রাতভর গোলার শব্দ রজৌরিতে, বেসমেন্টে শঙ্কার ভোর, দিনের শেষে যুদ্ধবিরতির জম্মুতে পৌঁছে মনে হল, এলেম নতুন দেশে!

রাজৌরি থেকে সবে জম্মু ঢুকেছি। হোটেলের ঘরে ঢুকে গা-টা এলিয়েছি। মোবাইলে এক্স-নোটিফিকেশন এল। দেখলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ট্রুথ’-বার্তার একটা স্ক্রিনশট ভাসছে। সেখানে কী লেখা ছিল, এতক্ষণে সারা দুনিয়া জেনে গিয়েছে। ঠিক দেখছি তো! আবার পড়ে দেখলাম। অ্যাকাউন্টটা ‘ভেরিফায়েড’ কি না সেটাও দেখে নিলাম। নাহ্, সবই তো ঠিক আছে। তা হলে? ঘণ্টাখানেক আগের সময়টা কি সত্যিই ফুরিয়ে গেল?

জম্মুর যে হোটেলের ঘরে বসে মেসেজ পড়ছিলাম, তারা ‘চেক ইন’ করার সময় জানিয়ে দিয়েছিল, সাইরেন বাজলেই সমস্ত জিনিসপত্র ঘরে রেখে দৌড়তে হবে বেসমেন্টে। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গোটা শহর ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে যাবে। ঘরের একটা মাত্র আলো জ্বালানো যাবে। কিন্তু পর্দা টেনে দিতে হবে। তেমন হলে ওই আলোটাও অফ করে দিতে হবে।

আনন্দবাজার ডট কমের জন্য এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। কিন্তু ব্ল্যাক আউট কই? উল্টে একে একে জ্বলছে হোটেলের লবির আলো। জ্বলেছে নিয়ন ডিসপ্লে বোর্ড। উল্টো দিকের গুরুদ্বারে ঠিক সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে গিয়েছে ভজন। বিলি করা হচ্ছে ঘি-গড়ানো হালুয়া। মানুষজন রাস্তায় বেরোতে শুরু করেছেন। উঠছে দোকানের ঝাঁপ। জম্মু ফিরছে সপ্তাহান্তের নিজের চেহারায়। কিন্তু তার মধ্যেও গলির মোড়ে মোড়ে জটলার মুখগুলো আলোচনা করছে ২৪ ঘণ্টা আগের কথা।

সেটা একটা অন্য গ্রহ। আলাদা গ্রহ।

শুক্রবার এই সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যেই ‘শেলিং’ হয়েছিল জম্মু শহরের বুকে। আতঙ্কিত লোকজন পালাতে শুরু করেছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। লিখতে লিখতে ২৪ ঘণ্টা আগে জম্মু থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে রজৌরি সেক্টরের রাত মনে পড়ছিল। ঠিক এই সময়েই বাজতে শুরু করেছিল সাইরেন। তিন দিকের পাহাড় থেকে অনবরত গুলির আওয়াজ আসছিল। রাত যত বেড়েছে, আওয়াজও তত বেড়েছে। মধ্যরাতে রজৌরির আকাশ জুড়ে একের পর এক ড্রোন আর এস ৪০০-র লড়াই। লড়াই চলছিল রজৌরি টাউনের ঠিক মাথার উপরের আকাশে। গোটা এলাকা অন্ধকার করে শত্রুপক্ষের ‘ড্রোন’, ‘শেল’ চিনে নিচ্ছিল ভারতীয় সেনা। এক মুহূর্তের জন্যও সাইরেন বন্ধ হয়নি। স্থানীয় মানুষ সকলে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁদের বা আশপাশের বাড়ির বেসমেন্টে। ঘণ্টা যত পেরিয়েছে, সময় যত ভোরের দিকে গড়িয়েছে, ‘শেলিং’ তত তীব্র হয়েছে।

শনিবার ভোর পৌনে ৫টা থেকে ‘শেলিং’য়ের শব্দে ঝনঝন করে কেঁপে উঠছিল হোটেলের কাচের জানালা। থরথর করে কাঁপছিল গোটা এলাকা। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছিল মুহুর্মুহু। ভোর সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হল বিস্ফোরণ। এক বার নয়, দু’বার নয়, বারংবার। শেষ বিস্ফোরণের ধোঁয়া উঠতে শুরু করল রজৌরি টাউনের ভিতর থেকে। খবর এল, নিহত হয়েছেন রজৌরির অতিরিক্ত জেলাশাসক। সকাল ৮টা পর্যন্ত তীব্র লড়াই চলছিল। সঙ্গে বাড়ছিল বেসমেন্টগুলোর ভিতরে আর্তনাদের শব্দ।

‘শেলিং’ একটু কমতেই হাজার হাজার মানুষ এক কাপড়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করেছিলেন। তখনই মনে হয়েছিল, আমাকেও রজৌরি ছেড়ে যেতে হবে। যে করে হোক, জম্মু পৌঁছতে হবে শনিবারের মধ্যে। রজৌরি থেকে রওনা হলাম জম্মুর দিকে। মোবাইলের স্ক্রিনে পরিবার-পরিজন-বন্ধুদের একের পর এক উদ্বিগ্ন মেসেজ ঢুকছিল!

ভয় করছিল। খুব ভয় করছিল। অক্ষত শরীরে জম্মু ফিরতে পারব তো? রজৌরি থেকে জম্মুর রাস্তায় একের পর এক সীমান্তবর্তী এলাকা। দুপুর ১২টার সময়েও সীমান্তে ‘শেলিং’য়ের শব্দ কানে আসছিল। আখনুরের যে ধাবায় সামান্য কিছু খাওয়ার জন্য নামতে হয়েছিল কিছু ক্ষণের জন্য, সেই ধাবার দুই কর্মী আমার গাড়িতে পালিয়ে এলেন জম্মু। যখন জম্মু ঢুকছি, তখনও শহরটা থমথম করছে। ‘ইউপিআই পেমেন্ট’ নিতে চাইছেন না কেউ। দোকানের উদ্বিগ্ন মুখ বলছে, ‘‘হাতে ক্যাশ দরকার। যে কোনও সময় প্রয়োজন হতে পারে।’’ ঝাঁপ ফেলেছে সমস্ত হোটেল। কেউ থাকতে দিতে চাইছে না। সকলেরই ভয়, রাত নামলেই লড়াই আরও তীব্র হবে। বাসে-গাড়িতে-ট্রেনে যে যে ভাবে পারছেন শহর ছাড়ছেন। বার বার খবর শুনছেন আর দেখছেন। কোন দিকে এগোচ্ছে পরিস্থিতি! চ্যানেলগুলোয় যা দেখানো হচ্ছে, তাতে উদ্বেগ আরও বাড়ছে।

কিন্তু এ সব অন্তত এক ঘন্টা আগের কথা। যে জম্মুতে বসে এই লেখা লিখছি, সেটা একটা অন্য গ্রহ। সেখানে উদ্বেগ নেই। সেখানে দোকানের ঝাঁপ খুলছে। সেখানে রাস্তায় নেমেছেন লোকজন।

এই শনিবারের সন্ধে ৬টা বহু দিন মনে রাখবেন জম্মুর মানুষ। এ এক প্রাণ হাতে ফিরে পাওয়া সন্ধ্যা। যে সন্ধ্যায় গুরুদ্বারের ভজনে শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়ছিল বারুদের গন্ধ ভরে থাকা পশ্চিম আকাশে।

একটা গ্রহে দিন শুরু করেছিলাম। শেষ করলাম অন্য একটা গ্রহে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.