সমসাময়িক ফরাসী অফিসারের চোখে টিপু সুলতান

১৯৮৮ সালের আট ডিসেম্বর। এলাঁ ত্রেত্যাঁভিল নাম্নী ৯১ বছর বয়স্কা এক বৃদ্ধার মৃত্যুর পর, প্যারিসে তাঁর ফ্ল্যাটের চিলেকোঠার ঘর থেকে একটি পুরনো ট্রাঙ্ক উদ্ধার করা হয়। সেই ট্রাঙ্কের মধ্যে থেকে, অন্যান্য পুরোনো জিনিসের সঙ্গে উদ্ধার করা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসীতে লেখা এক পান্ডুলিপি, লেখক ফ্রাঁসোয়া রিপো। পান্ডুলিপির শুরুতেই লেখা “আমি ফ্রাঁসোয়া রিপো, বর্তমানে বৃদ্ধ। আমি তোমাদের টিপু সুলতানের আসল রূপ দেখাতে চাই”।

ফ্রাঁসোয়া রিপোর জন্ম উত্তর ফ্রান্সের সাফ্রে শহরে, কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের আশায় মাত্র এগারো বছর বয়সে ফরাসী জাহাজ ” লা পামিয়ে ” তে যোগ দেন, বয়সকালে মরিশাসে থিতু হন, বিয়ে করেন, দুটো বাচ্চাও হয়।অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মরিশাস তখন ফরাসী উপনিবেশ।

মরিশাসে থাকাকালীনই উনি টিপু সুলতানের নামের সঙ্গে পরিচিত হন। ম্যাঙ্গালোরে এসে টিপুর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাব দেন তিনি মরিশাসে টিপুর জন্য এক সেনাবাহিনী গঠন করতে চান। টিপু তো মহাখুশি। এর আগেই টিপুর সঙ্গে ফরাসীদের যোগাযোগ ছিল। দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশদের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল ফরাসীরা। টিপুর সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দিতেন ফরাসী অফিসারেরা।

টিপু সুলতানের আগ্রহ দেখে রিপো মরিশাস ফিরে যান। ইতিমধ্যে নেপোলিয়ন মিশর দখল করে ভারত অভিযানের স্বপ্ন দেখছেন। নেপোলিয়নের আদেশে মরিশাসের ফরাসী গভর্নর রিপোকে সবরকমভাবে সাহায্য করেন। রিপো এক জাহাজ ভর্তি ফরাসী সৈন্য নিয়ে ম্যাঙ্গালোরে ফিরে আসেন।

তথ্যসূত্র :https://www.outlookindia.com/magazine/story/the-tyrant-diaries/284803

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কতগুলো ব্যাপার রিপোর নজরে আসে। ১৪ই জানুয়ারি, ১৭৯৯ সালে রিপো লিখেছেন ” নিরীহ হিন্দুদের প্রতি টিপুর ব্যবহার দেখে আমি বিচলিত। টিপুর সেনারা প্রতিদিন ম্যাঙ্গালোরের রাজা জামোরিনের দুর্গের সামনে নিরীহ ব্রাহ্মণদের ছিন্নমূন্ড সাজিয়ে রাখে।”
রিপো তবুও টিপুকে সাহায্য করা বন্ধ করেন নি। ১৭৯৯ সালে শ্রীরঙ্গপত্তনমে ফরাসী সেনাদের জন্য একটি জ্যাকোবিন ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন।
কিন্তু অচিরেই মোহভঙ্গ হয়। টিপুর কালিকট দখলের বর্ণনা দিচ্ছেন রিপো। ” বেশিরভাগ হিন্দু নারী ও পুরুষকে ফাঁসীতে ঝোলানো হয়। এমনকি মা এবং শিশুদের একসঙ্গে ফাঁসী দেওয়া হয়। এই বর্বর টিপু হিন্দু আর খ্রিস্টানদের নগ্ন করে শিকলে বেঁধে হাতির পায়ের তলায় ফেলে দেয় যতক্ষণ না তারা মাংসপিণ্ডতে পরিণত হচ্ছে। মন্দির আর চার্চে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরিত করে মুসলমান পুরুষদের সঙ্গে এবং পুরুষদের ধর্মান্তরিত করে মুসলমান মহিলাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। ” অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত পর্তুগিজ পর্যটক ফাদার বার্থালোমিউর ভ্রমণকাহিনীতেও একই বর্ণনা পাওয়া যায়।
রিপো আর একটি ডাইরীতে লিখেছেন ” জেহাদের জন্য টিপু বিশেষ করে বেছে নিয়েছিলেন কোঝিকোড (কালিকট) শহরকে। কোঝিকোডে সেই সময় সাত হাজার ব্রাহ্মণ পরিবার থাকত। টিপুর ইসলামিক নিষ্ঠুরতার ফলে ২০০০ পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। নারী এবং শিশুরাও রক্ষা পায় নি। “
বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ রিপো ফ্রান্সে ফিরে যাওয়া মনস্থ করেন। সেখানে তিনি স্যাফো নামে একটি ফরাসী যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেনের পদ লাভ করেন। ১৮১৪ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় একটি কামানের গোলার আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। এমনকি ব্রিটিশ সৈন্যরাও তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ ছিল, তারা একুশবার তোপধ্বনি করে তাঁকে সন্মান জানায়।
আমাদের প্রগতিশীল ঐতিহাসিকেরা লিখেছেন টিপু ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। “সোর্ড অফ টিপু সুলতান” সিরিয়ালেও তাই দেখানো হয়েছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে টিপু যুদ্ধ করেছিলেন মূলত তাঁর সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য। কিন্তু এইসব প্রগতিশীল ঐতিহাসিকেরা সযত্নে টিপুর তীব্র হিন্দু বিদ্বেষী জেহাদী রূপ আমাদের থেকে আড়াল করে গিয়েছেন, যা সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার দেশের বহু যুদ্ধে পোড় খাওয়া এক বীর সৈনিকের নজর এড়াতে পারেনি।

https://magazine.outlookindia.com/story/the-tyrant-diaries/284803

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.