জঙ্গি হামলায় হাঁটু ভেঙে ওই যে বসে আছে আমার দেশ!

উপরের ছবিটি দেখুন! স্বামীর বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে আছেন স্ত্রী। অসহায়। নাচার। হতবাক। নতমুখ। দুর্ভাগ্যের হাতে সমর্পিত।

কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বৈসরন উপত্যকার ছবিটা যে কত কত বার দেখলাম! তরুণীর নাম এত দিনে সকলে জেনে গিয়েছেন— হিমাংশী নারওয়াল। যে নিষ্প্রাণ দেহের সামনে তিনি বসেছিলেন হাঁটু ভেঙে নিথর হয়ে, সেটি তাঁর সদ্যবিবাহিত স্বামী ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের। দিন আষ্টেক আগে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। ইউরোপের কোনও দেশের ভিসা না পেয়ে মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। সোমবার পৌঁছে পহেলগাঁওয়ের একটি হোটেলে উঠেছিলেন নবদম্পতি। মঙ্গলে লাশ হয়ে গেলেন বিনয়। ভিন্‌রাজ্যের এক উপত্যকায় একলা হয়ে রয়ে গেলেন হিমাংশী।

চারদিকে উঁচু উঁচু পাইন গাছের সারি। তার মধ্যিখানে একফালি চটা-ওঠা জমি। সেই জমিতে তিনটে চরিত্র। বিনয়, হিমাংশী আর একটা ট্যুরিস্ট ব্যাগ। বিনয়ের সঙ্গে সেই ঘাসহীন জমিতে পড়ে-থাকা ব্যাগটার কোনও তফাত ছিল কি? নাহ্, ছিল না। দু’টিই প্রাণহীন। তৃতীয় চরিত্র, হিমাংশীকেও নিষ্প্রাণ মূর্তির মতোই লাগছিল। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ওই ফ্রেমের কোথাও কোনও প্রাণের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। সময় থমকে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা আর এগোবে না।

অদূরে একটা লাল ফাইবারের চেয়ার। তার আশপাশে তিন পাটি চপ্পল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দ্রুত পলায়নপর কারও পা থেকে খসে পড়ে যেমন পিছনে থেকে যায়। কিছু দূরে দুটো হলদে রঙের তাঁবু। সেই তাঁবুর সামনে খুদে হয়ে আসা দু’-তিনটে চেহারা। তারও পরে পাইনের জঙ্গল। যার উপরে দুপুরের রোদ্দুর ঝকমক করছে। তারও ও পারে পর্বতমালা। তার উপরে আদিগন্ত নীল আকাশ দুপুরের রোদে ঝলসাচ্ছে।

এই পহেলগাঁও দেখতে দেখতে বত্রিশ বছর আগের পহেলগাঁও মনে পড়ছিল। আনন্দবাজারে চাকরি পেয়েছি তার তিন বছর আগে। এক বছরের শিক্ষানবিশি কাটিয়ে বছর দুয়েক আগে পাকা চাকরি হয়েছে। ১৯৯৩ সালে সেই আমাকে পাঠানো হল অমরনাথ যাত্রা কভার করতে। তখন কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ তুঙ্গে। কালীপটকার মতো গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। প্রায়দিনই ফৌজিদের সঙ্গে জঙ্গিদের গুলির লড়াই। এখানে-ওখানে লাশ পড়ে। তবে খুব বড় কিছু না হলে কাগজের প্রথম পাতার খবর আর হয় না। সেই আবহে হুঁশিয়ারি ভেসে এসেছিল ‘লশকর-এ-ত্যায়বা’র। অমরনাথ যাত্রায় হামলা করবে তারা। সঙ্গে আরও এক জেহাদি সংগঠন ‘হরকত-উল-আনসার’। তার ঠিক আগে আগেই ছয় বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করেছিল জঙ্গিরা। তাঁদের মধ্যে একজন সম্ভবত নরওয়ের। কিছু দিন পরে তাঁর মুণ্ডহীন দেহ পাওয়া গিয়েছিল অনন্তনাগের কাছাকাছি এক গ্রামে।

কাশ্মীরের বাতাসে তখন নিত্য উড়ছে বারুদ আর আতঙ্কের গন্ধ। কিন্তু পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, আতঙ্কবাদের কাছে মাথা নোয়ায়নি ভারত সরকার। ফলে সেই ভয়ের ছায়াতেও অমরনাথের তীর্থযাত্রা হবে। সে যতই যাত্রা উড়িয়ে দেওয়া হবে বলে সন্ত্রাসবাদীরা হুমকি দিক!

অমরনাথ তীর্থযাত্রা কভার করতেই প্রথম কাশ্মীর যাওয়া। সেই প্রথম পহেলগাওঁ দেখা। সেই প্রথম দেখা চন্দনবাড়ি। পায়ে হেঁটে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মহাগুণা পাস পেরিয়ে অমরনাথ গুহায় পৌঁছোনো। রাস্তায় থিক থিক করছে জংলা ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরিহিত ফৌজ আর খাকি উর্দির নিরাপত্তাবাহিনী। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তীর্থযাত্রীরা স্লোগান তুলছেন ‘হর হর মহাদেও’। বাঙ্কারের ও পাশ থেকেও ভেসে আসছে একই স্লোগান। যুগপৎ হুঙ্কারে খানিক ঘাবড়েই যাচ্ছে মাল এবং তীর্থযাত্রী বহনকারী বেঁটে বেঁটে পাহাড়ি খচ্চর। মাথা ঘুরিয়ে একটু দেখে আবার চালু করছে দুলে দুলে হাঁটা।

দুর্দান্ত নৈসর্গিক দৃশ্য চারপাশে। প্রকৃতি আদর করে রূপের গালিচা বিছিয়ে রেখেছে পাহাড়ের ঢালে-নাবালে। একটা পাহাড় পার হতেই চোখের সামনে হাট করে খুলে যাচ্ছে এক একটা দৃশ্যের দরজা। কিন্তু সে সব দেখার সময় কই! ধুঁকতে ধুঁকতে পৌঁছে বহরমপুরের বাসিন্দা এক বিএসএফ জওয়ানের দৌলতে (আনন্দবাজারের রিপোর্টার জেনে দেশোয়ালি ভাইয়ের জন্য সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন) রাতটা অমরনাথের গুহার সামনের চাতালে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শুয়ে কেটেছিল। পরদিন ফিরতি পথে আবার হন্টন মেরে চন্দনবাড়ি হয়ে পহেলগাঁও। সে বার কোথাও কোনও গোলমাল হয়নি। জঙ্গিরা তীর্থযাত্রীদের উপর হামলা করেনি। বা করতে পারেনি। ফেরার সময় সদ্য আলাপী সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ডিআইজি গোবিন্দগোপাল শর্মা স্নেহপরবশ হয়ে ফাইবার গ্লাসের বুলেটনিরোধক জ্যাকেট পরিয়ে আগন্তুক তরুণ সাংবাদিককে তাঁর জিপসির চালকের (চালককে পিছনে বসিয়ে তিনিই চালাচ্ছিলেন গাড়ি) পাশের আসনে বসিয়ে শ্রীনগরে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ফেরার পথে কত বার যে থেমেছিল সেই কনভয়! অমুক পাহাড়ের খাঁজে কি কোনও নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে? লাগাও বাইনাকুলার। তমুর বাঙ্কারে পাহারা দিতে দিতে কি কোনও জওয়ানের চোখ লেগে গিয়েছে? সটান তাঁর সামনে হাজির হয়ে ধমক দাও, ‘‘কী রে! বরযাত্রী এসেছিস নাকি? সিধা খাড়া হো যা!’’

এই ছিল কাশ্মীর। অমরনাথ যাত্রার পরেও একাধিক বার গিয়েছি অ্যাসাইনমেন্টে। কখনও নির্বাচনের আগে। কখনও কোনও উগ্রপন্থী হামলার ঘটনার বিবরণী লিখতে। প্রতি বার চোখে পড়েছে শ্রীনগরের ‘এসপ্ল্যানেড’ লালচকে সার সার শাটার ফেলা দোকান, বাঙ্কারের আবডাল থেকে উদ্যত কালাশনিকভ রাইফেলের নল আর ঝুড়ি ঝুড়ি নাচার, দরিদ্র, হতশ্রী মানুষ। যাঁরা বলতেন, সন্ত্রাসবাদের কবলে পড়ে কাশ্মীরের পর্যটন শেষ হয়ে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে গোটা কাশ্মীরের অর্থনীতি।

ভিন্‌রাজ্য থেকে যাওয়া সাংবাদিক মানেই লালচকের ‘আদুস’ হোটেলে উঠতে হবে। কারণ, সাধারণ পর্যটকের মতো অন্য হোটেলে উঠলে জঙ্গি হামলা হতে পারে। কিন্তু জঙ্গিদের তো আবার সংবাদমাধ্যমকে প্রয়োজন। তারা জানত, ‘আদুস’ হোটেলে সাংবাদিকদের বাস। তারা ওই হোটেলেই প্রেস বিবৃতি পৌঁছে দিয়ে যেত।

শ্রীনগর বিমানবন্দরের বাইরে বেরোনো মাত্র ধেয়ে এল কিছু চেহারা— শিকারা চাহিয়ে? হাউসবোট?

বললাম, না। আদুস হোটেল যাব।

দ্রুত পাল্টা প্রশ্ন এল, ‘পত্রকার হো?’

বস্তুত, তারও কয়েক বছর পরে যখন আবার গিয়ে উঠেছি ‘আদুস’ হোটেলে, রুম সার্ভিস নিতে এসে বেয়ারা বিস্মিত হয়ে বলেছেন, ‘‘সাব, আপ ওয়াপস আ গ্যয়ে?’’ কারণ, আমাদের মতো কিছু পেশাদার সাংবাদিক ছাড়া সেই কাশ্মীরে এক বার গেলে আর সেখানে ফিরে যেত না কেউ। চুলোয় যাক নিসর্গ, চুলোয় যাক ভূস্বর্গ! আপনি বাঁচলে কাশ্মীরের নাম।

এই তো ছিল কাশ্মীর! অমরনাথ যাত্রায় যত পথ হেঁটেছিলাম, তার প্রতিটি বাঁকে ক্লিন্ন, ক্ষয়াটে সব মুখের সারি। তাঁদের কপালে উদ্বেগের বলিরেখা। যাঁরা সকালে বাড়ি থেকে বেরোলে রাতে বাড়ি ফিরবেন কি না, জানতেন না। আবার রাতে ঘুমোলে সেই ঘুম সকালে ভাঙবে, না কি আততায়ীর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাবেন, জানতেন না তা-ও।

পহেলগাঁও হত্যাকান্ডের পর একটা ভিডিয়ো দেখতে দেখতে ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতার মধ্যে পড়ে সস্তা দরের স্যান্ডউইচ হয়ে যাওয়া সেই মুখগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই লালচওক। সেই সারি সারি বন্ধ শাটার। তার সামনে নাচার মুখ কিছু অটোচালকের। তাঁদের অটোর উইন্ডস্ক্রিনে ইংরেজি হরফে পোস্টার সাঁটা এই মর্মে যে, তাঁরা সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে পর্যটকদের বিমানবন্দর বা রেলস্টেশনে পৌঁছে দেবেন। কেন দেবেন? কারণ, তাঁরা পর্যটকদের বলতে চান যে, তাঁরা যেন কাশ্মীরকে বর্জন না-করেন। ভিডিয়োয় এক মধ্যবয়সি অটোচালক বলছিলেন, ‘‘এখন তো আর কাশ্মীরে কেউ আসবে না। মরব আমরা! এখানে লোকে বেড়াতে আসত। আমরা তাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতাম। আমাদের দুটো পয়সা হত। সে সমস্ত নষ্ট হয়ে গেল। আমাদের রুজি-রোজগার সমস্ত গেল! পহেলগাওঁয়ের ঘটনায় যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে তো আমরাও শহিদ হয়েছি।’’ গলা ধরে আসছিল, যখন তিনি বলছিলেন, ‘‘ট্যুরিস্ট হমারি জান হ্যায়, ট্যুরিস্ট হমারি শান হ্যায়। ট্যুরিস্টদের বাঁচাতে দরকার হলে আমরা বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতাম! যারা ওদের মেরেছে, তারা মানুষ নয়। শয়তান! তারা মুসলমানও নয়।’’

পহেলগাঁওয়ের নারকীয় এবং ন্যক্কারজনক ঘটনার পর গোটা দেশ জুড়ে যে ক্রোধের ঝড় উঠেছে, তাতে এই সব ভাল ভাল কথা খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার কথা। যাচ্ছেও। বরং দিকে দিকে যুদ্ধের রব উঠেছে। রণডঙ্কা বাজতে শুরু করেছে গলি, পাড়া, মহল্লা জুড়ে। দেখা হলেই লোকে একটাই প্রশ্ন করছে— যুদ্ধ কবে? কবে যুদ্ধ? শুনতে শুনতে নিজেরই খটকা লাগছে, আশপাশের প্রায় সকলেই ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’র মোডে চলে গেলেন নাকি! বিধানসভার বাইরে বিরোধী দলনেতা সদলে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার স্তূপে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগাচ্ছেন (এটি আর একটি অবিমৃশ্যকারিতা), সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধজিগির, চ্যানেলে চ্যানেলে উচ্চগ্রামের আলোচনায় বেজে উঠছে তূরী-ভেরী। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, আমরা বোধহয় ভুলেই গিয়েছি যে, ব্যক্তি স্বাধীনতার মতোই বাক্‌ স্বাধীনতা এবং আচরণ স্বাধীনতাও একটা দায়বদ্ধতা দাবি করে। সমাজটা ‘ফ্রি ফর অল’ হয়ে গেলে তার ফল ভাল হয় না। কোথাও একটা আঁটবাঁধ প্রয়োজন।

আম কাশ্মীরিদের অনুনয় বা মোমবাতি মিছিলের মতোই এই জিগিরে চাপা পড়ে যাচ্ছে এই সরল প্রশ্নটি যে, এই ডোভাল-যুগে কী করে চার-পাঁচ জন সন্ত্রাসবাদী নির্বিবাদে ঢুকে পড়ল পহেলগাঁওয়ে। হাতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, দেহে আটকানো হামলার টাটকা ছবি তোলার ক্যামেরা, মাথার মধ্যে নিজেদের লেখা কিছু নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা বহন করে তারা চলেও এল পহেলগাঁওয়ে। ২৬ জনকে গুলি করে মেরে আবার ফিরেও গেল। তাদের চার জনের ছবি জোগাড় করে ফেলল নিরাপত্তা সংস্থা। কিন্তু এখনও তাদের হদিস পেল না।

এই লেখা লিখছি শনিবার। পহেলগাঁও ঘটেছিল গত মঙ্গলবার। তার পর থেকে ক্রুদ্ধ ভারত মাটিতে মুহুর্মুহু লেজ আছড়াচ্ছে। পাকিস্তানের বিষয়ে বিবিধ কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল, পাক কূটনীতিককে দেশে ফেরানো, পাক নাগরিকদের ভিসা বাতিল, বিভিন্ন রাজ্যে যে সমস্ত পাক নাগরিক আছেন, তাঁদের অবিলম্বে দেশে ফেরত পাঠানো ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। সীমান্তের ও পার থেকেও পাল্টা বিবিধ বহ্বাস্ফোট ভেসে আসছে।

ওহ্, লিখতে ভুলে যাচ্ছিলাম, পুলওয়ামা, কুলগাঁও এবং সোপিয়ানে তিন সন্দেহভাজন জঙ্গির বাড়ি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুমান যে, তারা পহেলগাঁওয়ের ঘটনার জড়িত ছিল। অনুমান। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকার সর্বদল বৈঠকে নিমের পাঁচন গেলার মতো মুখ করে গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আততায়ীদের টিকির হদিস এখনও পায়নি।

উপরের ছবিটা আরও এক বার দেখুন। সদ্য স্বামীহারা বিধবার ওই ছবি বলছে, আসলে জঙ্গি হামলায় হাঁটু ভেঙে বসে আছে আমার দেশ! আপনার দেশ! আমাদের দেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.