বঞ্চনা আর দীর্ঘশ্বাস সরিয়ে এ বার নিজভূমে ফিরতে পারবেন কি কাশ্মীরি পণ্ডিতরা

কাশ্মীর ভাল নেই এখন। কাশ্মীর হয়তো ভাল থাকতে পারে আগামীতে। কিন্তু এই ভাল-মন্দের দ্বন্দ্বে তাঁরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে? কেমন আছেন তাঁরা? কী ভাবছেন কাশ্মীরের এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে? তাঁরা কাশ্মীরি পণ্ডিত।

কয়েক শতাব্দী ধরে বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হয়ে এখনও রয়ে গিয়েছেন উপত্যকার নানা প্রান্তে।

ইতিহাস বলছে, কাশ্মীর মুসলিম শাসনাধীনে আসে ১৪ শতকে। মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান থেকে নৃশংস সেনাপতি দুলুচা ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে জোজিলা গিরিপথ দিয়ে এসে কাশ্মীর দখল করে নেন। শোনা যায়, দুলুচা তাঁর চলার পথে সমস্ত শহর, গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলে। সেই সময় থেকেই কাশ্মীরের হিন্দুদের সঙ্কট শুরু হয়।

তাঁর পরে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলামগ্রহনকারী রাজা রিনচিন কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হয়েছিলেন। এর পরে ক্ষমতায় আসেন শাহ মীর। কাশ্মীরের মুসলিম শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন ছিলেন সহনশীল, তেমনই অনেকে ছিলেন চরম অসহিষ্ণু। কাশ্মীরের সপ্তম মুসলিম শাসক সিকান্দার শাহ মিরি (১৩৮৯-১৪১৩) ছিলেন চরম অত্যাচারী। তিনি সমস্ত মন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলেন এবং হিন্দুধর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন উপত্যকায়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করতে শুরু করেন। তখনই কাশ্মীর থেকে পালাতে শুরু করেছিলেন হিন্দু ও অন্য ধর্মের মানুষজন। অনেকে আত্মহত্যাও করেন। এঁদের মধ্যে সংখ্যায় অনেকটাই বেশি ছিলেন কাশ্মীরি হিন্দুরা, যাঁরা কাশ্মীরি পণ্ডিত বলে পরিচিত।

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এই উপত্যকা ছেড়ে চলে যাওয়া বা চলে যেতে বাধ্য করার ধারা কিন্তু বন্ধ হয়নি তার পরেও। অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে অপমানিত ও অত্যাচারিত হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। সে ইতিহাস দীর্ঘ।

কিন্তু এখন, দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে উপত্যকা থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের প্রভাব তাঁদের উপরেও কম পড়েনি। অশান্ত কাশ্মীরে তাঁরা আরও সিঁটিয়ে রয়েছেন। যে কয়েক জন কাশ্মীরি পণ্ডিত থেকে গিয়েছিলেন উপত্যকায়, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

ইতিহাস বলছে, ১৮১৯ সালে লাহোরের শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিং ফের কাশ্মীর দখল করেন। তাঁর শাসনকালে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়, আজান দেওয়ায় বাধা দেওয়া হয়। মাদ্রাসাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরে মহারাজা গুলাব সিং, রণবীর সিং, প্রতাপ সিং হয়ে ১৯২৫ সালে ক্ষমতায় বসেন হরি সিং। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাশ্মীরের রাজা মহারাজ হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়েছিলেন। তা মনোমতো না হওয়ায়, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় কাশ্মীর। বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তরফে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর চাপ দেওয়া হয় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার। তাঁরা সম্মত না হতেই শুরু হয় হিংসা। অভিযোগ, এই সময় থেকেই মেরে ফেলা হয় বহু কাশ্মীরি পণ্ডিতকে। প্রাণভয়ে উপত্যকা ছেড়ে পালান তাঁরা। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৫ লক্ষ। জম্মু, দিল্লি, পঞ্জাব– বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন তাঁরা।

তিন দশক পেরিয়ে গেছে। ফের নতুন অশান্তিতে জর্জরিত উপত্যকা। কিন্তু তাঁদের অশান্তি বোধহয় কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের থেকেও খানিক বেশি। কথা হচ্ছিল তেজকিষণ সিংয়ের সঙ্গে। কাশ্মীর সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের কর্মী তিনি। জানালেন, ১৯৯০ সালে তিনি ১৭ বছরের কিশোর। সে সময়ের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায়। উগ্রপন্থা আর ধর্মীয় মৌলবাদ যে কতটা ক্ষতিকর, তা ওই বয়সেই বুঝে গিয়েছিলেন তেজকিষণ।

তবে মাটির প্রতি টান ছিল তাঁর প্রবল। তাই ১৯৯০ সালে সপরিবার জম্মু চলে গেলেও, পরে ২০০৫ সালে আবারও ফিরে আসেন। ততদিনে বিয়েও করেছেন তেজকিসেন। রয়েছে দেড় বছরের বাচ্চা। শ্রীনগর শহরের কাছেই ছোট একটা বাড়ি করেন নিজে। বাড়ির চারপাশে ফুলের বাগান। স্বপ্নের মতো। তবে ভাবতেও পারেননি, সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।

তেজকিষণের অভিযোগ, প্রায় নিত্য দিন স্থানীয় মানুষদের তরফে নানারকম উৎপাত শুরু হয়। কেউ এসে দাবি করেন, যে জমিতে তিনি বাড়ি করেছেন, সে জমির কাগজপত্রে সমস্যা রয়েছে। কেউ আবার তাঁর চাকরির জায়গায় বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়াতে শুরু করে। সব মিলিয়ে দিশাহারা হয়ে যান তিনি। ফের ছাড়তে হয় নিজের মাটি। দ্বিতীয় বারের জন্য।

“এখন চাকরির কাজে আমায় শ্রীনগরে থাকতে হয় ছ’মাস। আমি এসে হোটেলে উঠি। ভাড়া দিয়ে থাকি। পাশেই পড়ে আমার নিজের বাড়ি। যাওয়া-আসার পথে দু’বেলা দেখতে পাই। অযত্নে, অবহেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে। অথচ আমি থাকতে পারি না। এ যে কী যন্ত্রণা!”– বলছিলেন তেজকিষণ। কারা তৈরি করছে এমন সমস্যা?

তেজকিষণের সংক্ষিপ্ত উত্তর, “ওরা।”

মাঝে মাঝে বাড়িটি বেচে দেওয়ার কথাও ভাবেন তেজকিষণ। কিন্তু আবার নিজেই দাঁতে দাঁত চেপে ঠিক করেন, “কেন বেচব? থাক এটুকু। কোনও দিন যদি অবস্থা পাল্টায়, নিজের মাটিতেই ফিরব আমি।”

কাশ্মীরের অবন্তীপোরা বা অবন্তীপুর এলাকায় একটি শতাব্দীপ্রাচীন বিষ্ণু মন্দির রয়েছে। তার আশপাশে বেশ কয়েকটি কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের বাস ছিল এতদিন। কিন্তু গিয়ে জানা গেল, একটি মানুষও আর নেই। অগস্ট মাসের সমস্যা শুরুর পর থেকেই একে একে ঘর ছেড়েছেন তাঁরা। কেউ চলে গেছেন আত্মীয়ের বাড়ি, কেউ জম্মুতে, কেউ বা অন্য কোনও রাজ্যে। এমনকি মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন যে পঞ্জাবি মানুষটি, তিনিও অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি নিয়ে চলে গেছেন নিজের রাজ্যে।

এসব ঘটনার কোনও শেষ নেই কাশ্মীর জুড়ে। ফলে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অনেকেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ঘোষণায় খুশিই হয়েছেন। যদিও উপত্যকার আনাচকানাচে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের খোঁজ করতে গেলে হাতেগোনা কয়েক জন মানুষকেই পাওয়া যায়। ৩৭০ নিয়ে সমস্যা শুরু হওয়ার পরে সে সংখ্যা শূন্যগামী।

কিন্তু এসবের মধ্যেই রয়েছেন শ্রীনগরের মন্দারবাগ কলোনি এলাকার মতিলাল ধর। গোটা এলাকায় একমাত্র কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার। মুসলিম পড়শিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কিন্তু বহু বছর ধরেই খুব পোক্ত। ৩৭০ পরবর্তী অধ্যায়েও তাতে চিড় ধরেনি।

সন্ত্রাসবাদীদের নানা কার্যকলাপের সাক্ষী মন্দারবাগে কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব ভাল আছেন এমনটা বলা যায় না। প্রায়ই নানা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা এবং সেনা সংঘর্ষের মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের। বছর পঁয়ষট্টির মতিলালও ব্যতিক্রম নন। সেসবের মধ্যেই শিক্ষকতা করেছেন স্থানীয় স্কুলে। বড় করেছেন একমাত্র মেয়েকে।

তাঁর কথায়, “সমস্যায় বারবার পড়েছি। হুমকি, ভয় দেখানো, উপদ্রব একসময়ের নিত্যসঙ্গী ছিল। কিন্তু আমার পড়শিরাই সব সময়ে সাহায্য করেছেন, পাশে থেকেছেন। ওঁরাও তো মুসলিম। অথচ ওঁদের জন্যই এখনও চলে যেতে হয়নি নিজের জায়গা ছেড়ে।”

বরং এই যে দু ‘মাসেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরে সব অবরুদ্ধ, খেটে খাওয়া মানুষ বেরোজগেরে, যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক নয়– এসব নিয়ে খুবই চিন্তিত তিনি। সাধারণ মানুষের অসহায়তা তিনি অনুভব করেন অনেক বেশি করে। হবে না-ই বা কেন। ২০১৪ সালের বন্যায় ঘরদোর সব ভেসে গিয়েছিল মতিলালের। কপর্দকশূন্য অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগেই তাঁকে তৈরি করে দেওয়া হয় বাড়ি। কারণ তিনি এলাকার ‘মাস্টারমশাই’। এই পরিচয়ে চিরকাল বেঁচেছেন সসম্মানে।

কিন্তু মতিলালের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বোধ হয় তেজকিষণের আজীবনের দুঃসহ স্মৃতি ম্লান করতে পারে না। তার চেয়েও বড় কথা, কাশ্মীর জুড়ে তেজকিষণদের সংখ্যাই বেশি। অপমান, আক্রমণ, বঞ্চনা যাঁদের দীর্ঘদিনের নিত্যসঙ্গী।

মতিলালের অভিজ্ঞতা শুনে মনে হয়, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। কাশ্মীরের যে বৈশিষ্ট্য, তার যে ‘কাশ্মীরিয়ৎ’-এর অহঙ্কার, তাতে তো মতিলালদের সংখ্যাই অনেক বেশি হতে পারত উপত্যকা জুড়ে। যদিও, তেজকিষণদের দীর্ঘশ্বাস, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ভাঙাচোরা বাড়িঘর– এসব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.