্ডুয়া অঞ্চলেও যদি মুসলিমরা নামাজ পড়তে সক্ষম হয় কিন্তু আদিনা মসজিদে প্রতিরোধের মুখে তারা নামাজ পড়তে পারে নি।  এরপরের যে জুম্মাবার আসে অর্থাৎ একুশে সেপ্টেম্বর তারা আবার নামাজ পড়ার জন্য ও দখল নেওয়ার হুমকি দেখালে প্রশাসন সক্রিয় হয় সেই সময় এবং মুসলিমদের রুখে দেয়া সম্ভবপর হয়েছিল। 

সাধারণ মানুষের মধ্যে আজও আতঙ্ক আছে। আর দ্বিতীয়টি ঠিক আদিনা সম্পর্কে না হলেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেটি হল এলাকার সচেতন কিছু মানুষের উদ্যোগে পান্ডুয়া এবং দেওতলা মৌজার একাধিক সরকারী C.S.রেকর্ড এবং R.S.রেকর্ড (যেমন -পান্ডুয়া মৌজা, জে এল নং- ৩৩, খঃনঃ-১/২, দাগ নং- ২৫০ ; দেওতলা মৌজা , জে এল নং- ১৭২, খঃনঃ-১/২, দাগ নং- ৪৭৫) উদ্ধার করা গেছে , যেগুলি ১৯৭৫ বা তার আগের। সেখানে যে স্থান মন্দির, হিন্দু জনসাধারণের ব্যবহার্য বলে উল্লেখ রয়েছে অথচ খুব রহস্যজনকভাবে বর্তমান সরকারী রেকর্ডে সেগুলি ওয়াকফ এস্টেটের সম্পত্তি হিসাবে দেখানো হচ্ছে। 
বিস্ময়কর ঘটনা , পাণ্ডুয়ার জমির বর্তমান রেকর্ড ত এমন একজনের নামে যে ভারতের নয় বরং বাংলাদেশের নাগরিক। যাই হোক এলাকার সচেতন হিন্দুদের মতে,এই ব্যাপারটি খালি পান্ডুয়া বা দেওতলার মধ্যেই বা একটি দুটি জমির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়,বরং সারা মালদহের হিন্দু দেবোত্তর সম্পত্তিগুলি এভাবেই গ্রাস করে নেওয়া হচ্ছে, ওয়াকফের বা কোন মুসলিম ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দখল করা হচ্ছে। এটাকেই বলা হয় ল্যান্ড জিহাদ।
পাণ্ডুয়ার আরো বহু দরগা মসজিদ ইত্যাদি হিন্দু ধর্মের সাক্ষ্য বহন করে। ভবিষতে সেগুলো নিয়ে দীর্ঘ রচনার ইচ্ছা থাকল।
তথ্যসূত্র –
১) পর্যবেক্ষণে গৌড় ও পাণ্ডুয়া –আখতার হোসেন
২) গৌড় পাণ্ডুয়ার স্মৃতি – খান সাহেব আবিদ আলি খান
৩) মালদহ জেলার ইতিহাস – প্রদ্যোত ঘোষ
৪) মালদহ: ইতিহাস-কিংবদন্তী – ডঃ সুস্মিতা সোম
৫) প্রবাসী পত্রিকা – আশ্বিন,  ১৩০৮
৬) বাংলাপিডিয়া : আদিনা মসজিদ
৭) ইন্দ্রজিৎ

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.