18ই ডিসেম্বর 1927, গোরখপুর……
সবে সন্ধ্যা নেমেছে । সেন্ট্রাল জেলের সামনে চাদরে মাথা মুখ ঢেকে টাঙ্গা থেকে নামলো এক বয়স্ক দম্পতি। গেটের দিকে এগুতেই বন্দুক উঁচিয়ে বেরিয়ে এলো সান্ত্রী, ঝোলা থেকে বুড়ো একটা কাগজ দেখাতে ইশারা করলো ভেতরে যেতে !
সান্ত্রীর নির্দেশে পৌঁছুলো একটা আসবাবপত্র হীন ফাঁকা ঘরে । তল্লাশির পর সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে । নিস্তব্ধ ঘরে দুজন যেন শুনতে পাচ্ছে অন্যের হৃদয়ের আওয়াজ! কতক্ষণ অপেক্ষা করেছে বোঝার আগেই শুনতে পেল একটা ঝনঝন আওয়াজ, ঘরে ঢুকলো সান্ত্রী পরিবৃত হয়ে শেকলে বাঁধা এক বলিষ্ঠ যুবক ।
দম্পতিকে দেখেই তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে এল জলধারা ! বৃদ্ধা এগিয়ে গিয়ে চাদর দিয়ে জল মুছিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো, একি বেটা ? আমি জানতাম আমার ছেলের ভয়ে বৃটিশ শাসকরা কেঁপে ওঠে আর তার চোখে জল ! কাঁদবেই যদি তবে কি দরকার ছিল এপথে আসার ?
দেহাতি বুড়ির এহেন ভর্তসনা শুনে যখন সান্ত্রীরা অব্দি স্তম্ভিত তখনই যুবক বলে উঠল, এ আনন্দাশ্রু মা !
অল্প সময়েই শেষ হলো পারিবারিক সেই মিলন , দম্পতিকে নিয়ে আবার শহরের দিকে ফিরে চললো টাঙ্গা ।
পরদিন রাত থাকতেই উঠে পড়লো যুবক, স্নান সেরে উদাত্ত কণ্ঠে সেলের মধ্যে গাইতে লাগলো , “ওম বিশ্বানী দেবা সবিতা দুনিথানি “।
জেলর যখন তাকে ইশারা করলেন বেরিয়ে আসতে তখন নির্দ্ধিধায় বেরিয়ে এলো সে । পায়ের শেকল খুলে এগিয়ে চললো ফাঁসির মঞ্চের দিকে, মুখে তখন এক অদ্ভুত প্রশান্তি । দুপাশ থেকে সহবন্দীদের বন্দেমাতরম ধ্বনিতে খানখান হয়ে যাচ্ছে রাত্রিশেষের নীরবতা …… শহীদ হলেন রামপ্রসাদ বিসমিল ।????
18ই ডিসেম্বর 1927, ফৈজাবাদ……
সেন্ট্রাল জেল থেকে এক মৃত্যুদন্ডাঞ্জা প্রাপ্ত আসামী তার শেষ চিঠিতে লিখলো,
“I take pride in the fact that I will be the first and foremost Muslim to embrace death on the gallows for the freedom of my country”.
উত্তরপ্রদেশের শাজাহানপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে ১৯০০ সালে জন্ম নেন আসফাক উল্লা খান । জন্মসূত্রে পাঠান এই পরিবারের অনেকেই শিক্ষিত এবং পদস্থ রাজ কর্মচারী ছিলেন । চার ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ এই ভাইটির ছোট থেকেই উর্দু কবিতা রচনা করার শখ , হসরত ছদ্মনামে বেশ কিছু কবিতা এর মধ্যেই লিখে ফেলেছেন। কথায় কথায় দাদার কাছে শুনলো তার সহপাঠী রামপ্রসাদের কথা, সেও বিসমিল ছদ্মনামে উর্দু কবিতা লেখে।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় একদিন শাজাহানপুরের এক জনসভায় সে দেখা করে বিসমিলের সাথে । নিজের পরিচয় দেবার পর তাকে শোনালো নিজের লেখা কবিতা । মুগ্ধ বিসমিল তাকে প্রশংসার সাথে সাথে দীক্ষিত করলো স্বাধীনতার মন্ত্রে । তখন সে বাইশ বছরের যুবক । একজন পাক্কা আর্য সমাজীর সাথে আরেকজন কট্টর মুসলমানের এই বন্ধুত্ব, স্বাধীনতার লক্ষে আমৃত্যু ছিল অটুট!
এলো 1922 সাল । উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরায় অসহযোগ আন্দোলনকারীরা থানা জ্বালিয়ে দিয়ে কুড়িজন পুলিশ কে পুড়িয়ে মারলো । প্রতিবাদে গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন ।
এতে আরও বহু যুবকের মতন হতাশ হলেন আশফাক । ততদিনে তারা বুঝে গেছেন কাকুতি মিনতি করে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যাবেনা । সশস্ত্র সংগ্রামই হলো একমাত্র পথ, কিন্ত এরজন্য চাই প্রচুর টাকা ! বন্ধু রামপ্রসাদের সাথে পরামর্শ করে পরিকল্পনামতো আরও আট সঙ্গীর সাথে 9ই আগষ্ট 1925 সালে কাকোরি স্টেশনে লুটে নিলেন ইংরেজদের প্রাপ্য খাজনা । ????
স্তম্ভিত বৃটিশ প্রশাসন Scotland Yard কে তদন্তের ভার দিল । একে একে সবাই ধরা পড়লেও আসফাক লুকিয়ে পালিয়ে আসেন বিহার । সেখানে একটা কারখানায় দশমাস কাজ করার পর আসেন দিল্লী, উদ্দেশ্য বিদেশে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষে লালা হর দয়ালের সাহায্য নেওয়া ।পাসপোর্টের জন্য পরিচিত এক পাঠান বন্ধুর সাহায্য চাইলেন কিন্ত সেই বিশ্বাসঘাতক পুলিশে খবর দিল ।
বিচারের জন্য তাকে আনা হলো ফৈজাবাদ জেলে । কারা কর্তৃপক্ষ বিসমিলের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ভাঙ্গার জন্য সাম্প্রদায়িক তাস খেললে জবাব দিলো
“Jailor saab, if you are right then I am also quite sure that a Hindu India will be much better than your British India to whom you are serving like a servant.”
বিচারে বিসমিল সহ তাঁদের চারজনের ফাঁসির আদেশ হয় । জেলের দিন গুলোতে উনি পাঁচবার নমাজ পাঠ সহ সম্পূর্ণ সাত্বিক জীবন যাপন করতেন ।
1927 সালের #19শে_ডিসেম্বর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু বিসমিলের সাথে তাঁরও ফাঁসি হয়ে যায়। ঐদিনে বেরিলী জেলে ফাঁসি হয় তাদের আরো এক সহযোদ্ধা রোশন সিংয়ের ও।????????
প্রয়াণ দিবসে তিন অমর শহীদ কে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ???? ???? ????
কলমে ✍????©️ স্বপন সেন ????