মহিষাসুরের জন্ম, নাম ও মহিষ রূপের কারণ কি? জানতে পড়ুন পুরাণ কাহিনি।

দনু হলেন দক্ষের এক কন্যা, ঋষি কাশ্যপের স্ত্রী। তিনি চল্লিশটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, তাদের বলা হয়, দানব বা দৈত্য। এরকমই তাঁর দুই পুত্র হলেন, রম্ভ ও করম্ভ। দুই ভাই, দুজনেই দুজনের ভারি ন্যাওটা। দুজনেরই ছেলেপুলে হয়নি। ওমা, বিয়েই হয়নি মূলে, ছেলেপুলে হবে কোত্থেকে! তবু তাঁরা ঠিক করলেন যে, এমন এক তপস্যা করবেন, যাতে ছেলে একেবারে বাপ বাপ  বলে হবে; আর সে হবে একদম ত্রিভুবনজয়ী। মারলে গণ্ডার, লুটলে ভাণ্ডার–দৈত্যজাতের লক্ষ্যই হল তাই। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নাই। কাজেই লেগে পড়লেন দুজনে তপস্যায়। রম্ভ এক বটগাছের তলায় পঞ্চাগ্নি জ্বেলে তপস্যায় মগ্ন হলেন আর করম্ভ জলের তলায় শুরু করলেন ঘোর তপস্যা। দেবরাজের একটুতেই অতুপুতু বাতিক। এই বুঝি রাজপাট গেল, এই গেল গেল গেল! ব্যস, মাথার মধ্যে কিরিপোকা কুট করে কামড় দিল, অমনি ইন্দ্র নিজেই জলের তলায় কুমীর হয়ে ঢুকে ঠ্যাং টেনে করম্ভর ঘাড় মটকে ফট করে একেবারে পটকে দিলেন। অমনি পটাশ করে সে খবর পৌঁছে গেল রম্ভর কাছে। তাই শুনে রম্ভ তো রেগে কাঁই! ভাই যখন নেই, তখন এ প্রাণ নিয়ে আর হবে কি! দীর্ঘ তপস্যায় শরীর রুগ্ন, হীনবল; এই অবস্থায় তো প্রতিশোধও নেওয়া অসম্ভব! আর সেকথা মনে আসতেই তিনি ঠিক করলেন নিজেকে শেষ করে দেবেন। যজ্ঞের আগুনে নিজেই নিজের মাথা কেটে আহুতি দেবেন। যজ্ঞের আগুন তো জ্বলছিলই, তিনি বাঁ হাতে নিজের রুক্ষ চুল মুঠিতে চাপলেন আর ডান হাতে ধরলেন খড়্গ। সবই প্রস্তুত। এমন সময় অগ্নিদেবের মতিচ্ছন্ন হল। তিনি আবির্ভুত হয়ে আটকে দিলেন–বাপু হে, এভাবে নিজেকে শেষ করে দিলে মহাপাতক হতে হয় যে! তুমি বরং যে জন্য তপস্যা শুরু করেছ, সেই বর চাও, আমি দেব; তোমার তপস্যা পূর্ণ হয়েছে।

রম্ভ ভেবে দেখলেন বরে কাঙ্ক্ষিত পুত্রটি পেলেই গুছিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে, সুতরাং মরার চেয়ে অপেক্ষা ভালো। তখন তিনি বুদ্ধি করে অগ্নিদেবের কাছে চাইলেন এমন এক পুত্র, যে নানান রূপ ধারণ করতে পারবে এবং একদিন ত্রিভুবন জয় করতে পারবে। অগ্নিদেব বললেন, তথাস্তু অর্থাৎ তাই হবে। আরও বললেন যে, এখন পুত্রউৎপাদনের জন্য পছন্দসই যার সঙ্গে মিলিত হবেন রম্ভ, তাঁর গর্ভেই এমন বীর সন্তানের জন্ম হবে। তারপর মুচকি হেসে অগ্নিদেব নিজের ঘরে গেলেন।

এদিকে তপস্যাস্থল থেকে বেরুতেই রম্ভ একটি মহিষী অর্থাৎ মেয়ে মোষকে চরতে দেখে খুব কামার্ত হয়ে পড়লেন এবং তার সঙ্গে কামাচারে লিপ্ত হলেন। মহিষী বাধা দিল না। ফলে, অচিরেই সে রম্ভর ঔরসে গর্ভ ধারণ করল। এই অবস্থায় একদিন অন্য এক কামার্ত মোষ তার সঙ্গে সঙ্গম করার জন্য জোর খাটাতে গেলে রম্ভ তাকে বাধা দিতে গেলেন। মোষটি দারুণ বলশালী, তীক্ষ্ণ তার দুই শিং, তায় আবার কামার্ত! ফলে, শুরু হল দারুণ টক্কর, দারুণ লড়াই আর শেষটায় নিদারুণ পরিণতি। মোষ একসময় তার দুই শিং দিয়ে রম্ভর হৃৎপিণ্ড একেবারে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। তাতেই রম্ভ মারা গেলেন। রম্ভকে হত্যা করে কামমত্ত মোষ যেন দ্বিগুণ উত্সাহে মহিষীকে ভোগ করার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন। মহিষী তখন একে শোকে আকুল, তায় নিজেকে রক্ষা করতে ব্যাকুল। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে আশ্রয় চাইল বটগাছবাসী এক যক্ষের কাছে। তখন সেই যক্ষ তির ছুঁড়ে সেই কামমত্ত মোষকে হত্যা করে মহিষীকে রক্ষা করল। তারপর সে শুরু করল রম্ভকে দাহের আয়োজন।

যক্ষ যখন রম্ভর চিতা সাজালো; তখন শোকে কাঁদতে কাঁদতে মহিষীর যেন পাগলপারা অবস্থা! রম্ভকে চিতায় তোলার সময় সেও উঠল সহমরণের জন্য। গর্ভের সন্তানের দোহাই দিয়েও যক্ষ তাকে কিছুতেই আটকাতে  পারল না। যক্ষ বেচারা কি আর করে! অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে সে চিতায় আগুন দিল।

জ্বলে উঠল চিতা। জ্বলতে লাগল দুই দেহ। দাউ দাউ দাউ। একসময় হঠাৎ চিতার মাঝখান থেকে উঠল এক জগৎ কাঁপানো হুঙ্কার, সেখান থেকে মহিষীর শরীর বেয়ে বেরিয়ে এলেন এক অসুর। সেই অসুর নিজের নাম ঘোষণা করলেন, মহিষাসুর! রম্ভ ও মহিষীর পুত্র। অতৃপ্ত প্রতিশোধস্পৃহা আর পুত্র মহিষাসুরকে সেই প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করার জন্য রম্ভ নিজের বহ্নিমান শরীর থেকে সৃষ্টি করলেন আর এক অসুরের, সেই অসুরের নাম, রক্তবীজ। 

এই গেল ‘দেবীভাগবত’ পুরাণে বর্ণিত মহিষাসুরের জন্ম বৃত্তান্ত। আর এই বৃত্তান্ত এটা স্পষ্ট যে, মা মহিষী হওয়ায় এবং বাবার বরের কারণে মহিষাসুরের নাম, ‘মহিষাসুর’ হয়েছিল এবং তিনি রণে ও ছলে মহিষের রূপ ধারণ করতে পারতেন। দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধে তো তাই-ই করেছিলেন। দেবীর পাদমূলে তাই আহত মহিষাসুরের সঙ্গে নিহত মহিষ দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.