চন্দ্রপূজন ও বঙ্গের বিলুপ্ত এক ব্রতকথা – পর্ব ১

গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

                   তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।। 

                 ধূপ  মলয়ানিল,  পবন চামর  করে,

                   সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি রে।। 

                কেমন আরতি, হে ভবখণ্ডন, তব আরতি–

                   অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে।।
চাঁদ , চাঁদপানা, চন্দ্রকলার ন্যায়, নক্ষত্র মন্ডলে চন্দ্রকলা, চাঁদের মতো মুখ , বামন হয়ে চাঁদে হাত …..চাঁদ নিয়ে কত সৌন্দর্য , কত রোম্যান্টিসিজম তাই না? পূর্ণিমা চন্দ্রালোকে  উদ্ভাসিত পৃথিবী কত প্রেম , কত অভিসার ,কত উত্থান কত পতনের সাক্ষী। চন্দ্রালোক শীতল এক স্বর্গীয় রাত্রিতে দেবী লক্ষ্মী আসেন আমাদের মতো নিকৃষ্ট মানবকুলের গৃহে , আবার কোনও এক চন্দ্রালোক শীতল রাত্রে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস দিয়েছিলেন তাঁর চার শিষ্যকে চতুর্বেদের শিক্ষা ও অধিকার, এমনই চন্দ্রালোক পূর্ণ রাত্রে রাস নৃত্যে ত্রিলোক নৃত্য করেছিল একদা। 


চির-পুরানো চাঁদ,
                চিরদিবস এমনি থেকো   আমার এই সাধ।।    
            পুরানো হাসি পুরানো সুধা   মিটায় মম পুরানো ক্ষুধা—
                নূতন কোনো চকোর যেন পায় না পরসাদ।।
সোনার থালার মতো চাঁদ, রুপোর মতো চাঁদ, পূর্ণিমার চাঁদ আবার কোনো কবির নিকট ঝলসানো রুটি। 
ও চাঁদ,     চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে,
হল          কানায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে॥
শশধর, শশী প্রভৃতিও চাঁদের সমার্থক শব্দ। চন্দ্র পৃষ্ঠের ভূমিরূপকে পৃথিবী থেকে খালি চোখে খরগোশ বা শশকের ন্যায় লাগে। তাই শশক ধারক রূপে কল্পনা করে শশধর নামটি দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটির The Moon ছাড়া অন্য কোনো নাম নেই। অবশ্য অন্যান্য গ্রহের উপগ্রহের আরও নাম থাকতে দেখা যায়। মুন শব্দটি জার্মান ভাষাগোষ্ঠীর কোনো একটি থেকে এসেছে যার সাথে সম্পর্কিত রয়েছে লাতিন শব্দ mensis। মেনসিস শব্দটি মূলত প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মূল me- থেকে এসেছে। এই একই মূল থেকে আবার ইংরেজি measure শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। মিজার শব্দটিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে, কারণ এর সাথে শব্দের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিমাপের প্রকাশের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন: Monday, month এবং menstrual।

তাঁকে ধারন করেন স্বয়ং ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ী তাঁর শিরে। তাই ব্রহ্ম শশাঙ্ক , চন্দ্রশেখর আর ব্রহ্মময়ী চন্দ্রঘন্টা।পৃথিবীর সাথে চাঁদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দূরত্বের দিক থেকে চিন্তা করলে এরা একে-অপরের বেশ নিকটে অবস্থিত, আর তাই মহাকর্ষীয় আকর্ষণজনিত প্রভাবও বেশি। এই প্রভাবের প্রধানতম অবদান হচ্ছে জোয়ার-ভাটা
যত্বা সূর্য স্বর্ভানুস্তমসাবিধ্যদাসুরঃ।অক্ষেত্রবিদ্যথামুগ্ধো ভুবনান্যদীধয়ুঃ।।
যে চাঁদ সূর্যের আলোয় নিজে আলোকধারন করে সে নিজে যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে এক রেখায় এসে ছায়া তৈরী করে তখন অন্ধকারে ভূবন যেমন বিমোহিত হয়ে পড়ে (সূর্যগ্রহন) ঠিক তেমনি যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে এক রেখায় এসে ছায়া তৈরী করে তখন অন্ধকারে ভূবন যেমন বিমোহিত হয়ে পড়ে (সূর্যগ্রহন) ঠিক তেমনি যখন অজ্ঞানতার অন্ধকার জ্ঞানরুপ আলোকে ঢেকে ফেলে তখন আত্মা তার পথনির্দেশনা হারিয়ে ফেলে।


সুষুম্ণঃ সূর্যরশ্মিশ্চন্দ্রমাগান্ধর্বস্তস্য…(যজুর্বেদ ১৮.৪০)
 ঈশ্বর সূর্যরশ্মিকে চন্দ্রের সাথে মিলিত করে একে আলোকিত করেন…
ঋগবেদ ১০.৮৫.৯ নির্দেশ করে যে সূর্য তাঁর কন্যা চন্দ্রকে নিজ আলো উপহার স্বরূপ প্রদান করেছেন। আবার নব প্রজাপতি ও সপ্ত ঋষির এক ঋষি, ঋক বেদের পঞ্চম মণ্ডল তথা পঞ্চম গ্রন্থিকাটি যাঁর  সম্মানার্থে “অত্রি মণ্ডল” নামে নামাঙ্কিত, সেই অত্রি ঋষির পুত্র হলেন চন্দ্র। ঐ পুস্তকে সর্বমোট ৮৭ টি মন্ত্র তিনি এবং তার উত্তরসূরীদের দ্বারা রচিত৷ চন্দ্র ছিলেন ব্রহ্মার অংশ। তাঁর ভ্রাতা দুর্বাসা শিব এবং দত্তাত্রেয় ত্রিদেবের সম্মিলিত রূপ ছিলেন। 
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
          তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা,      হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
          বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥


এই চন্দ্রকে নিয়ে কত কথা , কত উপকথা। বেদ অনুসারে চন্দ্র কখনো পুরুষ আবার ব্যাখ্যা করলে কন্যাসম। আরো বৃহৎ ব্যাখ্যায় গেলে তিনি মহাসরস্বতী।
সাধনসমুচ্চয়ে বজ্রসরস্বতী , বজ্রবীণা – সরস্বতী , বজ্রসারদা , কৃষ্ণযমারিতন্ত্রোক্ত বজ্র সরস্বতীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। দেবী মহাসরস্বতী, তিনি শুভ্র বর্ণা, তিনি চন্দ্র মন্ডলেরও দেবী। তিনি সেথায় স্নেহময়ী, করুণাময়ী, সদা হাস্যমুখী। তিনি মুক্তা আভরণে সুসজ্জিতা। তিনি দক্ষিণহস্তে বরদমুদ্রা , বামহস্তে সনাল শ্বেত পদ্ম ধারণ করছেন। তিনি শ্বেত পদ্মাসনা। শুভ্রবসনা দেবীর পুষ্প, চন্দন শুভ্র। মনে পড়ছে আমাদের উচ্চারিত সরস্বতী দেবীর পুষ্পাঞ্জলি ইত্যাদি মন্ত্রের কথা – 
ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ সকলবিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।
মাহদেবীর চারিদিকে জীবাত্মাকে পরিচালনা করার জন্য অবস্থিত চার দেবীর অবস্থান- সামনে প্রজ্ঞা , পশ্চাদভাগে মতি , দক্ষিণে মেধা , বামে স্মৃতি। মহাসরস্বতী চন্দ্রমন্ডল ,তন্মধ্যে শ্বেত পদ্ম, পদ্মের চারিদিকে হ্রীঃকার সেখানে ধ্যানমগ্না। 


তেন চ ভগবতীং মহাসরস্বতীমনুবিচিন্তয়েৎ শরদিন্দুকরাকারাং সিতকমলোপরি চন্দ্রমন্ডলস্থাং দক্ষিণকরেণ বরদাং বামেন সনালসিতসরোজধরাং স্মেরমুখীমতিকরুণাময়াং শ্বেতচন্দনকুসুমবসনধরাং মুক্তাহারোপশোভিতহৃদয়াং নানারত্নালঙ্কারবতীং দ্বাদশবর্ষাকৃতিং মুদিতকুচমুকুলদন্তুরোরস্তটীং স্ফুরদনন্তগভস্তিব্যূহাবভাসিতলোকত্রয়াম্। ততস্তৎপরুতো ভগবতীং প্রজ্ঞাং দক্ষিণতো মেধাং পশ্চিমতো মতিং বামতঃ স্মৃতি এতাঃ স্বনায়িকা সমানবণাদিকাঃ সম্মুখমবস্থিতাশ্চিন্তনীয়াঃ। – সাধনমালা


অখণ্ড সনাতনী পৃথিবীর লৌকিক ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন সেখানে কোথাও চন্দ্র পুরুষ দেবতা কোথাও তিনি দেবী। কোথাও তিনি যোদ্ধা ,কোথাও তিনি দুঃখের দুঃখিনী চির অভাগিনী। ব্রহ্ম সঙ্গ লাভ করে কখনো তিনি উজ্জ্বল আবার কখনো আপন অহংকারে কলঙ্কিত হয়ে অভিশপ্ত। সংস্কৃতির বৈচিত্র্যতার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে চন্দ্র দেবতার শক্তিপরিধি বিভিন্ন। তবে সকল অঞ্চলেই চন্দ্রদেবতাকে সূর্য দেবতার প্রতিপক্ষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক জায়গায় চন্দ্র দেবতা সব সময় সূর্য দেবতার বিপরীত লিঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। 


মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর চাঁদ চক্রাকারে আকাশে আবির্ভূত হয়। অনেক প্রাচীন সভ্যতায় চাঁদকে দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন গ্রিক দেবী ফইবেআরতেমিসবসেলেনে ও হেক্যাটে, চীনা দেবী চ্যাংই।মেসোপটেমিয় দেবতা সিন, জার্মানির উপজাতীয় দেবতা মানি, জাপানের দেবতা সুকুইয়োমি।  এই সকল  সংস্কৃতিতে সূর্যকে দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার গ্রীক ও মিশরীয় সভ্যতায় একাধিক চন্দ্র দেবতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইবিস এবং থেবসের চোংশু দুজনেই চন্দ্র দেবতা। থোথও চন্দ্র দেবতা, কিন্তু ইবিস ও চোংশুর তুলনায় তার চরিত্রের বহুমাত্রিকতা অনেক বেশি।জাদুকরেরা চাঁদকে পূজা করে। পূজা অর্চনার বাইরে শিল্প সাহিত্য এবং জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় চাঁদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত।
সূর্যের উদয় হয়, দিবাকাল হয় । দিনের পর রাত্রি আসে। দিব- রাত্রি , নাম দিন বা দিবস। একদিন , দুই দিন , তিনদিন…..দিন আসে , চলে যায়। কতদিন এল গেল তা কেবলমাত্র সূর্য দেখে নির্ণয় হয় না । চন্দ্র দেখেও হয় । এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা। যে রাত্রে আকাশে চন্দ্র আসেন না , হয় অমাবস্যা। এক পূর্ণিমার হাতে গুনে ঠিক চৌদ্দ রাত্রি পরে আসে অমাবস্যা । এক অমাবস্যার চৌদ্দ রাত্রি পরে আকাশের পূর্ণ চন্দ্র ঝলমল করে। রাত্রি – দিব , রাত্রি – দিবা চলতে থাকে। রাত্রি – দিবার নাম তিথি । পনের তিথিতে এক পক্ষকাল । মাস শব্দের এক অর্থ চন্দ্র। মাস – দুই পক্ষকাল। অতএব চান্দ্র মাস ….

সুপ্রাচীন মানুষগণ বৎসর গণনা করতেন চান্দ্র দিবস বা মাস ধরে। পূর্ণিমার পরদিন থেকে আরেক এক পূর্ণিমা অবধি। মাস ছিল ৩০ দিনের আর ৩৬০ দিনে হত বৎসর। এজন্য কখনো কখনো এক মাস বেশি ধরে অধিবাসের ব্যবস্থা ছিল । কিন্তু চন্দ্রের পরিক্রমণে অভাব ছিল শৃংখলার । তাই নক্ষত্রে তিথির হিসেবে চন্দ্রের ভোগকালের ২৭ নক্ষত্রের চেয়েও বেশি জরুরি ছিল রাশি গণনা। কেন না সৌর দিবসের হিসেব না  রাখলে সবকিছুই গোলমাল । একমাত্র পঞ্জিকা ছাড়া বিশুদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিথির কোন গুরুত্ব নেই । তাই প্রাচীন পণ্ডিতগণ আকাশের বুকে কল্পনা করেন ১২ রাশির নিয়ে একটি চক্র । একে আমরা বলি রাশিচক্র।

খালি চোখে আমরা দেখি সূর্যের আকাশ পরিক্রমা। এই চলন কিন্তু কোন সরলরেখা ধরে নয়। সূর্য কখনো দক্ষিণ দিক ঘেঁষে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছানোর পর আবার উত্তরমুখী হয় । তখন দেখা যায় সূর্য চলছে উত্তর দিকে ধরে।  উত্তর ও দক্ষিণে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যস্থল বৃত্তাকার ১৬ ডিগ্রি পরিমিত। বলয়াকৃতি এই স্থানকে রাশি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় । প্রাচীন ভারতের ঋষিগণ এই বলয়পথের দিয়েছিলেন #বৈশ্বানর_পথ বা #রবিমার্গ ।অর্থাৎ সূর্যের চলন পথ । আর বর্তমান জ্যোতির্বিজ্ঞানে এর নাম #ক্রান্তিবৃত্ত। 

এই ক্রান্তিবৃত্ত কে প্রাচীনকাল থেকে ১২ ভাগে ভাগ করা হয়।  ১২ ভাগ অর্থাৎ ১২ রাশি।  সূর্য প্রতিমাসে একটি রাশি কে অতিক্রম করে । বছরে বারো রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট ৯.৫ সেকেন্ড। 
১২ রাশি অর্থাৎ ১২ তারকা মন্ডল । সুদূর প্রাচীনকাল থেকে মণ্ডল গুলি কে চিহ্নিত করা হয় কোনো পার্থিব জীব বা বস্তুর নামে । কেন না কোন মন্ডল দেখতে মেষ বা বৃষের  মতো হয় । ১২  মন্ডলের নাম তাই যথাক্রমে মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট , সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর , কুম্ভ, মীন। 
আকাশের বুকের মধ্যে হিরের মতো জ্বলা তারা গুলির সমষ্টিকে রেখা দ্বারা যুক্ত করে এক একটি জীব বা বস্তু বা অবয়ব পায়। সূর্য এই রাশি বা তারকা পুঞ্জ পেরিয়ে বারো মাস পরে পুনশ্চঃ ফিরে আসে প্রথম পুঞ্জে বা মন্ডলে। 
প্রতিটি মন্ডলের উজ্জ্বল নক্ষত্রটির নামে বারোটি মাসের নামও ঠিক করেন প্রাচীন পন্ডিতগণ । এ প্রসঙ্গে একটি কথা খুবই জরুরি। বৈদিক যুগে মাস সব সময় থাকত চান্দ্র বা চন্দ্র কেন্দ্রিক । কিন্তু বছরটি থাকতো সৌর ।পূর্ণিমান্ত মাস গণনাই প্রচলিত ছিল । অর্থাৎ পূর্ণিমা থেকে নতুন মাসের সূচনা হত।


 যে নক্ষত্রের অবস্থান কালে চন্দ্রের পূর্ণিমা সেই নক্ষত্রের নাম অনুসারে গড়ে উঠত মাসের নাম । যেমন-  বিশাখা নক্ষত্রের পূর্ণিমা হলে বৈশাখ ।সূর্য তখন মেষ রাশিতে অবস্থান করে। তেমনি সূর্যের বৃষ রাশিতে অবস্থান কালে চন্দ্র জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র গেলে পূর্ণিমা হবে । তাই জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম। এইভাবেই পূর্বষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ ,  অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, মঘা থেকে মাঘ ইত্যাদি। 
  কিন্তু সূর্যের উপস্থিত কালে এই নক্ষত্রগুলোকে খালি চোখে দেখা যায় না আকাশে । তাহলে প্রাচীনকালে কিভাবে রাশিচক্র নির্ণীত হল ? আসলে চন্দ্রের ভ্রমণপথে এইসব নক্ষত্রের অবস্থান ।  তাই চাঁদের পরিক্রমন সূত্রে তাঁদের এই আবিষ্কার। কামিনীকুমার মহাশয় এই নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন । একে তিনি ” মাস , দিন, সময় নির্দেশক চিরস্থায়ী তারা ঘড়ি” নাম দিয়েছেন।


মঘা তারা মাঘ মাসে পূবেতে ভাতিবে,উত্তর ফাল্গুনী তারা ফাল্গুনে উদিবে।চিত্রা স্বাতী এক সঙ্গে চৈত্রের আকাশেবৈশাখে বিশাখা তারা ধীরে ধীরে আসে।জ্যৈষ্ঠ মাসে দুই তারা অভিজিৎ জ্যৈষ্ঠা ,আষাঢ় শ্রাবনে দেখ শ্রবণা ধনিষ্ঠা।ভাদ্রপদা ফোমালোকে ভাদ্রেতে পাইবে,আশ্বিনে অশ্বিনী তারা উদিত হইবে।কৃত্তিকা ও মৃগশিরা পর দুই মাসে,পৌষেতে লুব্ধক পুষ্যা আকাশেতে।
যাক এত সব চন্দ্র বা চাঁদ নিয়ে কত কথা। চাঁদকে কেন্দ্র করে বঙ্গ তথা অখন্ড ভারতে এক প্রাচীন ব্রত পালন হতো , এখনো হয়। একটি চন্দ্র ব্রত সাধারণভাবে বঙ্গের পূর্ব অংশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। আজ সেসব নিয়ে লিখব বলেই তো প্রাচীন মহাজগত হতে ঘুরে এলাম। আসলে জানেন তো , কৃষি ….হ্যাঁ যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা  সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন।  তিনি অবস্থান করেন প্রতি জীবে , যাঁরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উপকার করেন। 
বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শিলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু এবং গরু পবিত্র পশু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর।  সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব,  দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের  মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “
সেই কারণেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতির নানা বস্তুকে নানা ভাবে পূজা উপাসনা করা হয়ে আসছে। ভালো ফসলের আশায়, রোগ শোক হতে মুক্তি পেতে, পঞ্চভূতকে তুষ্ট করতে সেই উপাসনা আজও আমরা করে থাকি। ইতুপূজা , গাজন, নীলপূজা সেই সুপ্রাচীন কালের প্রকৃতি , কৃষিনির্ভর সমাজেরই সংস্কারজাত। বৈদিক কাল হতে সূর্য উপাসনা তেমনি একটি কৃষিভিত্তিক উপাসনা।
সুবিশাল ভারতে লোকসমাজে নানা স্থানে সেই পরম ব্রহ্ম শিব নানাভাবে উপস্থিত। কখনো তিনি কৃষক, কখনো জেলে, কখনো ভরঘুরে কথক ঠাকুর , কখনো কামার, কুমোর, কখনো মূর্তি শিল্পী হয়ে আমাদের সাধারণের মধ্যেই তিনি উপস্থিত হয়ে আমাদের রক্ষা করেন। তিনি তাই কৃষিদেবতা, জলদেবতা, নটরাজ , মহাযোগী , শ্রেষ্ঠ শিল্পী , তিনি দেবতার দেবতা, মহাদেব।
ভারতীয় সভ্যতা ,সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম, কর্মে শিব এবং শৈব মার্গ এক অখণ্ড সত্য। বিবেকানন্দ বলেছেন , ” ভুলিও না তোমার উপাস্য দেবতা সর্বত্যাগী শংকর।” ধান ভানতে শিবের গীত….ষোড়শ শতকে শিবের গীত মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। শিবমঙ্গল থেকে বৃন্দাবন দাসের  চৈতনভাগবত সর্বত্র তিনি বিস্তার লাভ করেছেন।


একদিন আসি এক শিবের গায়ন ,ডমরু বাজায় গায় শিবের কখন।।আইল করিতে ভিক্ষা প্রচুর মন্দিরে।গিয়া শিবের বেরি নৃত্য করে।
 অরণ্য , জল, সূর্য, বায়ু, ওষধি, ভূমি ,প্রকৃতি ও প্রকৃতির বিবিধ উপাদান মানবকুলের আরাধ্য। সনাতনে তাই প্রকৃতিই ধর্ম , ধর্মই প্রকৃতি। বনবাসী ,গুহাবাসী ত্রিকালজ্ঞ মুনি , ঋষি হতে সাধারণ তাই নানাবিধ বৃক্ষকে উপাসনা করে এসেছেন সেই প্রাচীন কাল হতে। বৃক্ষের পবিত্র, স্নিগ্ধ, শীতল ছায়ায় তাই ঋষির আশ্রম থেকে দেবতার অবস্থান যুগ হতে যুগান্তে। 
আমাদের পূর্ব পুরুষরা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ধন্যবাদ জানাতেন , তাঁরা প্রণাম করতেন  সেই ব্রহ্মকে যিনি অগ্নি, জল, ওষধি , বনস্পতি এবং বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সেই সুপ্রাচীন কালে , মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির শক্তির সঞ্চার ঘটলেই  জীবকুলের জীবন ধারণ সম্ভব হবে।
মাতা চ যত্র দুহিতা চ ধেনূ সবদুর্ঘে ধাপয়েতে সমীচী।

ঋতস্য তে সদসীলে অন্তৰ্মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্।।


জীবনে জল, মৃত্তিকার গুরুত্ব, বাস্তুতন্ত্রে জলের ভূমিকা , জলচক্র ইত্যাদি সম্বন্ধীয় ধারণা সকলই বেদ আমাদের প্রদান করেছেন। সুপ্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিগণ প্রকৃতির বক্ষে যেস্থানেই শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন সেখানেই তাঁকে উপাসনা করেছেন। সেই শক্তিকে সদাই সকল জীবকুলের থেকে ভীষণ এবং অপরাজেয় তা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। 
চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরন্যস্যাগ্নেঃ।

আহ প্রা দ্যাবা পৃথিবী সূর্য আত্মা জাগতস্তস্থুষশচ।।
বেদে ও উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতি , মন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আর্তি ও প্রার্থনা। সাধারণ জীবসহ মানবকুলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন , বাসস্থানের সংস্থান এবং শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা এগুলিই ছিল প্রাচীন কালের মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। এই প্রার্থনা ও আর্তিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঋগ্বেদের মন্ত্রের মুনি ঋষিগণ ছিলেন প্রার্থী। তাঁর সকল জীবের মঙ্গলের জন্য অর্থাথী ছিলেন।তবে  বেদ উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতির  থেকে রামায়ণ গ্রন্থপ্রকৃতি স্বতন্ত্র। রামায়নে আর্তি নেই, পরিত্রানের আবেদন নেই, রামায়ণ – মহাকাব্য …সেখানে মানবকুল জীবন প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে শিখেছেন, প্রকৃতির প্রতি বিনয় রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্ববোধের অঙ্কুরে।
সর্বভূতা সমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনিঃ।


মহাকাল শিরে যে চন্দ্র ধারন করেন ,তিনিও যে কৃষির দেবতা হবেন এটাই স্বাভাবিক। প্রখর রৌদ্র যেমন কৃষির সহায়ক তেমন , দিনের শেষে যে রাত্রি আসে , সেই রাত্রির সুশীতল চন্দ্রালোকে শান্ত পরিবেশও দরকার হয়। বেশ কিছুকাল পূর্বে চন্দ্রপূজার এক ব্রতকথা  সম্পর্কে একটি পুস্তিকা প্রাপ্ত হয়েছে। হতে পারে আধুনিক সমাজের নিকট সেই পুস্তিকার খুব মূল্যবান নয় তবে , সেখানে চন্দ্র দেবতাকে কৃষিদেবতা হিসাবে কল্পনা করার মধ্যে একটি অভিনবত্ব আছে। শ্রী সরোজমোহন মিত্রে ” চন্দ্রপূজার এক লৌকিক কাহিনী” নামক প্রবন্ধে উক্ত বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
পুস্তিকার সারকথা বস্তুর মূল জিজ্ঞাসা হল -” জন্মাব্ধি দুঃখী মোরা কিসের কারণ ? ” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন ” আমাদের পুরাণে শিবের মধ্যে ঈশ্বরের দরিদ্রবেশ আছে, আর অন্নপূর্ণায় তাঁর ঐশ্বর্য।”
শিবের ঘরে অন্ন নাই বাতাসে নড়ে হাঁড়িসকলেরে ধন দিয়া  আপনি ভিখারী।।


এমন যাঁর প্রভু হন,সেই তিনিও অভাগীর দুঃখ লাঘব করবেন স্বাভাবিক। সমাজ সভ্যতার উন্নয়নে যে যা কিছু করেছেন , নিজেকে প্ৰদীপ শিখাসম প্রজ্জ্বলিত করে সমাজকে শিক্ষা , দীক্ষা , শ্রম , গঠন দান করেছেন এখন কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের নিকট তা বৃথা। সেই প্রাচীন ঋষি হন বা কৃষক তাঁরা পরিশ্রম দান করে গেছেন ,অথচ তার ফল যুগ যুগান্ত ধরে আধুনিক সমাজ ভোগ করে প্রাচীনত্ব , ঐতিহ্য , ইতিহাসকে অস্বীকার করে গেছে। যাঁরা কেবল দিয়েই গেছেন, তাঁরা বঞ্চনার জ্বালা ভোগ করতে করতে মনে মনে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন করেছেন ” জন্মাব্ধি দুঃখী মোরা কিসের কারণ?” 
সেই প্রাচীন চন্দ্র ব্রতকথাটি কি ছিল? 


মহাভারতের যুদ্ধ সমাপ্ত। হস্তিনা নগরের অধিপতি হয়েছেন যুধিষ্ঠির। যুদ্ধের পর অখণ্ড জম্বুদ্বীপে তখন কেবল দুঃখ , যন্ত্রণা। রাজকোষ অর্থশূন্য। রাজসূয় যজ্ঞ করার মতো পরিমিত অর্থও তখন নেই।  বাল্যকাল হতে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয় এমনই একদিন পুরুষোত্তম যাদবশ্রেষ্ঠকে প্রশ্ন করলেন , ” হে মাধব , হে নারায়ণ , দুঃখ কিসে দূর হয় বলো। ” 
তখন গোবিন্দ বাসুদেব মৃদু হেঁসে  করলেন দয়াময় দূর হয় বলো তখন নারায়ন যুধিষ্ঠিরকে এক অপূর্ব বিবরণ বর্ণনা করলেন। 


 অবন্তী নগরে ধর্ম নামে এক ব্রাহ্মণ পুত্র বাস করতেন। তপস্যা, সাধন , ভজন , পূজা করে তিনি কালাতিপাত করতেন। কিন্তু তাতে তাঁর অন্নকষ্ট ঘুচত না। 
“মহাদুঃখ পায় দ্বিজ সংসার মাঝারে।নিত্য ভিক্ষা না করিলে খেতে নাহি পারে।।”
একদিন এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দ্বিজ পত্নী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন – ” জন্মাব্ধি দুঃখী মোরা কিসের কারণ ? ” তার কোনো সঠিক উত্তর ব্রাহ্মণের নিকট ছিল না। কেবল বললেন , জানি না কোন পাপে পাপী আমি। 
“বিধাতা করিল মোরে জনম দুঃখিত।”
ধর্ম নামে সেই ব্রাহ্মণ ঠিক করলেন ধর্মেরই উদ্দেশ্যে প্রাণ ত্যাগ করবেন।  সেই কথা ভেবে ধর্মরূপী বিষ্ণুকে প্রণাম করে যাত্রা করলেন। 
দিন গেল, রাত কাটল….কোন সে দিন , কোন তিথি ,কোন রাত তার নাই ঠিক ; ব্রাহ্মণ পথ চলতে লাগলেন। এমন করে পথের যাত্রায় একদিন একদল কাঠুরিয়ার সঙ্গে ধর্ম নাম্নী সেই দ্বিজের দেখা হল। দ্বিজ আপন পরিচয় দিয়ে বললেন , ” অন্ন বিনা নিজ দেশে দুঃখী নিরন্তর ” …..
সে কথা শুনে কাঠুরিয়াদের যিনি বুড়ো সর্দার তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন  – 
” এদেশে মেলে না অন্ন শুনহ হে ব্রাহ্মণ।বহু কষ্টে মোরা করি সময় যাপন।।” 
এতেক শুনে ব্রাহ্মণ বললেন যে, তিনিও জীবন যন্ত্রনা সহ্য না করতে পেরে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রাণ ত্যাগ করতে যাচ্ছেন। তখন কাঠুরিয়া সর্দার বললেন, তাঁদেরও অনন্ত দুঃখ।
” কাষ্ঠ বিক্রি নাহি হয় কিসের কারণ ? কি উপায় করি এজীবন ধারণ?”
যদি ঈশ্বরের সঙ্গে দ্বিজের দেখা হয় তবে যেন অবশ্যই জিজ্ঞাসা করেন যে কোন পাপে তাঁদের এত দুঃখ কষ্ট?
ব্রাহ্মণ তখন বললেন – ” গ্রন্থি এক দেও মম স্মরণ কারণ।”
একথা  শুনে কাঠুরিয়া সর্দার ধান্য তৃণে গ্রন্থি বেঁধে দিলেন।
এরপর ব্রাহ্মণ পথ চলতে চলতে দেখল এক কোঠারিয়া যাচ্ছেন। ধর্ম নামক ব্রাহ্মণ ধর্মের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। সেই শুনে কোঠারিয়া বললেন –
” আমি এত দুঃখ রাশি পাই কি কারণ ? চূর্ণ বিক্রি বিনা মম রহে না জীবন!”
তারপর ব্রাহ্মণের কথা শুনে তিনিও ব্রাহ্মণের হাতে একটি গ্রন্থি বেঁধে দিলেন। আবার পথ চলতে লাগলেন ব্রাহ্মণ। পথ চলতে চলতে আরো কতক দূর গিয়ে তাঁর দেখা হল এক “বরজের সনে” । সব শুনে সেও বলল ” আমার দুঃখের কারণ জেনো ধর্মের নিকটে।” বরজের  দেওয়া গ্রন্থি হাতে ব্রাহ্মণ পুনরায় পথ চলতে লাগল। কিছু দূর গিয়ে তার দেখা হল ” সুরভী গাভী”র সঙ্গে। ” কামদুঘা ধেনু ” ব্রাহ্মণকে বলল, “মম দুগ্ধ নরলোকে করে না গ্রহণ। দুগ্ধের বেদনায় আমি ভুঞ্জি সর্বক্ষণ।”
কোন অপরাধে তার এই দুর্দশা? ব্রাহ্মণের যাতে তার কথা মনে থাকে তাই সেই “বিচালিতে” গ্রন্থি বেঁধে দিল। 
আরো কতক দূরে গিয়ে  ব্রাহ্মণের দেখা হল এক হস্তীর সঙ্গে। 
” করী বলে দ্বিজ মম দুঃখ সুবিস্তর।রাজপাট হস্তী আমি বিপদ অপার।”
তার দুঃখ জানবার জন্য সেও গ্রন্থি বেঁধে দিল। সেখান থেকে ব্রাহ্মণ গিয়ে প্রবেশ করলেন এক অরণ্য মাঝে। সেখানে দেখা হল এক অমৃত ফলের বৃক্ষের সনে।
” ফল ভরে নতশির সংশয় জীবন।কিবা অপরাধে লোকে ফল নাহি খায়।”
এর কারণ ধর্ম জানে, তাঁকে যেন ব্রাহ্মণ এর উত্তর জিজ্ঞাসা করেন। ব্রাহ্মণের স্মরণে রাখার জন্য সেই বৃক্ষও একটি গ্রন্থি তাঁর হাতে বেঁধে দিল। 
সেখান হতে ব্রাহ্মণ চলে গেলেন “মহানদী তটে”। সেখানে সাক্ষাৎ হল এক কুম্ভীরের সঙ্গে। পথিক ব্রাহ্মণ, তিনি ধর্মের কাছে যাচ্ছেন শুনে- কুম্ভীর বলল , ” জলে অর্দ্ধ , স্থলে অর্দ্ধ , আছি দিবা নিশি।খাইতে মেলে না কিছু দুঃখে জলে ভাসি।রবি তাপে পোড়ে সদা শীতে কাঁপে প্রাণ।কি হেতু এতেক দুঃখ দিল ভগবান।” 
ধর্মের দেখা যদি ব্রাহ্মণ পান তবে যেন এটুকু কারণ জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে কুম্ভীর তাঁকে নদী পার করে দেবে। ব্রাহ্মণ কথা দিতে ,তখন ব্রাহ্মণকে কুম্ভীর একটি গ্রন্থি বেঁধে দিল। কুম্ভীর বাহনে ব্রাহ্মণ সমুদ্র উত্তীর্ণ হয়ে পূর্ব মুখে চলল।
কি হল তারপর ? ব্রাহ্মণ কি ধর্মের দেখা পেলেন? এত জনের দুঃখের প্রশ্ন ; ব্রাহ্মণ কি ধর্মকে নিজের কষ্ট জানাতে পারলেন? গোবিন্দ কি ব্রাহ্মণকে দয়া করলেন? দুঃখের ভাত কি সুখ করে খেতে পারবেন কি  ব্রাহ্মণ? ধর্ম যদি আসল তবে চন্দ্রব্রত কেন করতে বললেন !?


ক্রমশঃ
@দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ চন্দ্র পূজার এক লৌকিক কাহিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম্ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.