হিন্দু সমাজে নানা ভাবে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা বামপন্থীদের কর্মধারার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। সেজন্য নানাভাবে তারা বিচ্ছিন্নতার বিষ ছড়ায়। দ্বৈতপরক (dichotomous) এবং একাত্মতার বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে যে ইতিহাস তারা রচনা করে সেখানে বস্তুনিষ্ঠতা (নাম, তারিখ, স্থান প্রভৃতির খুঁটিনাটি) এত প্রবল যে বস্তুর পটভূমিকায় বর্তমান ভাবটি বিবর্ণ হয়ে পড়ে। যে কোন বস্তুই আসলে একটি আদর্শ বা ভাবেরই মূর্ত রূপ– এটিই আমাদের সনাতন বিশ্বাস। যে কোন বস্তুর বিশ্লেষণও যে যার ভাব অনুসারে করে– এটি প্রসিদ্ধ এবং অনুভূত সত্য। যেমন– পূর্ণিমার চাঁদ কারও কাছে প্রেয়সীর মুখ, কারও কাছে ঝলসানো রুটি। সেজন্য ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে বস্তুর বিশ্লেষণই প্রকৃত পন্থা। কিন্তু বামপন্থীরা ইতিহাস রচনার এই স্বাভাবিক পদ্ধতিকে পাল্টে দিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করে এবং তার মাধ্যমে সমাজে বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ তৈরি করে।

হিন্দুদের দেবদেবী নিয়েও তাদের এই ধরণের নোংরামি বহুদিন চলছে। হিন্দু সমাজে পূজিত নানা স্থানদেবতা, গ্রামদেবতা প্রভৃতি অপ্রসিদ্ধ দেবতাদেরকে তারা হিন্দু পরম্পরায় বহিরাগত বলে প্রচার করে এবং তার মাধ্যমে হিন্দু সমাজের একাত্মতাকে খণ্ডিত করার চেষ্টা করে। হিন্দু সমাজে আরাধিত দেবতাদের মধ্যে তারা আর্য, অনার্য, আদিবাসী, বৈদিক, কৌম ইত্যাদি নানাবিধ শ্রেণীবিভাগ তৈরি করেছে।শিব, কালী, মনসা প্রভৃতি অনার্য আদিবাসীদের দেবতা, এদেরকে আর্যরা অধিগ্রহণ করেছে’। ‘কালী ছিল ডাকাতদের দেবী। কালীর পূজা করে ডাকাতরা লুণ্ঠন করতে বেরোত।’ ইত্যাদি নানাবিধ আষাঢ়ে গল্প অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় ‘বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস’-এর ক্যাপসুলে ভরে তারা সমাজে পরিবেশন করে। নিজ ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীন হিন্দু সমাজের বড় অংশ এই সমস্ত গালগল্প বিশ্বাসও করে। এইরকম একটি সারবত্তাহীন দাবির বিষয়ে একটি প্রশ্নোত্তর মূলক বিতর্ক অন্য একটি সমূহে হয়েছিল। সেটি একত্রিত করা হল। আশা রাখি সমাজের উপকার হবে।
পূর্বপক্ষ– কালী, মনসা, বনবিবি, দক্ষিণরায় প্রভৃতিরা কৌম দেবতা, বৈদিক নন
সিদ্ধান্ত– কৌম, বৈদিক এই সমস্ত ভেদ নিরাধার। এগুলি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কল্পনার ফসল মাত্র।

পূর্বপক্ষ– কিন্তু বনবিবি, দক্ষিণ রায় বা মনসা এনারা তো জনগোষ্ঠীর দেবতা। বৈদিক নন। তাই কৌম বলা টা কি ভুল হবে?
সিদ্ধান্ত– এঁরা বিশেষ বিশেষ দেবতা। কোন বিশেষ গোষ্ঠীর আরাধ্যা কিংবা কোন বিশেষ স্থানের অধিবাসীদের আরাধ্যা। এদের বৈদিক দেবতা বলা হয় না। কারণ এঁদের বর্ণনা বেদে পাওয়া যায় না। যেমন, রামায়ণে নিকুম্বলার (নিকুম্ভিলা নামে অধিক প্রসিদ্ধ) কথা পাওয়া যায়। নিকুম্বলা বৈদিক নন। তিনি কি কৌম? তাৎপর্য হল, এই ধরণের কম প্রসিদ্ধ দেবতারা রামায়ণেও উপস্থিত ছিলেন। এই ধরণের দেবতাদের বোঝানোর উদ্দেশ্যে আপনি যে কোন ধরণের শব্দ প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু, কৌম শব্দটির অর্থ ঠিক স্পষ্ট নয়।
পূর্বপক্ষ– কৌম শব্দের অর্থ জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত বা সম্পর্কিত।
সিদ্ধান্ত– সেটা ঠিক। কিন্তু শব্দটির ব্যুৎপত্তি কী? এঁরা কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আরাধ্য দেবতা এটা বলা চলে কি? দক্ষিণরায় কি কোন জনগোষ্ঠীর আরাধ্য, নাকি নির্দিষ্ট স্থানে আরাধ্য, নাকি নির্দিষ্ট পেশার মানুষের আরাধ্য? এই ধরণের অস্পষ্টতা রয়েছে। যেমন কর্মকার, চর্মকার, সূত্রধার এরা বিশ্বকর্মার আরাধনা করেন। বিশ্বকর্মা কি কৌম?
পূর্বপক্ষ– গোষ্ঠী তো স্থানভেদেও সম্ভব। শুধু জাতিগত হতে হবে কেন? বিশ্বকর্মা বৈদিক কারণ বেদে ওনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
সিদ্ধান্ত– কিন্তু, বিশ্বকর্মা নির্দিষ্ট পেশাগোষ্ঠীর আরাধ্য তো? তাহলে কীভাবে এই পার্থক্যটি নির্ণয় করা হবে?
পূর্বপক্ষ– গোষ্ঠী র মধ্যে কোনো একটি জিনিসে মিল থাকতে হবে। সেটা পেশা, স্থান, ধর্ম, জাতি ইত্যাদি হতে পারে। দেখতে হবে তারা কোনো বৃহত্তর সেট এর সাবসেট কি না? যেমন সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাই। কিন্তু মনসা, বনবিবি বা দক্ষিণ রায় এর উল্লেখ পাই না। কারণ তাদের উৎপত্তি এবং উপাসনা একটি অঞ্চল এর মধ্যেই সীমিত। এবং অপেক্ষাকৃত নবীন ও বটে। আগে উল্লেখ পাওয়া যায় না। কারণ কনৌজ ব্রাহ্মণ দের আসার আগে বঙ্গদেশে আদিবাসী ছাড়া বৈদিক সনাতন ধর্মের প্রচার সেরকম ভাবে হয় নি বলেই জানি। বৃহত্তর ভারতবর্ষ তাদের অস্তিত্ব জানলেও গুরুত্ব দেন নি।
সিদ্ধান্ত– আপনার কথা অনুযায়ী মনসা বা বনদেবী কেমন ভাবে কৌম হলেন? এরা তো দেবী দুর্গারই সাবসেট। দুর্গাসপ্তশতীতে দেবীর স্তুতিতে দেবতারা বলেছেন, ‘বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু’– (দুর্গাসপ্তশতী ১১/৬) জগতে সমস্ত বিদ্যা এবং সমস্ত নারী তোমারই ভেদবিশেষ। আমরা সেই বচনটিকে বাদ দেব কেন? (আদিবাসী শব্দটি অত্যন্ত অপমানজনক। এই বিষয়টি এবং এই সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীর উত্তর এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।)
পূর্বপক্ষ– কিন্তু নাম টা খেয়াল করুন– বনবিবিশুনেছি আসলে তিনি বাংলাদেশের কোনো এক রাজার পরিত্যক্তা স্ত্রী। তিনি দেবী রূপে পূজিতা হন ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে।
সিদ্ধান্ত– বনদেবতাদের উল্লেখ বহু প্রাচীন। আপনি উত্তররামচরিত, বিভিন্ন পুরাণ ঘাঁটলে বহু বনদেবতার উল্লেখ পাবেন। তাদের আলাদা আলাদা নামে সবসময়ে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু তাদের আরাধনা সেই বনের অধিবাসীরা করছে বলে পাওয়া যায়। তেমনই কোন দেবতা বনদেবী, দক্ষিণরায় প্রভৃতিরা।

বনদেবীর বিষয়টিও নতুন কিছু নয়। শ্রীবৈষ্ণবদের (রামানুজাচার্যের অনুসারী) একজন আল্বার আছেন– অণ্ডাল/গোদাদেবী। তাঁকে স্বয়ং শ্রীমন্নারায়ণ শরীর ধারণ করে বিবাহ করেছিলেন। গোদাদেবীর বহু মন্দির বর্তমান এবং শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তিনি সুপূজিত। তাঁকে কি আপনি কৌম বলবেন? তিনিও একজন মানুষ ছিলেন, একটি নির্দিষ্ট উপাসনা সম্প্রদায়েই তিনি পূজিত। অম্বরের দুর্গে গেলে একটি প্রাচীন মন্দির পাবেন সেখানে কৃষ্ণের সঙ্গে মীরার মূর্তি রয়েছে। বনদেবীও এঁদেরই মত।
কিন্তু, বনদেবী যেহেতু সমাজের অন্তিম পংক্তির মানুষদের আরাধিত সেজন্য অত্যন্ত চালাকির এবং দুরভিসন্ধির সাথে তাকে কৌম/অনার্য/আদিবাসী ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটিই হল বৃহত্তর হিন্দুবিরোধী চক্রান্ত। এর থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ, এমন আরও অনেক দেবতা আপনি ভারতবর্ষের গ্রামগুলিতে ঘুরলে পাবেন। কোথাও দক্ষিণরায়, কোথাও ভৈরু বাবা, কোথাও নিস্তারিণী দেবী ইত্যাদি নামে তাঁরা পরিচিত।

রাকেশ দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.