১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । জেলে বসেই তিনি ঠিক করেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি নয়, বরং সাহিত্য-সরস্বতীর সাধনার দ্বারাই তিনি দেশসেবা করবেন। জাগিয়ে তুলবেন দেশের মানুষের বিবেকবোধ ও চেতনাকে। এমনকী তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ তিনি লিখেছিলেন কারান্তরালে থাকাককালীনই। তিনিই প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক যিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন । জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য |
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । সুভাষচন্দ্র বসুকে স্মরণ করে তিনি নিম্নের লেখাটি লিখেছিলেন –
সুভাষচন্দ্র- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়:-
মাঝে মাঝে এক একটি দুর্লভ দিন আসে যে দিনটিতে বাস্তব পৃথিবীর মাইল-মাপা দূরত্ব, জীবনের পারিপার্শ্বিকের পার্থক্য, বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভিন্ন সমাজের মানসিক ভিন্নতাকে অতিক্রম করে একটি বিশাল জনসমষ্টি পূর্ণিমা তিথির সাগর জলের মতো উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক নিয়মে পূর্ণ চাঁদের আকর্ষণে সমুদ্র জলে উচ্ছ্বাস উঠে। মানুষের মনের মধ্যে যে একটি চৈতন্যময় প্রকৃতি আছে, তারই নিয়মে নির্দেশে এমনি উচ্ছ্বাস জাগে মানুষের মনে;তখন বিভিন্নমুখী সমুদ্রস্রোতের মতো যত পথের বিভিন্নতা, বৈষয়িক বিদ্বেষ সম্ভ্রমে নতশির হয়, একটি প্রবলতর আকর্ষণে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, তটভূমির বাধাবন্ধ সব কিছু প্লাবিত করে বৃহৎ হয়ে ওঠে। সমুদ্র শুধু আয়তনে বৃহৎ হয়; মানুষের জীবনোচ্ছ্বাস শুধু বৃহৎ নয়, মহত্ত্বের স্পর্শ পায়।
ভূমিকাটি কিছু গম্ভীর হল। কিন্তু উপায় নেই- যা বৃহৎ, যা মহৎ তার স্বরূপই গম্ভীর। পূর্ণিমার রাতে সমুদ্রতটে জোয়ারের সময় দাঁড়ালে এ সত্য উপলব্ধি করা যায়।শুধু গম্ভীর নয়, কোথায় একটি পবিত্রতা আছে। প্রসন্নও হতে পারে আর স্তম্ভিত করা ভয়ঙ্কর কিছুও থাকতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে লঘুতা নেই, দীনতা নেই, কুটিল কুৎসিত কিছু নেই। এর প্রকাশ লঘুছন্দে হয় না।
২৩ শে জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন। নবভারতের বীরোত্তম সুভাষচন্দ্র। ভারতবর্ষের মানবজীবনে মহাজীবনে মহাজীবন তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ মনীষী কার্লাইলের বীরের সংজ্ঞাকে অনুবাদ করেছেন-” তিনিই বীর যিনি বিষয় পুঞ্জের অন্তরতর রাজ্যে সত্য এবং দীব্য এবং অনন্তকে আশ্রয় করিয়া আছেন- যে সত্য, দিব্য এবং অনন্তকে আশ্রয় করিয়া আছেন- যে সত্য, দিব্য এবং অনন্ত পদার্থ অধিকাংশের অগোচরে চারিদিকের তুচ্ছ ও ক্ষণিক ব্যাপারের অভ্যন্তরে নিত্যকাল বিরাজ করিতেছেন; সেই অন্তর রাজ্যেই তাঁহার অস্তি, কর্ম দ্বারা অথবা বাক্য দ্বারা নিজেকে বাহিরে প্রকাশ করিয়া তিনি সেই অনন্ত-র রাজ্যকেই বিস্তার করিতেছেন।”
সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রকাশ জটিল-কুটিল জাল বিস্তারে ন্যায় নীতিকে উপেক্ষা করে সংসারের বস্তুপুঞ্জকে আয়ত্ত করার মধ্যে, বীরের স্বার্থ, স্বকীয় অর্থে,অর্থাৎ সত্যকারের পরম মাণবিক অর্থে নিজেকে প্রকাশ করা, এবং ক্ষুদ্রতায় দীনতায় অভিভূত মানুষের সমাজকে বৃহত্তর এবং মহত্তর জগতে উন্নীত করার মধ্যে। যিনি বলতে পারেন- “তুমি আমাকে বুকের রক্ত দাও, আমি তোমাকে দেবো স্বাধীনতা। এতো ভারতের সেই চিরন্তন বাণী- উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।”
এই বাণীই বীরের বাণী। তিনি নতশির, হতাশামগ্ন মানুষের সমাজকে ডাক দিয়ে বলেন- ওঠো জাগো। সেই কণ্ঠস্বর, সেই বাণী মুহূর্তে মানুষকে মুক্ত করে।
এ মানুষ আসে। সব দেশে আসে, সব কালে আসে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র সেই মানুষ। তাঁর আহ্বান সারা পৃথিবীতে শঙ্খ ধ্বনির মতো ধ্বনিত হয়েছিল। তাঁর জীবন মহাজীবন, তাঁর আহ্বান মহা আহ্বান।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র কোহিমাপ্রান্তে এসে যে সবল করাঘাত করে ধ্বনি তুলেছিলেন। ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’,’চলো চলো দিল্লী চলো’ তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। ভারতবর্ষ আজ স্বাধীন। তিনি দিল্লীর পথের ধুলো উড়িয়ে রাজপ্রতিনিধি ভবনে বা লালকেল্লায় উপনীত না হলেও তাঁর শক্তি, তাঁর প্রেরণা, তাঁর বীর্যের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া ইংরেজের সাম্রাজ্য- শক্তিকে আঘাত করেছে, পরাজিত করেছে। কিন্তু তিনি অদৃশ্য হয়েছেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে নিখোঁজ হয়ে গেছেন।
এই ঘটনাটি সাধারণের কাছে একটি পরমাশ্চর্য। কিন্তু এরই মধ্যে সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের গীতার বাণী মূর্ত করেছেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের শতাব্দীব্যাপী যজ্ঞে পূর্ণাহতি প্রদান করে চরু ফলের জন্য তিনি অপেক্ষা করেননি। তিনি প্রস্থান করেছিলেন।
অন্যের বাস্তববুদ্ধিগত ব্যাখ্যায় এর যে অর্থই তাঁরা করুন ভারতবর্ষের যে প্রাণ পল্লীতে বাস করে তার কাছে ব্যাখ্যা সত্য ও সনাতন।
বিশ্ব-বিধাতা যেন সেই মুহূর্তে বলেছিলেন- ও স্বস্তি! এবং তাঁরই নির্দেশে সনাতন দৃষ্টান্তকে নুতন করে উজ্জ্বল মহিমায় প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজেকে স্মরণ করেছেন।
প্রতি ২৩ জানুয়ারীই আমরা তাঁকে স্মরণ করি। ঠিক এই আবেগ নিয়েই তাঁকে স্মরণ করি। রাজনৈতিক দলের দলগত বিচার-বুদ্ধি আমাদের হৃদয়ে মনে প্রশ্রয় পায় না। আমরা আশ্রয় কামনা করি তাঁর মহৎ বীর্যবান ন্যায়প্রদীপ্ত জীবনে ইতিহাসের কাছে।
বলি- রাজনৈতিক কলহের মধ্যে আমাদের এই বিভ্রান্তি যেন আমাদের দৃষ্টিকে অস্বচ্ছ না করে। বিভ্রান্ত থেকে আমরা মুক্তি চাই।
বলি-স্বাধীনতার মধ্যেও আমার দুঃখ দুর্দশার অবসান হল না। আমরা তার অবসান চাই।
বলি- শতাব্দীব্যাপী যে সাধনা করে সাগ্নিক শুদ্ধসত্ত্ব পুরোহিতের পৌরোহিত্যে আমরা যে চরিত্র এবং চিত্তশুদ্ধি লাভ করেছিলাম, তা আশ্চর্যভাবে আমাদের মধ্যে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, আমরা আমাদের স্বরূপ দেখে ভীত। সেই ভয় থেকে আমরা পরিত্রান চাই।
এই প্রার্থনা, এই কামনা ক্রমশঃ সোচ্চার হয়ে উঠছে। বিশেষ করে চীনের ভারত আক্রমণের পর থেকে।
চরিত্রবলের সঙ্গে সঙ্গে আমরা জীবনবল হারিয়েছি। সেই ম্রিয়মাণতার মধ্যে থেকে আজ বলি- আমরা আমাদের এ লজ্জা থেকে পরিত্রান চাই।
গীতায় আছে “অস্থির বুদ্ধি, প্রাকৃত বা বর্বর, গর্বিত, কপট, নিষ্ঠুর, অলস, বিষণ্ন, দীর্ঘসূত্রী যারা তারা তামস- অর্থাৎ তামসীকতায় আচ্ছন্ন। এর চেয়ে নিচে আর নামা যায় না, এদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। আজ সমগ্র দেশের অবস্থা তাই। অন্নহীন বস্ত্রহীন আমরা আমাদের চক্রান্তে। নিজের বুকে ক্ষতের সৃষ্টি করে আমরাই সেই ক্ষতমুখে রক্ত শোষণ করছি। শুভবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে অশুভ সর্বনাশা চক্রান্তকারী বুদ্ধিকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক সভামঞ্চে সদর্প আস্ফালন করছি। একে অন্যের উপর দোষারোপ করে আত্মতৃপ্তি ও উল্লাসে স্ফীত হচ্ছি।
দেশের বিরুদ্ধে সমর্থন করে অহঙ্কৃত ন্যায়বাদী হিসেবে পরিচয় দিতে আমাদের সংকোচ নেই। ষড়যন্ত্রের অপবাদকে মাথার মুকুট হিসাবে পড়তেও আমাদের দ্বিধা নেই।
সদাচার অসহায়ের মতো আমাদেরই কদাচারের শবদেহে পরিণত। বিশ্বের দরবারে অন্ন পাত্র পেতে আছি অন্নের জন্য; হাত পেতে আছি আত্মরক্ষায় অস্ত্রবলের জন্য।
এই কারণেই ২৩ জানুয়ারী সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে গ্রাম-নগরের মানুষের হৃদয়াবেগ মিশে বিপুল উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে চাচ্ছে।
জীবজগতের পরিণতির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই- জীবজগতের ক্রম পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে সরীসৃপ থেকে চতুষ্পদ- চতুষ্পদ থেকে দ্বিপদ- বুকে হাঁটা থেকে আমরা চার পায়ে হেঁটেছি, তা থেকে আমরা দু’পায়ে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে হাত মেলেছি আকাশের দিকে, তার মূলে ছিল প্রাণের একান্ত কামনা। যেমন চেয়েছি তেমনই পেয়েছি। চাওয়ার মূল্য শুধু বৃহৎই নয়,মহৎও বটে। মহৎ বলেই এ চাওয়াকে মানতে হয় সেই মহাপ্রকৃতিকে- যিনি জীবনকে পরিচালিত করেন।
গীতার মতে- মহান পুরুষ মহান বিরাট আসেন এই একই কারনে কালে কালে। মানুষের ইতিহাসে এর নিদর্শন আছে যুগে-যুগে, যুগান্তরে কালে-কালান্তরে। মানুষ তামসিকতার মধ্যে ডুবে তৃপ্তি পায় না। অন্তরে অন্তরে সে পরিত্রাণের জন্য ডাকে। পরিত্রাণ সে পেতে চায়। তখনই ওই কামনা বলেই এমন মানুষ আসেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে-এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশে রাজা রামমোহন রায় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত শত বৎসর এমন মানুষ মিছিল করে এসেছেন সুভাষচন্দ্র তাঁদের শেষ বীর।
আজ আমরা তাঁকে স্মরণের মধ্যে তাঁর মত একজন মানুষকে নতুন করে পেতে চাচ্ছি। যিনি আমাদের এই আদর্শভ্রষ্টতা ও কদর্যতার পঙ্ক- পল্বল থেকে সকলে টেনে তুলে, পুণ্যতোয়া জীবন-ভাগীরথীর জলে অবগাহন করিয়ে মহিমান্বিত সাগর- সঙ্গম তীর্থের বলে দেবেন। ২৩ জানুয়ারি আমাদের সেই মুক্তি-কামনাই সুভাষচন্দ্রকে আমাদের চোখে উজ্জ্বলতর করে তুলবে। ২৩ জানুয়ারি আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে বাণী উচ্চারণ করে।
“উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া।
দুর্গং পথস্তৎ করয়ো বদন্তি।।”
ওঠো,জাগো, যা জগতের শ্রেষ্ঠ তাই পেতে প্রবুদ্ধ হও। কিন্তু এ পথ দুর্গম। কারণ যে পথ সত্য যথার্থ তা ক্ষুরধারের মত শাণিত দুর্গম দূরতায়।আমরা অবশ্যই পশ্চাত্পদ হব না। কারন আমরা মানুষ।
প্রয়াণদিবসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ।