মার্ক্সবাদের ভিত নড়িয়ে ‘আদানি’ এখন কমিউনিস্টদের পার্টনার

আদানি কে নিজেদের ‘পার্টনার’ বলছেন কমিউনিস্ট সরকারের মন্ত্রী।
পুঁজিবাদের বিরোধিতা করতে করতে কমিউনিস্ট সরকার পুঁজিবাদীদের বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে ?
আসলে সব মালিক কেই ‘পুঁজিবাদী’ বলে দেগে দেওয়ার মধ্যে মার্ক্সবাদের বিফলতাই লুকিয়ে আছে।
আজ চীন কি করছে? ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদ থেকে দূরে সরে পুঁজিকেই প্রশ্রয় দিয়েছে, বিদেশীয় কোম্পানিকে ব্যবসা করতে দিয়েছে আর ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে উঠে এশিয়ার বৃহত্তম অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করেছে। চীন আজ শ্রমিকের অধিকার ভুলে শ্রমিকদের শ্রম কে কাজে লাগিয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
সরকার, ব্যক্তিগত মালিকানা শেষ করে সমস্ত সম্পত্তি কে সরকারি সম্পত্তি করলে, সরকার নিজেই একটা বড় ‘পুঁজিবাদী’ সরকার হয়ে যায়।

সোভিয়েত রাশিয়া থেকে চীন পর্যন্ত এই ঘটনাই ঘটেছে প্রাথমিকভাবে। বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব হয়ে, উৎপাদন কমেছে, শ্রমদানের উৎসাহ কমেছে। তারপর এখন কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে পরিচিত চীন ব্যক্তিগত মালিকানা কে মেনে নিয়েছে, বেসরকারি পুঁজি কে জায়গা করে দিয়েছে।
লভ্যাংশের সবটুকুই যদি শ্রমিকদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে গবেষণার জন্য, উৎপাদিত দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য, যন্ত্রপাতির উন্নয়নের জন্য আর সর্বোপরি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার জন্য পুঁজি আসবে কোথা থেকে?
শ্রমিকদের জন্যই লভ্যাংশের সবটুকুই তাদের মধ্যে বন্টন করা যায় না, মালিকের হাতেই রাখতে হয়।

শ্রমিকের শোষণ হবে কি না তার সবটুকুই নির্ভর করছে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক আর নৈতিকতার উপরে।
মার্ক্স নিজেই স্বীকার করেছে সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ হয়ে গেলেও তাকে টিকিয়ে রাখবে মানুষের নৈতিকতা।
শেষে যদি নৈতিকতাই ভরসা হয় , তাহলে সংস্কারের মাধ্যমে নৈতিকতার বিকাশ কেনো করা হবে না? রক্তক্ষয়ী শ্রেণী সংগ্রামের পরেও যদি নৈতিকতা দিয়েই সমাজে সুব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হয় , তাহলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে প্রাণহানির পরিবেশ সৃষ্টি করা কেনো?
ঠিক এইখানেই ধর্ম-সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা।

ঠিক এইখানেই ভারতের পথই সঠিক পথ মনে হয়।

উপনিষদের যুগেই সঠিক মন্ত্র দেওয়া হয়েছিল —
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্ ॥

অর্থাৎ,
এই জগতে যা কিছু গতিশীল বা স্থিতিশীল রয়েছে, সেই সবকিছুই ঈশ্বরের দ্বারা পরিব্যাপ্ত। সেই ত্যাগভাবনার মাধ্যমেই তুমি ভোগ করো, লোভ কোরো না, কারণ এই ধন আসলে কার?

এই শ্লোকটি একটি গভীর দার্শনিক তত্ত্বের প্রকাশ করে। প্রকৃত ভোগ বা আনন্দ লাভ করতে হলে ত্যাগের মানসিকতা প্রয়োজন। জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত হলে আত্মিক শান্তি লাভ করা যায়।

সবার মধ্যেই ঈশ্বর কে দেখলে আর আলাদা করে ‘শ্রেণী’ দিয়ে ভাগ করার প্রয়োজনীয়তা হবে না আর লোভ ত্যাগ করার শিক্ষা পেলে ‘শোষণ’ হবে না। প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন হবে আর স্থায়ী পরিবর্তন হবে , প্রাণহানির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করতে হবে না।

আপন মতবাদের উপর ভিত্তি করে যারা পৃথিবীকে দুই ভাগে করেছে তারাই পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে, মানবসভ্যতা কে কলুষিত করেছে —- কখনো সেই ভাগ ‘বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী’ , আবার কখনো ‘ধনী-গরীব’ এর নামে।
‘লড়াই , লড়াই, লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই ‘ — শুধু প্রয়োজনের জন্য নয় , লড়াইটাই যেনো টিকে থাকার , ক্ষমতা দখলের মাধ্যম।

আজ যখন কমিউনিজমের মূল নীতিগুলো কে কমিউনিস্টরাই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে তখন মার্ক্সবাদের অসাড়তা সবার সামনে চলে আসছে।

উল্টোদিকে ভারতীয় সমাজে শুধুমাত্র শাস্ত্রীয় বাক্য মুখস্থ করানো হয় নি, তা ছিল আচরণের বিষয়। ‘ধর্ম’ কোনো ‘Dogma’ নয় , সমাজের আনাচে কানাচে তা ছিল অভ্যাসের বিষয়। ধনী তখনই সমাজে মর্যাদা পেতো যখন সে সমাজের ধনের প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে সাহায্য করতো। তাছাড়া শুধুমাত্র নিজের বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য ভারতে কোনো ধনীরই ইতিহাসের পাতায় নাম নেই। এই কারণে অর্থ কে কেন্দ্র করে যে সমাজ কে ভাগ করা যায়, এই দর্শন ভারতে জন্ম নেয় নি। আবার ব্যক্তির চার পুরুষার্থের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ‘অর্থ’ কে স্থান দেওয়া হয়েছে কিন্তু তার লক্ষ্য ‘অর্থ’ তে গিয়ে শেষ হয় না, তার লক্ষ্য বৃহৎ — নিজেকে সৃষ্টির সমস্ত কিছুর সাথে একাত্ম হতে দেওয়া , নিজের সঙ্গে বাকি সৃষ্টির যত প্রভেদ ধাপে ধাপে তার অবলুপ্তি অর্থাৎ ‘মোক্ষ’ আর ‘মোক্ষ’ প্রাপ্তির অভ্যাস ‘ধর্ম’।
ভারত বিভেদকে কেন্দ্রে রাখে নি , ‘একাত্মতা’ কে কেন্দ্রে রেখে ভেবেছে আর বিভেদ কে বলপ্রয়োগ করে মুছতেও যায় নি, তাই কোনো শ্রেণী সংগ্রামের কল্পনাও করে নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাশিয়ার চিঠি’ প্রবন্ধের উপসংহারে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন এইভাবে —-
“একদিন ভারতের সমাজটাই ছিল প্রধানত পল্লীসমাজ। এইরকম ঘনিষ্ঠ পল্লীসমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে সমাজগত সম্পত্তির সামঞ্জস্য ছিল। লোকমতের প্রভাব ছিল এমন যে, ধনী আপনার ধন সম্পূর্ণ আপন ভোগে লাগাতে অগৌরব বোধ করত। সমাজ তার কাছ থেকে আনুকূল্য স্বীকার করেছে বলেই তাকে কৃতার্থ করেছে, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় যাকে চ্যারিটি বলে এর মধ্যে তা ছিল না। ধনীর স্থান ছিল সেখানেই যেখানে ছিল নির্ধন; সেই সমাজে আপন স্থানমর্যাদা রক্ষা করতে গেলে ধনীকে নানা পরোক্ষ আকারে বড়ো অঙ্কের খাজনা দিতে হত। গ্রামে বিশুদ্ধ জল, বৈদ্য, পণ্ডিত, দেবালয়, যাত্রা, গান, কথা, পথঘাট, সমস্তই রক্ষিত হত গ্রামের ব্যক্তিগত অর্থের সমাজমুখীন প্রবাহ থেকে,রাজকর থেকে নয়। এর মধ্যে স্বেচ্ছা এবং সমাজের ইচ্ছা দুই মিলতে পেরেছে। যেহেতু এই আদানপ্রদান রাষ্ট্রীয় যন্ত্রযোগে নয়, পরন্তু মানুষের ইচ্ছাবাহিত, সেইজন্যে এর মধ্যে ধর্মসাধনার ক্রিয়া চলত, অর্থাৎ এতে কেবলমাত্র আইনের চালনায় বাহ্য ফল ফলত না, অন্তরের দিকে ব্যক্তিগত উৎকর্ষসাধন হত। এই ব্যক্তিগত উৎকর্ষই মানবসমাজের স্থায়ী কল্যাণময় প্রাণবান আশ্রয়।”
ভারতবর্ষ যত নিজের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হবে, তার থেকে বিভেদের সমস্ত তত্ত্ব নিজে থেকেই দূরে সরতে থাকবে। কেরলের বন্দর উদ্বোধনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের এক ধনকুবের কে ‘পার্টনার’ বলা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.