বড়বাজারের হোটেলে পদে পদে গাফিলতি, কেউ সিঁড়িতে দগ্ধ, কেউ ঘরেই দমবন্ধ! কারও ঝাঁপ আতঙ্কে, ১৪ মৃত্যু কী ভাবে

বড়বাজারের হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ফলে মৃত ১৪ জনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে। আরজি কর হাসপাতাল, নীলরতন সরকার (এনআরএস) হাসপাতাল এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃতদের দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে আগুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে। এক জন প্রাণ বাঁচাতে হোটেল থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া, কারও কারও দেহে আগুনে পোড়ার ক্ষতও পাওয়া গিয়েছে।

বড়বাজারের হোটেলে মৃতেরা প্রায় সকলেই ভিন্‌রাজ্যের বাসিন্দা। যদিও কয়েক জনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। পুলিশ সূত্রে খবর, ছ’তলা ওই হোটেলের ছাদে এবং ছাদের কাছে পড়ে ছিল দু’টি দেহ। এ ছাড়া, দোতলা থেকে তিন তলায় ওঠার সিঁড়িতে ছিল এক জনের দেহ। বাকি ১০টি দেহ পাওয়া গিয়েছে হোটেলের বিভিন্ন ঘর থেকে।

বড়বাজারের এই হোটেলেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

আরজি করে যে সমস্ত দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে, তার রিপোর্ট বলছে, অধিকাংশের মৃত্যুর কারণ বিষাক্ত ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে যাওয়া। তাঁদের শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করেছে কার্বন। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া, কোনও কোনও দেহে পোড়া ক্ষত মিলেছে। সূত্রের খবর, হোটেলের সিঁড়িতে যে দেহটি ছিল, তাতে পোড়া ক্ষত মিলেছে। মনে করা হচ্ছে, আগুন লাগার পরে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। আগুনে ঝলসেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

এনআরএস হাসপাতালের দেহগুলির ময়নাতদন্তের রিপোর্টে কোনও পোড়া ক্ষতের উল্লেখ নেই। সেখানে যাঁদের ময়নাতদন্ত হয়েছে, মূলত শ্বাসরুদ্ধ হয়েই তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া, যিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন, মেডিক্যাল কলেজের কাছে পুলিশ মর্গে তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, তাঁর মৃত্যুর কারণ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে পতন।

মৃতদের পরিচয়

বড়বাজারের ওই হোটেলে মোট ৭৯টি ঘর ছিল। অতিথির সংখ্যা ছিল ৮৮ জন। হোটেলের চতুর্থ তলায় মঙ্গলবার রাতে আচমকা আগুন লেগে যায়। দমকলের ১০টি ইঞ্জিনের চেষ্টায় দীর্ঘ ক্ষণ পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন দুই মহিলা এবং দুই শিশু। পুলিশের তরফে মৃতদের নামের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে রয়েছেন বিহারের নীরজকুমার বর্মা (২৯), ওড়িশার রাজেশকুমার সান্তুকা (৬১), মনোজ পাত্র (৪৩), উত্তরপ্রদেশের কমল নাভালগড়িয়া (৩৬), আকৃতি নাভালগড়িয়া (২২), তামিলনাড়ুর পি রিথন (৩), পি দিয়া (১০), এস মুত্থু কৃষ্ণাণ (৬১) এবং ঝাড়খণ্ডের মনোজ পাসওয়ান (৪০)। এ ছাড়া, যাঁদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি, তাঁদের মধ্যে তিন জনের বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর, এক জনের বয়স আনুমানিক ৫০ বছর এবং এক জনের বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। বড়বাজারের আগুনে ১৩ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের উদ্ধার করে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসার পর প্রত্যেককেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

কী কী গাফিলতি

অগ্নিকাণ্ডের পর বড়বাজারের সেই হোটেলের একাধিক গাফিলতি প্রকাশ্যে এসেছে। বুধবার ঘটনাস্থলে যান দমকলের ডিজি রণবীর কুমার। তিনি জানান, ওই হোটেলের ‘ফায়ার লাইসেন্স’-এর মেয়াদ শেষ হয়েছিল তিন বছর আগেই। তার পর তা আর নবীকরণ করাননি কর্তৃপক্ষ। হোটেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও অগ্নিকাণ্ডের সময় তা কাজ করেনি। দমকলের প্রাথমিক অনুমান, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আদৌ কার্যকর ছিল না ওই হোটেলে। দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় হোটেলে ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ বাজেনি। হোটেলে প্লাইউডের কাজ চলছিল। সেখান থেকেই ধোঁয়া ক্রমে উপরের দিকে ওঠে। অভিযোগ, হোটেলের জানলাগুলি অধিকাংশই বন্ধ ছিল। কেন্দ্রীয় বাতানুকূল ব্যবস্থা বা সেন্ট্রাল এসি না-থাকা সত্ত্বেও কেন জানলা বন্ধ, কেন ধোঁয়া বেরোতে পারল না, প্রশ্ন উঠেছে। হোটেলের বাইরে থেকে দেখা গিয়েছে, বেশ কয়েকটি জানলা ইট-সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজের নেপথ্যে কোন কারণ ছিল, প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে এই কাজ করা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, হোটেলের অন্য একটি অংশে আরও একটি সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের সময় শাটার দিয়ে ওই সিঁড়ির প্রবেশপথ বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে যদিও শাটার খুলে দেওয়া হয়। এত বেনিয়ম সত্ত্বেও কেন স্থানীয় পুর প্রশাসনের বিষয়টি নজর আসেনি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অগ্নিকাণ্ডের পর বড়বাজারের হোটেলের সামনে পুলিশ।

তদন্ত কোন পথে

কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তের জন্য একটি তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। ডিসি সেন্ট্রালের নেতৃত্বে ওই দলে রয়েছেন ১১ জন আধিকারিক। পুলিশ সূত্রে খবর, হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কী ভাবে আগুন লাগল, খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। হোটেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগগুলিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হোটেলে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। হোটেলের মালিকের বিরুদ্ধে দমকল অভিযোগ দায়ের করেছে। দুই মালিকই পলাতক।

মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন

জগন্নাথধাম উদ্বোধন উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন দিঘায়। সেখান থেকেই তিনি বড়বাজার কাণ্ডের দিকে নজর রেখেছিলেন। বুধবার সকালে তিনি জানান, ওই হোটেলে দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল। তাই এত মৃত্যু। মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে এবং আহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। উদ্ধারকাজে হাত লাগানোর জন্য স্থানীয়দেরও ধন্যবাদ দিয়েছেন। তিনি জানান, দমকল এবং পুলিশের তৎপরতায় ৯৯ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে বড়বাজারের হোটেল থেকে। এই ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

বিরোধী কটাক্ষ

নানা গাফিলতির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে দাবি করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর বক্তব্য, যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার কারণেই গোটা ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পরেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন তৎপর ছিল না বলেই অভিযোগ করেছেন শুভেন্দু। এক্স হ্যান্ডলের পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘এটা ঘটেছে, কারণ গোটা প্রশাসন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিন দিনের ছুটি কাটাতে দিঘায় চলে গিয়েছে।’’

আতঙ্কের দু’ঘণ্টা

হোটেলের পাঁচ তলার কার্নিসে দাঁড়িয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিলেন ওড়িশার নেহা আগরওয়াল। তিনি জানান, মঙ্গলবারই তাঁদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। স্বামী এবং ১৫ বছরের ভাইপোকে নিয়ে হোটেলের ঘর থেকে বেরোনোর মুখে অগ্নিকাণ্ডের কথা জানতে পেরেছিলেন নেহা। ধোঁয়ার কারণে নীচে নামতে পারেননি। শৌচালয়ের জানলার কাচ ভেঙে কার্নিসে নেমে দাঁড়ান। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে দমকল তাঁদের উদ্ধার করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.