বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে চলেছে, বুঝে গেছে মৌপিয়া হাওয়াই-মোরগের গোষ্ঠী, বুদ্ধিজীবীদের দল। তারা এতদিন চেটেপুটে প্রসাদ পেয়েছে বর্তমান শাসকদলের, তার আগে সিপিএম-নাম্নী বামেদের। তৃণমূল থেকে এবার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে সেই বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ। তারা আরএসএস-কে চেনেন না, রাষ্ট্রবাদী ভাবনাও বিন্দুমাত্র নেই। কেবল আসন্ন ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চান। এখন সেই খোঁজাখুঁজির পালা সর্বত্র চলছে। কোন্ বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে যোগদান সহজতর হবে। কোন পদ-পদবী পাওয়া যাবে। আগে থেকে লাইন রেখে যাওয়া বুদ্ধিমান-অধ্যাপক কিছু আছেন, হয়তো কথাও হয়ে আছে, তাদের মাধ্যমেই নতুন দলের গুডবুকে আসাটা তাদের কাছে শ্রেয়। অনেকে ভেতরে ভেতরে ২০১৯-এর পর মিসড্-কল করে মেম্বারশিপ নিয়ে ফেলেছেন; অথচ শাসকদলের ছত্রছায়ায় ঘোরাফেরা করছেন। দলকে ভালোবেসে মেম্বার হওয়া, আর সুযোগের মওকায় মেম্বার হওয়ার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক।
সম্প্রতি এক রাষ্ট্রবাদী শোনালেন তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। তিনি দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রবাদী ব্যক্তিত্ব, আরএসএস-র স্বয়ংসেবক। কোনো একটি বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে দলীয় টিকিট পাবার সম্ভাবনা তাঁর হয়তো ছিল। কারণ সেই কেন্দ্রে তিনি বহু পুরাতন ও গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রবাদী মুখ। লোকমুখে সেই সংবাদ তাঁর সহকর্মীরা পেতেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। ওর সঙ্গে নানান উপলক্ষে খেজুরে আলাপ চালাতে থাকলেন তারা; বলার চেষ্টা করলেন কবে থেকে তারা বিজেপির হয়ে নীরবে নিভৃতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। চলতে থাকলো তার প্রতি অসংখ্য স্তুতি আর কথামালা। এদিকে ভোটের মাস দুয়েক পূর্বে দলবদলু তৃণমূলের বিধায়কেরা বিজেপিতে যোগদানের ফলে, সেই কেন্দ্র থেকে টিকিট পেলেন তৃণমূল-বদলু এক বিধায়ক। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কারণ দল কাকে টিকিট দেবে, সেটা দলই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ বিজেপিকে এবার জিততেই হবে রাজ্যে, অন্যায় অপশাসন দূর করতে হবে। রাজ্যে দু’শো আসনে জেতার পণ করেছেন কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। এদিকে সে টিকিট না পেতেই তাঁর সহকর্মীদের ধারণা হয়ে গেলো, দল তাকে আদৌ গুরুত্ব দেয় না, তার চারাআনা পয়সাও দাম নেই। তাই মিথ্যে এই ‘চাড্ডি’টাকে খাতির করে লাভ কী! দলবদলু সহকর্মীরা তাঁর প্রতি আবারও পূর্বমূর্তি ধারণ করলো। সহকর্মীদের পূর্ব আচরণ ফিরে এলো, যা সিপিএম এবং তৃণমূলের একছত্র শাসনে তাঁরা সেই রাষ্ট্রবাদীকে করেছিলেন। শুরু হল, তাঁকে নিয়ে নানান টোন-টিটকিরি। রাষ্ট্রবাদী অবিচলিত থাকলেন, কারণ তিনি এসবই আড়াই দশক ধরে সয়ে এসেছেন। বাম শাসনে বেনোজলদের কী গতি হয় তা নিয়ে কোনো কথা-সাহিত্য রচনা হয় নি বলে সাধারণ মানুষ জানতে পারছেন না।
সম্প্রতি সেই বিধানসভা ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মঞ্চে উপস্থিত রয়েছেন দলবদলু সেই বিধায়ক পদপ্রার্থীও। রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় নেতা। পরে সিপিএম-তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি হওয়া তাঁর সহকর্মী সরসে রাষ্ট্রবাদীকে বলছেন, “সেদিন অমিত শাহজীর পাশে আপনাকে মঞ্চে বসে থাকতে দেখলাম যে! বাহ্, বাহ্। শাহজী আপনার নাম ধরে সম্বোধন করলেন যে! বাহ্, বাহ্। প্রচার তো ভালোই চলছে!” তার বুঝতে অসুবিধে হল না, দলবদলুটি তাঁর ব্যজস্তুতি করছেন, তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-তামসা করছেন, মুখে মিষ্টি ছুরি মারছেন। কারণ সেদিন তিনি মঞ্চেও ডাক পান নি, তাঁর নাম ধরে অমিত শাহজী সম্বোধনও করেন নি। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে যাদের মঞ্চে বসার অধিকার, দল তাদেরকেই রেখেছে শুধু।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিগত একদশক ধরে দেখা গেছে, যারা অতীতে কট্টর বামপন্থী-বুদ্ধিজীবী ছিলেন এবং বিভিন্ন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে নানান পদে আসীন ছিলেন, গণেশ ওল্টানোর পর তৃণমূল হতে একরাতও দেরী করেন নি। কিন্তু মতাদর্শগত ভাবে যারা প্রথমাবধি বুক-চিতিয়ে লড়াই করেছেন, ক্ষমতাসীনদের দ্বারা প্রথমে বামপন্থায়, পরে তৃণমূলপন্থায় অত্যাচারের স্বীকার হয়েছেন। রাজ্যে এটা যে আকছার হয়েছে, সিপিএম কিংবা তৃণমূলের নেতারা কী তা জানেন না? নাকি, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বামবুদ্ধি-শক্তি তৃণমূলের হয়ে ভাড়া খেটেছেন? অন্তর্লীন যোগাযোগ তো ছিলই! তাই সারস্বত প্রতিষ্ঠানে ‘হাকিমও নড়ে নি, হুকুমও নড়ে নি’। বকলমে বামেরাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি করণগুলি চালিয়ে গেছে।
সিপিএম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় ক্ষমতা কায়েম রাখতে ব্যাপকহারে নিজেদের লোক বসিয়ে গেছে। মাছি গলবার সুযোগ ছিল না। এখনও অধিকাংশই তাদের নিযুক্ত লোক। রঙ পাল্টে, জামা পাল্টে চুপটি করে, ঘাপটি মেরে বসে আছেন; মতাদর্শ পাল্টান নি। বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারাই ফের জামা পাল্টানোর অপেক্ষায় আছেন, তাদের বুদ্ধিমানরা সুযোগ বুঝে কেউ কেউ আগেই জামা পাল্টে নিয়েছেন। এরাই হাওয়াই কল, এরাই আসলে হাওয়া মোরগ। ঝড় কোনদিক থেকে আসে বুঝতে পারেন। উচ্চ শিক্ষিত লোক মনে রাখতে হবে, ক্ষুরধার মেধা; বোকাসোকা রাজনীতিবিদদের এক হাটে কিনে আর হাটে বিক্রি করতে পারেন। অ্যাভারেজ রাজনীতিবিদদের সহজেই কিনে নেন তারা।
বিজেপির হাওয়া বুঝতে পেরে এদের ভেতরে-বাইরে তোলপাড় চলছে৷ যাদের এতদিন তারা ‘মূর্খ’, ‘চাড্ডি’, ‘গোবর-খেকো’ বলে সম্বোধন করেছেন, তাদেরই বুকে জড়িয়ে ধরার নাটক চলছে, কারণ কার কী ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, বুঝে উঠতে পারছেন না। এমনিতেই দলবদলে আসা আর পুরাত কর্মী — এদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। যখনই দেখছেন ‘চাড্ডি’ নয়, বরং দল বদলুদের কেউ কেউ সম্ভাবনাময়, তৎক্ষণাৎ ‘চাড্ডিদের’ অসম্মান করতেও ছাড়ছেন না। সাবাস! এই বাম বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। ক্ষমতার অলিন্দের স্বাদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা এই দুর্বুদ্ধিজীবীদের সহজ শিকার। তারা দলবদলু বুদ্ধিজীবীদের কনসার্ট-নীরে চিঁড়ে ভেজাবেন, নাকি অপাংক্তেয় হয়ে যাওয়া পুরাতনী রাষ্ট্রবাদীর মতাদর্শে আস্থা রাখবেন? তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে ক্ষমতার স্বাদের আসন্ন মরশুম, অন্য দিকে দীর্ঘচর্যিত মতাদর্শ! ট্রেন মিস হলে দল বদলুরাই বুদ্ধিজীবন চালাবে! মানব-বোতলের লেবেল সরিয়ে বামপন্থী চিন্তাচেতনার মদ, না কি বামজীবীদের সংস্কারসাধন — কোনটা? সনাতনী বঙ্গসমাজ এখন তাকিয়ে আছে আরএসএস-এর দিকে।