হেরে যাওয়ার ভয়ে ভীত মানুষকে লক্ষ্য করে স্বামী বিবেকানন্দ একটা কথা প্রায়শই বলতেন— তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি তো ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই জিতে বসে আছ। কারণ তোমাকে মাতৃজঠরে প্রবেশ করতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি শুক্রাণুর সঙ্গে লড়াই করে।
ঠিক এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের আসমুদ্র হিমাচল যখন ভোটবাজারে বিরোধীদের রণহুংকারে কম্পমান, তখন স্বামীজীর এই অতি বাস্তব বক্তব্যটির অনুরণন করে বলাই যেতে পারে বিজেপি ইতিমধ্যেই জিতে বসে আছে। কারণ এবার ভোটে বিরোধীদের মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে ততটা নয়, যতটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর সঙ্গে। ফলত হেরে বসে আছে বিরোধী সব শক্তিই। কারণ তারা প্রত্যেকেই মুখে স্বীকার না করলেও হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, মোদীর শক্তির কাছে তাদের সম্মিলিত শক্তি তুচ্ছাতিতুচ্ছ। ফলত এবারের লোকসভা ভোট বিরোধীরা ‘মোদীর এক্সপায়ারি ডেট এসে গিয়েছে ‘ বলে যতই চিৎকার করুন না কেন— ভোটের মূল গতিমুখ কিন্তু বিরোধী বনাম মোদী, আর সেটাই এবারের ভোটের মূল বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন হলো, দল ছেড়ে বিরোধীদের লক্ষ্য মোদী কেন ? কেন তাদের মুখে একটাই স্লোগান ‘মোদী হঠাও দেশ বাঁচাও’। কেন তারা যত ‘দুর্নীতির দায়’ চাপাচ্ছেন মোদীর ওপর? কেনই বা দলীয় রাজনীতির অঙ্ক শিকেয় তুলে বিরোধীরা সমস্বরে মোদীর বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগে কোনো সীমাবদ্ধতা মানছেন না?
কারণটা পরিষ্কার। বিরোধীরা জানেন, অটলবিহারী বাজপেয়ী যেমন ছিলেন বিজেপির একটি স্তম্ভ, ভারতীয় রাজনীতির নয়া জমানায় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীও তেমনি একটি স্তম্ভ যিনি দেশ গড়তে জানেন। যিনি তোষণের রাজনীতি থেকে অনেক দূরে থেকে ভারতীয়দের ভারতীয়ত্বের ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ করতে জানেন। যিনি প্রয়োজনে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অস্ত্রপ্রয়োগ করতে জানেন। যিনি জানেন, ভারতের উন্নয়নে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন। ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ বলে ‘স্বৈরাচারী মোদী’র বিরুদ্ধে বিরোধীরা যতই অস্ত্র শানান না কেন, তারা জানেন, মোদীর অস্ত্র তাঁর ব্যক্তিগত সততা আর তার মগজাস্ত্র যা চাণক্যের মতো ধারালো। অতএব একের বিরুদ্ধে একশো হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা, অখিলেশ-মায়াবতী, তেজস্বী-নাইডু এবং অবশ্যই ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বিকৃত মস্তিষ্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু এরা কি বিজেপি বিরোধী নয়?
এবারের ভোটে রাজনীতির অঙ্কের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, উত্তরটা হবে, যতটা বিরোধী হওয়ার দরকার ততটা নয়। কারণ বিরোধীদের কেউ জানে না, ২৩ মে লোকসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর কোন বিরোধী দলকে হাত ধরতে হবে বিজেপির শুধু রাজনীতির ময়দানে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। সামান্য ব্যতিক্রম অবশ্যই কংগ্রেস। কারণ সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস এখনও বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ এবং অবশ্যই কিছুটা শক্তিধরও। কংগ্রেস তাই অতি প্রয়োজনেও বিজেপির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে না কেবল রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার নিরিখেই। কিন্তু বাকিরা? তাঁদের বাঁচতে হবে বিজেপির হাতে হাত মিলিয়েই। ‘হয় মিলমিশ নয় ফিনিশ’-এ স্লোগানটাই হবে তাদের ভরসা ২৩ মে-র পরে। অতএব বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব কমাও। মোদীকে একঘরে করে দাও। এবারের মহারণে বিরোধীদের সেটাই স্ট্রাটেজি। তাই সকলের তিরের লক্ষ্য একজনই— ব্যক্তি মোদীজী।
কিন্তু এ কৌশল কতখানি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে? মোদী ক্ষমতায় এসেছেন মাত্র পাঁচ বছর। এরমধ্যে তিনি তীব্র বিরোধিতার পরোয়া না করেই এমন কতকগুলি সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করেছেন, যা গত দশ বছর ধরে চেষ্টা করেও রূপায়ণ করতে পারেননি সোনিয়া গান্ধী পরিচালিত অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ। যেমন জিএসটি বলবৎকরণ, পুরনো নোট বাতিল রাতারাতি, কংগ্রেস আমলের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার ব্যাঙ্ক প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, মুসলমান সমাজ থেকে তিন তালাক প্রথার অবসানে ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি। প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল বিরোধীদের কাছে সাপের ছোবলের মতো, কারণ এই প্রতিটি পদক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষের বুকে হাঁটু গেড়ে বসা দুর্নীতির অবসানে এক একটি চপেটাঘাত। পুরনো নোট বাতিল করায় বিরোধী দলগুলির কোটি কোটি কালো টাকার রমরমা এক রাতেই খতম। জিএসটি বলবৎ ছিল বিরোধীদের পোষ্য ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকির চেষ্টার শিকড়ে কুঠারাঘাত। ব্যাঙ্কে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ প্রতারণার ফাইল ফাঁস করে দিল যে সব কটি দুর্নীতিই হয়েছে কংগ্রেস আমলে। একটার পর একটা। বোফর্সের দায়ে অভিযুক্ত, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত, সরকারি কোষাগার ভেঙে ব্যক্তি প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত, চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বিরোধী দলগুলির নেতানেত্রীরা প্রমাদ গুণলেন। অতএব অভিযোগ উঠল রাফাল চুক্তি নিয়ে। সেটা যখন প্রায় ভুল প্রমাণ হতে চলেছে, তখন আর বিরোধীরা মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ, ভারতীয়ত্ব, হিন্দুত্ববোধ জলাঞ্জলি দিয়ে বিরোধীরা প্রকারান্তরে পাক-সন্ত্রাসবাদকেই সমর্থন করে বসলেন সমস্বরে এবং যে সেনাবাহিনী জীবন বিপন্ন করে দেশ রক্ষার কাজে রত, তাদের অপমান করে বসলেন। ফলত বিরোধীদের কৌশল বুমেরাং হয়ে ফিরে গেল তাদের দিকেই। তার চেয়ে বড়ো ভুলটা ছিল— মোদীর বিরুদ্ধে অনুন্নয়নের অভিযোগ তুলে বিরোধীদের আস্ফালন। এই আস্ফালন যত তীব্র হয়েছে, ততই মানুষের কণ্ঠস্বর প্রবল হয়েছে। কারণ মানুষ দেখেছে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ভারতের প্রথম সফল বিজেপি সরকারই গড়েছিল দেশের চার বৃহৎ নগরীর মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী স্বপ্নের সোনালি চতুর্ভুজ সড়ক পরিকল্পনা। আর এবার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে আর এক বিজেপি সরকার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন শতাধিক প্রকল্প- যা সামগ্রিকভাবে প্রকৃত অর্থে উন্নয়নের শরিক হয়ে উঠেছে গোটা দেশ জুড়ে। গরিব মায়েরা পেয়েছেন সম্মান, গরিব মেয়েরা পেয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। গরিব বৃদ্ধরা পেয়েছেন বেঁচে থাকার রসদ আর তরুণেরা পেয়েছেন স্বনির্ভরতার অস্ত্র। এভাবে এর আগে ‘উন্নয়ন’-এর অর্থটাকে অর্থনীতির পরিভাষায় কোনও বিরোধী দল স্থায়িত্ব দিতে পারেনি। তারা শুধু উপঢৌকনের অর্থনীতি কায়েম করে গরিবকে, বেকারকে, বৃদ্ধদের ভিখারি বানিয়েছে, হাত পেতে দান নিতে শিখিয়েছে। আর নিজেদের ভোটবাক্স ভরিয়েছে তাদের সমর্থনে। মানুষকে মানুষ হওয়ার মন্ত্র শেখায়নি। কারণ তারা নিজেরাও সে মন্ত্র শেখেনি।
আরও আছে। একের পর এক নিজেদের তৈরি কৌশলে বিরোধীরা নিজেরাই ফাঁদবন্দি হয়েছে। মোদী সাম্প্রদায়িক, মোদী মুসলমান বিরোধী, মোদী দেশ ভাগ করতে চাইছেন—বিরোধীদের এই অভিযোগ যখন তুঙ্গে তখনই তিন তালাক প্রথা রদে বিল এনে মোদী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ধর্মীয় মতে অসহিষ্ণু নয়। তিনি সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদী। বরং বিরোধীরাই যে সাম্প্রদায়িক তার প্রমাণ দিলেন বিরোধীরাই যখন প্রকাশ্যে রাজ্যসভার অধিবেশনে কংগ্রেস-সহ অধিকাংশ প্রকাশ্যে ওই বিলের বিরোধিতা করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, শুধু সামাজিক ফর্মুলাতেই নয়, রাজনীতির কৌশলে মোদীর কাছে এঁরা সকলেই শিশু।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও ঘটল প্রায় একইরকম ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী পদে বসার পর থেকেই মোদীর ঘনঘন বিদেশ ভ্রমণ, রাজকোষের কোটি কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীরা চাবুক হেনেছেন বারে বারে। মোদী সে আঘাত শতগুণে ফিরিয়ে দিয়েছেন পুলওয়ামা বিস্ফোরণে ৪০ জন ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যুর পর যখন পাক সরকার এবং পাকসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রায় গোটা পৃথিবীই মোদীর পাশে এসে দাঁড়াল। সমস্ত বিশ্বের নেতৃত্ব সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং পাকিস্তানকে প্রায় কোণঠাসা করে দিলেন। বিরোধীরা এবারও কুপোকাত। তবু ওই যে বলে, ভাঙব তবু মচকাব না। তাই শবরীমালা মন্দির ইস্যুতে আয়াপ্পান গোষ্ঠীর চরম বিরোধিতার মুখে বিরোধী দলগুলি। বলা যায় না, এবার হয়তো কেরলও হয়ে উঠবে গেরুয়া। কর্ণাটকে জনতা দল ইউনাইটেড আর কংগ্রেস সরকার গড়লেও নিত্যনতুন নাটকের অবতারণা হচ্ছে প্রতিদিন। তিতিবিরক্ত মানুষ জবাব দেবেনই। রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে বিরোধীদের লপড়-চপড় বন্ধ। কারণ মোদী নিজে ব্যক্তিগত ভাবে রামমন্দির নিয়ে হৈচৈ কখনও করেননি। বরং রামমন্দিরকে ইস্যু না করেই পাকিস্তানে বার বার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাম ছিলেন, আছেন, থাকবেন ততদিন যতদিন রামায়ণ মহাকাব্য হয়ে থাকবে। কিন্তু পাক-সন্ত্রাসের সঠিক জবাবও ভারতীয়ত্বের জাগরণ ঘটাতে পারে তা বিরোধীদের পছন্দ হোক আর নাই হোক। ভারতীয়দের নিজস্ব সংস্কৃতিকে দীক্ষিত করা, তাঁদের নিজস্ব ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াটা সংকীর্ণ রাজনীতি তো নয়ই, সাম্প্রদায়িকতাও নয়।
এর ওপর বিরোধীরা নিজেদের মুখে কালি মেখেছেন নিজেরাই নাগরিক পঞ্জীকরণে মোদীর ব্যবস্থাপনার বিরোধিতা করে। নাগরিক পঞ্জীকরণ ইস্যুতে বিরোধীরা ভেবেছিলেন, মোদীকে ঘায়েল করার একটা অস্ত্র পাওয়া গেল। কিন্তু তখনও বোঝেননি, তাদের অস্ত্রে ঘায়েল হবেন তারাই। কারণ নাগরিক পঞ্জীকরণ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের বিরুদ্ধেও নয়। এই ব্যবস্থার রূপায়ণ প্রয়োজন বেআইনি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যারা পাকিস্তানের উস্কানিতে ভারতজুড়ে সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করছে। সন্ত্রাসবাদের কোনও জাত থাকে না, ধর্ম থাকে না সেটা না বুঝে মোদী-বিরোধী স্লোগান তুলে বিরোধীরা নিজেদের মুখোশটাকে খুলে ফেলেছেন।
ভাববার সময় এসেছে। ভারতবর্ষের উন্নয়নে এখন প্রয়োজন। নীতির রাজার আর সেই রাজার, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে যিনি ব্যক্তির স্বার্থ ভুলে নীতির বদল ঘটাবেন। দল নয়, পশুশক্তির বল নয়, দলদাস নয়, বলদ নয়, দরকার মনুষ্যশক্তির পূর্ণ উন্মোচন। আর তা সম্ভব এক দল এক নেতার দ্বারাই। অন্যসব ঝাঁকের কই ঝাঁকেই মিশে যাবে। মনুষ্যশক্তির স্ফুরণ থেকে যাবে কল্পনাই।

সনাতন রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.