যারা পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা বলছে, তারা জ্ঞানপাপী

বেজায় হট্টগোল শুরু হয়েছে। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই! যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই! খুব সুন্দর সুন্দর কথা, চকোলেট চকোলেট গন্ধ তাতে। নেশা ধরে যায়। শুনতে শুনতে একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমার এক পূর্বজ, পার্টিশনের পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলেন। কোনো এক প্রসঙ্গে হঠাৎ ক্ষেপে উঠে বলেছিলেন, “ভালো ভালো ভালো! শুনে শুনে কান পচে গেল! এটাকে কি কেউ খারাপ করতে পারে না?” জানি না, কী যন্ত্রণায় বলেছিলেন সেকথা।

যাই হোক, হট্টগোলের কথা বলছিলাম। সেই হট্টগোলের মাঝদরিয়া থেকে অনেকরকম গলা শুনতে পাচ্ছি। ভুতুড়ে নাঁকি-নাঁকি সব স্বর ! শুনছি তেঁনারা বলছেন, যুদ্ধ খুব খারাপ। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হলে এই হবে, ওই হবে। যুদ্ধের কী দরকার? দুঃখের কথা, এনারা ইতিহাসের খোঁজ রাখেন না। স্বাধীনতার পর ভারত ঠিক করেছিল, সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। গান্ধীজীর বাচ্চা আমরা, অহিংস সত্যাগ্রহ দিয়েই বাজিমাত করব। ফল? পাকিস্তানের আক্রমণ, চীনের আগ্রাসন। পালা পালা, অহিংসা মাথায় থাক, আপাতত সেনাবাহিনীর বুটে হত্যে দে!

অনেকে বলছেন, হাজার কিলো বোমার টাকা বাঁচিয়ে হাসপাতাল ও স্কুল গড়তে পারলে কত গরিবের উপকার হতো। এনাদের কাছে প্রশ্ন, সেটা না হয় করা গেল। তারপর কোনো সন্ত্রাসী এসে রুগি সুদ্ধু ওই হাসপাতাল আর ছাত্র-ছাত্রী সুদ্ধু ওই স্কুল বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে না, সেই গ্যারান্টি দিতে পারেন

কি?

ভুশণ্ডীর মাঠে জড়ো হয়ে তেনারা বলছেন, যুদ্ধ হলে ওদের দেশের কত মানুষ মারা যাবে! তাদের প্রাণের কি কোনো মূল্য নেই? তাদের ঘরে দুধের শিশু নেই? তাদের বাঁচার অধিকার নেই? তা, বাড়িতে ডাকাত পড়লে সেই ডাকাতের ঘরের শিশুদের কথা চিন্তা করে ডাকাতের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন তো? গ্যারান্টি দিচ্ছেন তো? সেই সময় পুলিশ আপনাকে বাঁচাতে এলে পুলিশকে গালাগাল দিয়ে তাড়িয়ে দেবেন তো? ঠিক তো? যদি তা না করেন, তাহলে আজ আমার দেশের সেনাদের গালাগালি দেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিল?

আজ যদি দেশ না বাঁচে, তবে আগামীকাল আপনার পরিবার বাঁচবে কি? সিঞ্জর পর্বতের ইয়েজিদিদের জিজ্ঞেস করুন, বাস্তবটা জানতে পারবেন। বইটই পড়ার অভ্যেস আছে এখনো? নাদিয়া মুরাদের ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ পড়েছেন কী? পড়লে জানতে পারবেন, আপনারা যেটা করতে চাইছেন, তার পরিণতি কী। যুদ্ধ এড়াতে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল ইয়েজিদিরা। পেরেছে কি? আইসিস তাদের সবংশে নিধন করেছে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী বানিয়ে বিকিকিনি করেছে। সেই পরিণতি চান, নিজের পরিবারের জন্য? জইশ-ই-মহম্মদের পিশাচের দলবলের হাতে? অসুখ করলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার আগে এসব অহিংসার কথা কেন মনে হয় না? যে জীবাণুগুলো আপনার কোষগুলোকে আক্রমণ করেছে, তাদের বাঁচার অধিকার নেই? ইমিউনিটিবিহীন শরীরের একটাই পরিণতি মৃত্যু। ঠিক তেমনি, যে দেশ আক্রমণকারীর প্রাণের চিন্তা করে, তাদেরও একই পরিণতি।

বলছেন, যুদ্ধের টাকা বাঁচিয়ে গরিবদের কল্যাণ করতে হবে। সত্যিই গরিবদের কল্যাণ করতে চান? রিক্সায় উঠে রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে ঝগড়া করা বন্ধ করুন। ফুটপাতের দোকানদারের সঙ্গে অসভ্যের মতো দরদাম করা বন্ধ করুন। কাজের লোকেদের পুজোর বকশিস দেওয়ার সময় একটু দরাজ হোন। নিজের পরিবারের জন্য শপিং করতে গিয়ে গরিবদের প্রতি এই মমতাটা বাঁচিয়ে রাখুন। তাতে গরিবদের আখেরে বেশি উপকার হবে। আর যদি সেটা না পারেন, ক্ষতি নেই। শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন বন্ধ করুন। ওতে গরিবের কোনো উপকার হয় না।

এটা অনেকেই বোঝে না যে, আইসিস একদিনে তৈরি হয়নি। আইসিস হলো ভার্সান ২.০। আর পাকিস্তান হলো তার ভার্সান ১.০। যে হিসেবে আইসিস কোনো দেশ নয়, সেই হিসেবে পাকিস্তানও কোনো দেশ নয়। সভ্যতা কৃষ্টি, পরম্পরা, ইতিহাস, ভূগোল, লোকসংস্কৃতি — সবকিছুকে অগ্রাহ করে শুধুমাত্র উপাসনাপদ্ধতির ভিত্তিতে কোনো নেশন-স্টেট তৈরি হতে পারে না। পাকিস্তানের ঘোষিত উদ্দেশ্য জিহাদ-ফি-সবিলিল্লাহ এবং ঘজওয়া-এ-হিন্দ।

এই শব্দদুটোর মানে জানবার দরকার আছে ভারতবাসীর। একান্ত অনুরোধ, এই শব্দদুটোর ওপর একটু রিসার্চ করুন। আর যদি সেটা না করতে পারেন, তাহলে অন্তত আইসিসের মানসিকতা ও কার্যপদ্ধতি কী সেটা জানুন। তাতেই শব্দদুটোর নিহিতার্থ জানা হবে। কী চায় এরা? এরা চায়, পৃথিবীতে শুধু একপাল খুনি বর্বর পুরুষ বাস করবে, সেখানে মেয়েরা পুরুষের ক্রীতদাসী ও যৌনদাসী মাত্র হয়ে বেঁচে থাকবে। এদের জীবনের উদ্দেশ্য হলো আলখাল্লা পরে লম্বা দাড়ি নিয়ে মরুভূমিতে তলোয়ার খেলিয়ে বেড়ানো, উগ্র সালাফি আদর্শে বিধর্মীদের নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করা, তাদের ঘরের মেয়েদের জোর করে অঙ্কশায়িনী করা। এরা ঠিক করেছে গুড়িয়ে দেবে প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতা ও তাদের যাবতীয় কৃষ্টি। এদের সঙ্গে আত্মসম্মান ও স্বাধীনতা বজায় রেখে শান্তিস্থাপনের কোনো উপায় আছে কি?

একটা কথা ভালো করে বুঝে নিন। পাকিস্তান, আইসিস কোনো দেশ নয়, এরা বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি একটা গুন্ডার দল মাত্র। যারা এদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বপ্ন দেখছে, তারা হয় জ্ঞানপাপী ধান্দাবাজ, না হয় মূর্খের স্বর্গে বাস করছে।

প্রবাল চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.