সেই একই অজুহাত? করোনার ‘ক্ষতি’ পোষাতে ডাল, তেলের মতো দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা?

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির পিছনে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বললেও তা ধোপে টেকে না। শেষপর্যন্ত তাঁরা বলেছেন, ‘করোনায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন তা না পুষিয়ে নিলে কীভাবে হবে?’

উদাহরণ হিসেবে ভোজ্য তেলের কথাই ধরা যাক। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪২-৪৯ শতাংশ। খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের (খোলা) লিটার এখন ১৬০ টাকা। চলতি বছরে দফায় দফায় দাম বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিয়ে। তাই কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেন৷ তাঁর মতে, এখন বাজারে যে ভোজ্য তেল আছে, তা তিন মাস আগে আমদানি করা। তাহলে এখন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে কেন সয়াবিনের দাম কেন বাড়ানো হবে? জবাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘আমরা করোনায় অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছি। সেই ক্ষতি তো পোষাতে হবে। ক্ষতি না পেষালে আমরা টিকব কীভাবে?’ট্রেন্ডিং স্টোরিজ

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ৬.৭৮ শতাংশ, আটা ১৩.৫ শতাংশ, ময়দা ৩০ শতাংশ, সয়াবিন ৪৯ শতাংশ, পাম ৫২ শতাংশ, চিনি ২৬ শতাংশ, মুসুর ডাল ২৯ শতাংশ, রসুন ৪১ শতাংশ, পেঁয়াজ ৪২ শতাংশ।বাজারে এখন মিনিকেট কেজি ৭৫ টাকা, মোটা চাল ৫৪, আটা ৪০, ময়দা ৪৫ , মুসুর ডাল (দেশি) ১৪০, পেঁয়াজ ৯০, সয়াবিন(খোলা) ১৬০ টাকা।

ক্যাব-এর দেওয়া ২০১৯ এবং ২০২০ সালের বাজার দর মেলালে দেখা যায়, ২০১৯ সালে মিনিকেট চালের কেজি ছিল ৫৪ টাকা  এবং ২০২০ সালে ৬২ টাকা। মোটা চাল ২০১৯ সালে ৪০ টাকা, ২০২০ সালে ৪৮ টাকা। মুসুর ডাল ২০১৯ সালে ৯৯ টাকা, ২০২০ সালে ১২৮ টাকা। ২০১৯ সালে পেঁয়াজ (দেশি) ৮৮ টাকা, ২০২০ সালে ১০০ টাকা। ২০১৯ সালে সয়াবিনের দাম ছিল ৮৮ টাকা, ২০২০ সালে ১০১ টাকা লিটার।

এদিকে টিসিবি যে বাজর দর প্রকাশ করে তার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। টিসিবি ১১ অক্টোবরের যে বাজার দর দিয়েছে তাতে বাজারে এখন মিনিকেট( সরু চাল) কেজি ৫৫.৬৬ টাকা, মোটা চাল ৪৫, আটা ৩৩.৩৫, ময়দা ৪৩.৩৫ , মশুর ডাল ১৪০, পেঁয়াজ ৭০, সয়াবিন ১৩৫ টাকা। তাদের হিসাবে অধিকাংশ ভোগ্য পণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে। বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০০ শতাংশ বেড়েছে। ৪৫ টাকার পেঁয়াজ এখন ৯০ টাকা।

এসএম নাজের হোসেনের কথা, পেঁয়াজ আমদানি ভারত থেকে বন্ধ হয়নি। পুজোর সময় শুধুমাত্র কয়েকদিন বন্ধ থাকবে। তাহলে দেশি পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ল? দেশে তো পেঁয়াজের কমতি নেই। এখানে সিন্ডিকেট স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘দেশে চিনি আমদানি করে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান, ভোজ্য তেল আমাদানি করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। চাল জিম্মি চালকল মালিকদের হাতে। ফলে তাঁরা যেভাবে দাম নির্ধারণ করেন, সেভাবেই করছেন। আর তাঁদের দেখাদেখি সবজি , মাছ , মাংসের দামও বেড়ে যায়। তাঁরা মনে করেন, তাঁরা যখন বাড়াচ্ছেন আমরাও একটু বাড়িয়ে দিই।’

ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সিন্ডিকেট ও চেন রিঅ্যাকশনের কথা জানান সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘ভোজ্যতেল-সহ আরও কিছু পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেন। প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম বাড়ে তার তুলনায় তারা বেশি বাড়িয়ে দেয়। আবার ধরেন, এখন দাম বাড়লে তাঁরা এর সুযোগ নিতে আগে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এইসব পণ্যের আমদানি নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তাঁরা এটা করতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘এর ফলে যা হয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের উপর প্রভাব পড়ে। দুই ধরনের পণ্য আছে। পচনশীল যেমন – শাকসবজি, মাছ আর কিছু আছে পচনশীল নয়। এই দুই ধরনের পণ্যের দামই বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ তাদেরও তো আমদানি করা ভোগ্যপণ্য কিনে খেতে হয়। আর সবাই দাম বাড়িয়ে ব্যবসা করলে তারা করবে না কেন?’

আর করোনার পর মানুষের ভোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে চাহিদা বেড়েছে তাতেও কিছুটা দামের উপর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু সেটা মূল কারণ নয় বলে মনে করেন তিনি। তবে ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা দাবি করেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ভোজ্য তেল, চিনির দাম এখানে ঠিক করা হচ্ছে। সরকার ট্যাক্স বেশি নেয়, ট্যাক্স কমালে দাম কমবে। ব্রাজিলের চিনির দাম বাড়লে এখানেও বাড়বে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আজকের (সোমবার) বৈঠকে আমরা বলেছি তাদের অনুসন্ধান করে দেখতে যে আমরা দাম বেশি নিচ্ছি কী না।’ তাঁর দাবি, পেঁয়াজের দাম তাঁরা ৫৫ টাকা নিচ্ছেন। কিন্তু অলিগলির দোকানে বেশি নিলে তাদের কিছু করার নেই। আর শাক সবজির দাম বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শীতকালে আম খেতে চাইলে দাম তো বেশি দিতেই হবে। সামনে শীত আসছে তখন শাক-সবজির দাম কমে যাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.