ফ্যাক্টশীট: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর বিষয়ে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির কাছে তিনজন হিন্দুর লেখা একটি খোলা চিঠি।

প্রিয় প্রোভোস্ট‚
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়,

আশা করি এই কঠিন সময়ে আপনি এবং আপনার পরিবার ভালো আছে। ‘ব্রিজ ইনিশিয়েটিভ টিমের ফ্যাক্টশীট: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ( আরএসএস)’ এর বিষয়ে আপনাকে এই চিঠিটি আপনাকে আমরা লিখলাম। ফ্যাক্টশীট শুধুমাত্র যে ভুলে ভরা তাই নয়‚ এর ভেতর যথেষ্ট তথ্যগত মিথ্যাচারও করা হয়েছে। আমরা এই ভয় পাচ্ছি যে এই ফ্যাক্টশীটটি আপনার ক্যাম্পাসে হিন্দুফোবিয়া না তৈরী করে দেয়। এছাড়াও এই ধরনের দুর্ণীতিপূর্ণ লেখা আপনার ইন্সটিটিউটের জন্য অসম্মানজনকও বটে।

উক্ত গবেষণাটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে করা হয়নি।

মিথ্যে অনুমানের উপর ভিত্তি করে তৈরী ফ্যাক্টশীটটি হিন্দুফোবিয়া ও হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ঠ।

এটা যতটা না অ্যাকাডেমিক তার থেকেও অনেক বেশী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডামূলক।

অনুগ্রহ করে নীচে লেখা ফ্যাক্টশীট সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ভিত্তিক বিস্তারিত বিশ্লেষণগুলো দেখুন।

[১] সেই ফ্যাক্টশীটে বলা হয়েছে যে আরএসএস একটি আধাসামরিক বাহিনী। এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বরং স্বয়ংসেবক এর অর্থ স্বেচ্ছায় যে সেবা করে। সঙ্ঘের এর স্বেচ্ছাসেবার একটি উদাহরণ হল বিগত করোনাকালীন সময়ে তাদের সেবামুলক কাজগুলো।

[২] দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মুসলমানদের সম্পর্কে ডাক্তারজী হেডেগেওয়ারের ধারণা দেখানোর জন্যে ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরীর মতামত নেওয়া হয়েছে। আমরা তপন রায় চৌধুরীর “স্বস্তিকার ছায়া: হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিতে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি” নিবন্ধটি দেখেছি। তিনি আবার সেটা নিয়েছেন ১২ই মার্চ‚ ১৯৯৩ এ ফ্রন্টলাইন নিউজ ম্যাগাজিন এ এস. আইয়াচুরির ‘গোলওয়ালকার এবং হিন্দু রাষ্ট্র আর্টিকেল’ থেকে। অর্থাৎ তিনি নিজেও ডাক্তারজীর থেকে এমন কিছু শোনেননি বা ডাক্তারজীর্ণ এমন কোনো লেখা পড়েননি। স্রেফ অন্য একজন সাংবাদিকের লেখা থেকে (সেকেন্ডারী সোর্স) তিনি তথ্যটি নিয়েছেন। এবং ডাক্তারজীর উদ্ধৃতিটি সম্পূর্ণভাবে মিথ্যে।

[৩ ক ] গুরুজী গোলওয়ালকার বলেছিলেন যে আরএসএস কোনও প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন নয়। তিনি আরো বলেছিলেন যে “আমরা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছি”! বস্তুত আরএসএস এর নেতাদের মনোভাবকে সঠিকভাবে তুলে ধরার কোনো চেষ্টাই দেখলাম না লেখকদের মধ্যে।

[৩ খ ] জর্জটাউনের লেখকরা ডঃ মুনজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু ডাঃ মুনজে তো আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। তাই ডাঃ মুনজের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে আরএসএস সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব।

[৪] ফ্যাক্টশীটে ইহুদিদের স্বদেশ (home state) সম্পর্কে গুরুজী গোলওয়ালকারের মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও একই ব্যাপার হয়েছে। লেখকরা ইহুদিদের বিষয়ে গোলওয়াকারের চিন্তাধারাকে ভালোভাবে পড়েই দেখেনি। তারা আবারও একটি অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। তারা যে বইটির কথা উল্লেখ করেছে তা ইহুদি হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে (১৯৩৮-৩৯ সালে) লেখা ও প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বরং
কোয়েনরাড এলস্টের কথা উল্লেখ করা যাক। কোয়েনরাড এলস্ট বলেছেন, যখন গোলওয়ালকার লিখেছিলেন যে জার্মানি প্রমাণ করছে ( যেটি তিনি স্পষ্টভাবে “শকিং” বলে মনে করেছিলেন) সাংস্কৃতিকভাবে স্বতন্ত্র জাতিগুলির একসাথে বসবাস করা অসম্ভব, তখন তিনি ইহুদী গণহত্যার কথা উল্লেখ করেননি। সেটা শুরু হতে তখনো তিন বছর দেরী ছিলো। বরং জার্মানিতে বিভিন্ন পদ থেকে ইহুদিদের বিতাড়ন‚ নাগরিকত্ব হরণ এবং জার্মানি থেকে তাদের পালিয়ে যাওয়াটা আরামসে মুসলিম দেশে অমুসলিমদের সাথে ঘটা আচরণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আজও মুসলিম দেশগুলোতে একই ঘটনা ঘটে চলেছে। এমনকি ইহুদীদের নিয়ে যুদ্ধ-পূর্বকালীন নাৎসি নীতিগুলিও কিন্তু গুরুজী সমর্থন করেননি। কোনো সময়েই তিনি একথা বলেননি যে “গনহত্যাই হল সমাধান” বা জার্মান মডেলে ভারতেও “বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংখ্যালঘু অধ্যাপকদের বহিষ্কার করলে ভেদাভেদ এড়ানো যাবে।”

জার্মানদের ইহুদী বিরোধিতা কিংবা জার্মানিতে থাকার বিষয়ে ইহুদিদের অপারগতার বিষয়ে জার্মানদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গুরুজী কোনো প্রশংসা করেননি। নাৎসী শাসনে ‘ইহুদী সমস্যা’ এর পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া কোনো পদক্ষেপের সমর্থনও করেননি তিনি। তিনি মূলত যা করেছিলেন তা হল জার্মান রাষ্ট্রে দুটি জাতির সহাবস্থানজনিত বিরোধের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। এই জাতীয় যেকোন সহাবস্থানের ফলে একটি অন্তর্নিহিত দায়বদ্ধতা প্রমানিত হয়‚ তা হল সংখ্যালঘুদের জাতীয় মূলস্রোতে আত্তীকরণের মাধ্যমে সমস্ত জাতিগুলিকে সমজাতীয় করে তোলার প্রয়োজনীয়তা।

[৫] ফ্যাক্টশীটটিতে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “৩০ শে জানুয়ারী, ১৯৪৮ এ, আরএসএস এর প্রাক্তন সদস্য নাথুরাম গডসে গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। এর পরে, গোলওয়ালকরকে জেলে পাঠানো হয় এবং আরএসএস নিষিদ্ধ করা হয়।”

এবার একে একে উপরের বিষয়টি দেখা যাক।

[৫ ক] গান্ধীর হত্যার অনেক আগেই নাথুরাম গডসে আরএসএস ত্যাগ করেছিলেন কারণ তিনি আরএসএসের সমাজ সংস্কারের কাজে খুশি ছিলেন না।

[৫ খ] গান্ধী হত্যা মামলায় আদালতে আরএসএস-এর একজন সদস্যেরও বিচার হয়নি। এরপরক ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভাই প্যাটেল আরএসএসকে ক্লিন চিট দেন।

[৫ গ] ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮-এ, গোলওয়ালকর প্যাটেলকে চিঠি লিখেছিলেন ” — নেহরুও — অভিযোগ এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার কথা বলেছিলেন কারণ দেশব্যাপী অনুসন্ধান ও তদন্তে আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।” তিনি ৩রা নভেম্বর, ১৯৪৮-এ, সব প্রমাণ দেখাতে এবং আরএসএসের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

[৫ ঘ] অভিযোগ প্রমাণ, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গুরুজী গোলওয়ালকারের মুক্তির দাবিতে আরএসএস ১৯৪৮ এর ৯ই ডিসেম্বর একটি সত্যাগ্রহ শুরু করে। সেবার মাত্র এক মাসে, প্রায় ৮০‚০০০ আরএসএস কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে সরকার আরএসএসের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়।

[৫ ঙ] মাদ্রাজের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং সার্ভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রধান টি.আর. ভেঙ্কটরাম শাস্ত্রী
সর্দার প্যাটেলের সাথে দেখা করেন এবং আরএসএস এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।

[৫ চ] পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ১১ই জুলাই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯-এ বোম্বে বিধানসভার কাছে একটি লিখিত বিবৃতিতে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরারজি দেশাই স্বীকার করে নেন যে আরএসএস-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আর প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হচ্ছে না। এই নিষেধাজ্ঞা নিঃশর্তভাবেই তুলে নেওয়া হয়েছিল।

[৬] ফ্যাক্টশীটটি এই মিথ্যে কথাও প্রচার করেছে যে “নরেন্দ্র মোদি আরএসএসের আজীবন সদস্য, এবং তিনি তার রাজ্যে ২০০২ সালে মুসলমানদের গণহত্যার “অনুমতি দেওয়ার” অভিযোগে অভিযুক্ত।

২০১২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত বিশেষ তদন্ত দল (SIT) একটি ক্লোজার রিপোর্ট দাখিল করে। সেই রিপোর্টে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অন্য ৬৩ জনকে ক্লিন চিট দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছিল যে তাদের বিরুদ্ধে “কোন বিচারযোগ্য প্রমাণ” ছিল না। কিন্তু ফ্যাক্টশীট এই রিপোর্টকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে।

[৭] ফ্যাক্টশীটে এমন বলা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে‚ আরএসএস ভারতে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, সংঘের বিরুদ্ধে ভারতের দলিত-বহুজন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসা উস্কে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ, দলিতদের গণপিটুনি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গনহত্যা।

এটা সুস্পষ্টতই মিথ্যে রটনা। বরং এই আরএসএস ই জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য সমরসতা এর উদ্যোগ নিয়েছে। সমরসতার অর্থ সম্প্রীতি এবং আত্তীকরণ। এই উদ্যোগের দ্বারা দলিত সহ সমাজের সমস্ত অংশকে একত্রীভূত করা হচ্ছে।

[৭ ক] আরএসএসের সিনিয়র কর্মকর্তা শ্রী দত্তোপন্ত ঠেঙ্গরেজীর চিন্তাভাবনা এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। দত্তোপন্ত ঠেঙ্গরেজী বলেছিলেন, “সমরসতা ছাড়া সাম্য সম্ভব নয়। সমতা আনার প্রচেষ্টা তখনই নিখাদ হয় যখন সমরসতার অনুভূতি থাকে অর্থাৎ এর পিছনে একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ থাকে।”

[৭ খ] বর্তমান আরএসএস প্রধান শ্রী মোহন ভাগবতের দলিতদের জন্য সমতা ও ন্যায়বিচার সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা এইক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রী ভাগবত বলেছেন‚

“সমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণ করা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের কাজ নয়, এটি সমগ্র সমাজের কর্তব্য। এটি কোনো বিশেষ মতাদর্শের বিষয়ও হতে পারে না। এটি হল আমাদের জাতীয় লক্ষ্য।”

দলিতদের জন্য সমতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরএসএস অনেক প্রকল্প নিয়েছে। প্রয়োজনে সেইসব প্রকল্পের তালিকা জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া যেতেই পারে।

যদি ব্রিজ ইনিশিয়েটিভের কিছুমাত্র একাডেমিক সততা থাকে, তাহলে আমরা তাদের উপরোক্ত তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা করার অনুরোধ করছি।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ব্রিজ ইনিশিয়েটিভের ফ্যাক্টশীটটির মধ্যে বাস্তবতা বলে কিছুই নেই।

https://www.newsbharati.com//Encyc/2021/12/6/RSS-factsheet.html

অনুবাদ : সৌভিক দত্ত

ড. যশোধন, মধু হেব্বার, ড. আশুতোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.