আলোচনার বিষয় ‘Aggressive Hinduism’ by Sister Nivedita. উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে ‘প্রগতিশীল হিন্দুধর্ম’। ১৯০৫ সালের জানুয়ারি মাসে এই গ্রন্থটি রচনা করেন নিবেদিতা। ইতোমধ্যে স্বামীজির শরীর গেছে ১৯০২ সালের ৪ ঠা জুলাই। নিবেদিতা তাঁর গুরুদেবের বাণী ও শিক্ষা দেশব্যাপী প্রচার করে বেরাচ্ছেন এবং ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংস্রব ত্যাগ করেছেন।

এখন Aggressive কথাটির মানে প্রগতিশীল কিনা, সে বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন হয়তো আপনাদের মনেও আসতে পারে। Aggressive কথাটির যথার্থ অর্থ হল — Behaving in an angry and violent way towards another person/ready or likely to attack or confront characterised by or resulting from aggression; বাংলা করলে দাঁড়াবে ‘আগ্রাসী’ অর্থাৎ ‘আগ্রাসী হিন্দুত্ব’। নিবেদিতার নামকরণের মধ্যে যে সাদামাটা অর্থ ছিল, তা বলা যায় না।

কারণ ভগিনী নিবেদিতাকে জানলে- বুঝলে তবেই বোঝা যাবে তিনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে কতটা আন্তরিক ছিলেন এবং হিন্দুধর্মের প্রচার, মাহাত্ম্য কীর্তন করাটাকে কতটা গর্বের বিষয় বলে মনে করতেন। কিন্তু দুঃখের কথা হল, নিবেদিতার মত হিন্দু প্রচারকের সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা সঠিক মূল্যায়ণ করেন নি, যদিও ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট সদর্থক আলোচনা করেছেন। অনেক কথাই অজানা রয়ে গেছে, তার বড় কারণ হল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন থেকে নিবেদিতার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। নিবেদিতা একটি বিশাল হিমশৈলের মত, যতটা দেখা যায় তাঁকে তার চাইতে অনেক গুণ বেশি তার কর্মজগৎ, নিমজ্জিত হিমশৈলের মতই তার বিপুল আয়তন। হিমশৈল যতটা সমুদ্রের জলের উপর ভেসে থাকে তা মাত্র ১/৯ অংশ, সাগরের জলের তলায় আরও ৮/৯ অংশ রয়ে যায় তার অবয়ব। নিবেদিতাকেও জানার তুলনায় অজানাই রয়ে গেছে বেশি। নিবেদিতা বিংশ শতকের জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মনীষা বিকাশের ফসলকে নিজে সবুজ-সার (Green Manure) রূপে লালন করেছিলেন। প্রত্যক্ষ নিবেদিতার চাইতে পরোক্ষ নিবেদিতা অনেক গুণে শক্তিশালী।

অস্ট্রীয় নোবেলজয়ী পদার্থবিদ এর্ভিন শ্রুডিংগার বলেছিলেন, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান Spiritual Anaemia বা আধ্যাত্মিক রক্তাল্পতাতে ভুগছে, তিনি প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে কিছু রক্তদান দেখতে চান। এই রক্তদান প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং তার ফলেই ‘পাশ্চাত্য রক্তে প্রণব ওঙ্কার’ ধ্বনিত হল। বেরিয়ে এলেন ‘সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর সর্বজয়ী তাপসী দুহিতা’ ভগিনী নিবেদিতা। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল থেকে কীভাবে গড়ে উঠলেন ভগিনী নিবেদিতা, সে আর এক গল্প। ভারতবর্ষের মৃত্তিকার অণুতে অণুতে তাঁর ভাবতণু ছড়িয়ে গেল।

হিন্দুধর্ম কী Aggressive হওয়া উচিত? এ প্রসঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মতামত জেনে নিলে আন্দাজ করে নিতে পারবো, তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ সরকার গঠিত হলে হিন্দুধর্মের স্থান কোথায় হত। ১৯৩৭ সালে ইউরোপ ভ্রমণ কালে রচিত নেতাজীর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘An Indian Pilgrim’ গ্রন্থে হিন্দুধর্ম প্রসঙ্গে নিবেদিতা ও বিবেকানন্দের মতামত বিচার করে লিখছেন, “In the continent of Africa, only two religions are preached at present, Christianity and Islam. Why should Hinduism not be preached there? Sister Nivedita maintained that Hinduism must be aggressive, Swami Vivekananda was of the same opinion and with this idea, he preached religion on Europe and America. If Hinduism is preached in Europe and America then they might change their views about the Hindus. Indian philosophy might influence western philosophy and the glory and prestige of Indians might to go up. But people over there will never adopt Hinduism. On the other hand if Hinduism is preached among the Africans, they may may adopt Hinduism, if they adopt Hinduism, they will do so, in thousands.” [Sisir Kr. Bose(ed) Netaji Collected Works, Vol 5, Netaji Research Bureau, Calcutta, 1985] অর্থাৎ আফ্রিকা মহাদেশে হিন্দুধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজ করা হলে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পরিধি যে বাড়ত তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিয়েছেন নেতাজী। Aggressive Hinduism -এর প্রবক্তা রূপে বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন, সুভাষচন্দ্রও তার সমগোত্রীয় ধারণা পোষণ করতেন। আর নিবেদিতা তো তাঁর ‘Master’ সম্পর্কে লিখেইছেন, “His object….had always been to make Hinduism aggressive.”

Aggressive Hinduism মানে প্রচারশীল হিন্দুত্বও হতে পারে। সিস্টার নিবেদিতা লিখছেন (অনুবাদ), “সেদিন পর্যন্ত হিন্দুধর্ম নিজেকে প্রচারশীল ধর্ম বলিয়া ভাবে নাই। হিন্দুধর্মের শিক্ষকতা-কার্যই যাঁহাদের নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল, সেই ব্রাহ্মণগণ ছিলেন নাগরিক ও গৃহস্থ এবং সেজন্য হিন্দুসমাজেরই এক অঙ্গস্বরূপ ছিলেন, ফলে সমুদ্রযাত্রার অধিকার হইতেও তাঁহারা বঞ্চিত ছিলেন। আর সিদ্ধপুরুষ বা অবতার পুরোহিত ও পণ্ডিতগণ অপেক্ষা যতটা উচ্চে অবস্থিত, হিন্দুধর্মের অন্তর্গত পরিব্রাজক সন্ন্যাসীগণের মধ্যে যাঁহারা উচ্চতম অধিকারী, প্রামাণ্য হিসাবে যদিও তাঁহাদের স্থান ব্রাহ্মণজাতি অপেক্ষা ঠিক ততটাই উচ্চে — তথাপি তাঁহারা স্বাধীনতার ঐ প্রকার ব্যবহারের কথা আদৌ ভাবিতে পারেন নাই।”

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.