ইঙ্গিত আগেই পেয়েছি, তারকেশ্বরে জয়ে অত্যন্ত আশাবাদী : স্বপন দাশগুপ্ত

গুজরাটের রাজকোট, ভদোদরা, গান্ধীনগরের ওষুধের দোকানে সার দিয়ে রাখা বোতলগুলি। সেখানকার মানুষের খুশখুশে কাশি, নাক দিয়ে জল পড়লে খোঁজ করেন এই আয়ুর্বেদিক মিছরির। আজ থেকে প্রায় ৮৪ বছর আগে হুগলির জঙ্গিপাড়ার অন্তর্গত রাজবলহাটে বসে যিনি তৈরি করেছিলেন দুলালচন্দ্র ভড়ের তালমিছরি। প্রায় চার বছর আগে শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে এই উদ্যোগপতির। এশিয়ার প্রথম বৈদেশিক সহযোগিতায় যৌথ উদ্যোগ ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি‘ থেকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার রাজেন মুখার্জি, বীরেন মুখার্জি— বাঙালির ব্যবসার ইতিহাস অতি সমৃদ্ধ। মুখার্জি-পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় একাডেমি অফ ফাইন আর্টস তো লেডি রাণুর নিজের উদ্যোগে করাl
দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়েও অনেকগুলি বড় শিল্পদ্যোগ বাঙালির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। অনেক ওষুধের কারখানা – বেঙ্গল কেমিকাল, বেঙ্গল ইমুনিটি, ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস, দেজ ইত্যাদি। রান্নার উপকরণ হিসাবে ডালডা আর রসুই প্রায় সমানে সমানে পাল্লা দিত l হিন্দুস্থান ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের বালিগঞ্জের ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা রেলের পয়েন্টস অফ ক্রশিং তৈরিতে জেসপের সঙ্গে পাল্লা দিত। হিন্দুস্তান পিলকিংটনের কাঁচ, বেঙ্গল পটারির সেরামিক, সেন রালের সাইকেল, আনন্দবাজার পত্রিকা— এই রকম অনেক উদ্যোগে বাঙালি শিল্পপতিরা খুব ভালো করছিলেন। তারপরে একে একে অধিকাংশ উদ্যোগের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল নানা কারণে l
নির্বাচনী বিশ্লেষণে গোড়াতেই উদ্যোগপতি বাঙালির এসব অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। এই সোনালি অধ্যায়ে একটা অমলিন নাম ক্যালকাটা কেমিকাল। ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান উদ্যোক্তা রসায়নবিদ খগেন্দ্রচন্দ্র দাশ (গুপ্ত)। পরিবারে ছিল জাতীয়তাবাদের আদর্শ। তাঁর মা মোহিনী দেবী ছিলেন গান্ধীজীর ঘনিষ্ঠ অনুগামী, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সভানেত্রী। স্বদেশি জাগরণের অঙ্গ হিসাবে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা কেমিকাল। এদের মার্গো সাবান, নিম টুথপেস্ট, ল্যাভেন্ডার ডিউ পাউডার, মহাভৃঙ্গরাজ তেল তৈরি করে, আজও সেগুলোর নাম বাঙালির ঘরে ঘরে জানা। এই প্রতিষ্ঠানের উত্তরসূরি হলেন স্বপন দাশগুপ্ত। যিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর অত্যন্ত কাছের লোক বলে চিহ্ণিত। এবার বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছেন তারকেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রে। প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে কি তিনিই হবেন মন্ত্রিসভার প্রধান?
কিন্তু তারকেশ্বর কতটা নিরাপদ আসন স্বপনবাবুর কাছে? ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে বললেন, “আমি বা আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। ২০১৯-এই এর ইঙ্গিত পেয়েছি।” যদিও বিষয়টা অত সরল নয়। বাম আমলের দীর্ঘদিনের মন্ত্রী প্রতীম চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে ২০১১-তে এই কেন্দ্রে জেতেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার তৃণমূলের রচপাল সিং। ‘১৬-র নির্বাচনে তিনি ৫০.৭৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হন। ২০১১ ও ’১৬-র বিধানসভা ভোটে এই তারকেশ্বরে বিজেপি-র ঝুলিতে পড়ে মোট প্রদত্ত ভোটের যথাক্রমে ২.৫৬ এবং ৯.৩৬ শতাংশ। এবার কী এমন হয়েছে, যার জন্য জেতার আশা করছেন? স্বপনবাবুর জবাব, “২০১৬-তে রাজ্যের সব আসনেই বিজেপি কম ভোট পেয়েছিল। এবার পরিবেশ-পরিস্থিতি আলাদা।” আপনি তো বাম আমলে রাজ্যের ভাষা নীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিলেন। বিজেপি-র ভাষানীতি নিয়েও তো অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলো থেকে প্রতিবাদ উঠছে। অভিযোগ উঠছে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার। প্রতিক্রিয়ায় স্বপনবাবু বলেন, “অভিযোগটা ঠিক নয়। এটা নিয়ে রাজনীতি করছেন বিরোধীরা। দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় ভাষাচর্চার অবকাশ থাকছে নয়া শিক্ষানীতিতে।”
একঝলক তাকানো যাক প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে। দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস, কলকাতার লা মার্টিনিয়ার, দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্সের মত অভিজাত নানা প্রতিষ্ঠানে পড়া স্বপনবাবু এমএ এবং পিএইচডি করেন লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে। পোস্ট ডক্টরাল অক্সফোর্ডের নুফিল্ড কলেজ থেকে। ভারতের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পাঁচটি মিডিয়া হাউসে সাংবাদিকতার সুবাদে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তাঁর কিছু বই নজর কেড়েছে বোদ্ধামহলে। বহুজাতিক সংস্থা ক্যালকাটা কেমিক্যাল অধিগ্রহণ করলে স্বপনবাবু সংস্থার পরিচালনমন্ডলির সদস্য হন। ২০১৫-তে সাহিত্য ও শিক্ষায় পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’। ক‘দিন আগেও ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য, বিশ্বভারতী-সহ দেশের একাধিক নামী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনমন্ডলির সদস্য।
এত ওজনদার জীবনপঞ্জী ভোটে কতটা কাজে লাগবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ঘোষণার পরেই তারকেশ্বরের বিজেপি প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন দলের আরামবাগ জেলা সাংগঠনিক সহ-সভাপতি গণেশ চক্রবর্তী। প্রার্থী বদল না হলে রাজনৈতিক সন্ন্যাস অথবা নির্দল প্রার্থী দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থী রামেন্দু সিংহরায় ৬ মার্চ পুজো দিয়ে তেড়েফুঁড়ে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। তারকেশ্বর কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চার সিপিএম প্রার্থী সুরজিৎ ঘোষ বুধবার মনোনয়ন পেশের আগে থেকেই প্রচারে নেমে পড়েছেন পূর্ণ উদ্যমে। আর তারকেশ্বরে মন্দিরে পুজো দিয়ে স্বপনবাবু মনোনয়ন পেশ করলেন সবে শুক্রবার। হাতে অবশ্য কিছুটা সময় আছে। তারকেশ্বরে ভোট তৃতীয় পর্যায়ে ৬ এপ্রিল। প্রচারে ইতিমধ্যে কিছুটা পিছিয়ে থাকা বিজেপি প্রার্থী পরিস্থিতি অনুকূল করতে পারবে কিনা, এলাকায় বিজেপি-র সংগঠন কতটা কাজ করে— এগুলো সবই বড় প্রশ্ন। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন ভোটদাতারা কী ভাবছেন? সময়ই তার উত্তর দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.