ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির চাকা কি থেমে যাবে?

না, কথাটা মানা যায় না। ইতিহাস বলছে অর্থনীতির উত্থান-পতন অতীতেও ঘটেছে। দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চলতি অর্থবর্ষের বৃদ্ধির গতির পূর্বাভাষ আগের চেয়ে কমিয়ে ৫ শংতাশে ধার্য করেছে। কিন্তু আমাদের কিছু বিশ্লেষক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদকদের যে প্রচণ্ড হতাশা ও নেতিবাচক মানসিকতা ঘিরে ধরেছে তাতে করে মনে হতে পারে তারা হয়তো এই বৃদ্ধির আগে একটা বিয়োগ চিহ্ন (-৫ শতাংশ) আশা করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হওয়ার পরের ইতিহাসটি একটু চর্চা করলে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
১৯৯১ থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে যখন সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হয় তখন থেকেই অর্থনীতির উন্নয়নের সূচকে বরাবর দোলাচল চলেছে। কখনও অত্যন্ত উচ্চ বৃদ্ধির সময় গেছে। আবার কখনও বা অর্থনীতির নিম্নগতি দুই বা তিন বছর ব্যাপী টানা চলছে। ইতিহাস সাক্ষী যখনই অর্থনীতি নিম্নমুখিতার চক্রে ঢুকেছে তখনই নানা জাতের সংশয়বাদী ও নিরাশাবাদীরা সামনে এসে গেছেন। শুধু আশা নয়, তারস্বরে ঘোষণাও করে দিয়েছেন ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির গল্প শেষ হয়ে গেল এ আমরা হলফ করে বলছি। হায়! অর্থনীতি প্রতিবারই এই পণ্ডিতদের হতাশ করেছে।
এই সংস্কারপর্বে ভারত ১৯৯২-৯৩ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবর্ষ অবধি গড় বৃদ্ধির হার। ৬.৪ শতাংশে ধরে রেখেছিল। এই প্রথম নাগাড়ে ৮ বছর ধরে ভারতের অর্থনীতিতে ৬শতাংশের ওপর বৃদ্ধি ঘটে ছিল। এই পর্বে কেবল ১৯৯৭-৯৮ সালে পূর্ব আফ্রিকায় কারেন্সি সমস্যা দেখা দেওয়ায় মাত্র এক বছরের জন্য বৃদ্ধির হার মার খেয়েছিল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী ২ বছরে পর পর বৃদ্ধির হারকে গড়ে ৭.৫ শতাংশে টেনে নিয়ে যায়।
মনে রাখা দরকার, নতুন সহস্রাব্দে এসে সরকারি নীতিতে কোনো পরিবর্তন বা বড়োসড়ো রদবদল না ঘটলেও বৃদ্ধির গতি ২০০০-০১ থেকে ২০০২-০৩ অর্থাৎ টানা তিনটি অর্থবর্ষে গড়ে ৪.১ শতাংশে নেমে আসে। যথারীতি অর্থনীতির সর্বনাশের সঙ্কেত প্রকট হয়ে উঠেছে। ধ্বনি তুলে নিরাশাবাদীরা লাফিয়ে পড়তে দেরি করেনি। যোগ দিয়েছিল প্রচারমাধ্যমগুলিও। অর্থনীতিবিদ Bralford Delong এই সময় ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলিই এই অধোগতির কারণে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। আর এক দিগজ Desi Rodviele ও অরবিন্দ সুব্রহ্মনিয়াম আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সটান বললেন ভারতে ১৯৯১-এ লাগু করা সংস্কার প্রক্রিয়াগুলি দেশের কোনো উন্নতিতেই লাগেনি। তারা বোঝালেন ৮০-র দশকের উন্নয়নের তুলনায় ৯০-এর দশকে বৃদ্ধির গতিতে বিশেষ কোনো হেরফের হয়নি।
সংস্কারের এই চিরনিন্দুকদের উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উপর্যুপরি প্রধানমন্ত্রী নরিসিমহা রাও অটলবিহারী বাজপেয়ীর এককাট্টা হয়ে সংস্কার প্রক্রিয়ায় গতি আনার ফলে চমকপ্রদ ফল হয়। বাজপেয়ী জমানার শেষ অর্থবর্ষে বৃদ্ধির সীমা ৭.৯ শতাংশে পৌঁছয়। এর পরবর্তী অর্থবর্ষগুলিতে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে (২০০৩-০৪ থেকে ২০১১-১২) অর্থনীতিতে ২০০৭-০৮-এর ব্যাপক ধসের বছরে একটু নেমে যাওয়ার পর ২০০৯-১০, ১১-১২-তে আবার তা স্বমূর্তিতে ৮.৫ শতাংশে উঠে যায়। অর্থনীতির এই দুর্ধর্ষ প্রদর্শন অন্তত সাময়িকভাবে হলেও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। মজার কথা, এই ফলাফল দেখার পর সংস্কারের সমালোচক সুব্রহ্মনিয়াম নিজের ধারণা পাল্টে নেন। ২০০৭ সালে লেখা এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে লাটিন আমেরিকার দেশগুলির অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রচেষ্টাটি ঠিক নয়। ভারতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাজ করেছে সরকারের নেওয়া সংস্কার প্রক্রিয়াগুলি। এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মনে একটা আত্মবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিল। তারা বুঝেছিল সরকারি নীতিগুলি ব্যবসার পরিবেশের অনুকূলেই হবে, ক্ষতিকারক কখনই নয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের তরফে বেশ কিছু ভুল নীতি প্রয়োগের ফলে অর্থনীতি আবার শ্লথগতির চক্রে পড়ে যায়। ইউপিএ-২-এর শেষপর্বের দ্বিতীয়ভাগে বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নীচে নামে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে চূড়ান্ত হতাশাজনকভাবে বৃদ্ধি ৪.৩ শতাংশে নেমে যায়। সকলেই আন্দাজ করুন এই পরিসংখ্যান হতাশার ধ্বজাধারীদের ডেকে আনার পক্ষে আদর্শ। ২০১২ সালের তাদের রিপোর্টে প্রখ্যাত সংস্থা standard and poor খুবই কাব্যিক ব্যঙ্গের সুরে জানায় ‘will India be the BRICK fallen angel?’অর্থাৎ ব্রিক দেশগুলির মধ্যে থেকে তবে কি ভারতই প্রথম নক্ষত্র পতন করে দেখাবে? এরই প্রতিধ্বনি করে ২০১৩ সালের আগস্টে The economist তাদের ‘India in trouble’ শীর্ষক নিবন্ধে ঘোষণা করে দিয়েছিল যে এখন অর্থনীতির দুনিয়ার সব বিশারদই একরকম মেনে নিয়েছেন যে ভারত ১৯৯১-এর পর থেকে এইবার অর্থনৈতিক দুর্গতির চরম আবর্তে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার মতোই ভারতীয় অর্থনীতির গতি আরও একবার সংশয়বাদীদের হতাশ করল। ইউপিএ-২ সরকারের তরফের কিছু ভুল শুধরে নেওয়ার পরই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসে। ফলস্বরূপ অর্থনীতি আবার তার স্বাস্থ্যকর চলন ফিরে পায়। ২০১৪-১৫ থেকে ১৮-১৯ এই চার বছর একাদিক্রমে গড়ে ৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধির স্তরে ঘোরাফেরা করে। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরে ৫০০ ও ১০০০ টাকার বড়ো অঙ্কের নোট বাতিল করে দেওয়ার পর পণ্ডিতরা আবার চুলচেরা বিশ্লেষণে বসে ঘোষণা করেছিলেন অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া ছাড়া। পথ নেই। আশ্চর্য, ২০১৬-১৭-এর অর্থবর্ষেও অর্থনীতির অগ্রগতি ছিল দাপুটে ৮.২ শতাংশ।
অতীতের উদ্ধৃত অজস্র উদাহরণের মতোই অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব আবারও কিছুটা ফিরে এসেছে। বিগত চারটি ত্রৈমাসিকের জিডিপি হারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৃদ্ধি গড়ে ৫.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মধ্যে আবার সর্বশেষ জুলাই সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে তা ৪.৫ শতাংশের নিম্নসীমা।
কাউকে অবাক না করে ঘাপটি মেরে থাকা নিরাশাবাদীরা আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন। কেউ কেউ বলছেন ভারতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। আরও বড়ো সুযোগসন্ধানীরা পরিস্থিতির ফয়দা তুলতে বলছেন হিসেবের পদ্ধতিতেই গড়বড় আছে। চুড়ান্ত অবিমৃশ্যকারিতার উদাহরণ রেখে বলছেন সঠিক পদ্ধতি অনুযায়ী দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার এই চলতি নিম্নমুখিতার আগেও কখনই ৩.৫ শতাংশতে অতিক্রম করেনি। কেউ কেউ আবার সেই কেলেঙ্কারি আর চূড়ান্ত দুর্নীতিতে বোঝাই ইউপিএ-২ সরকারের আমলের কুকীর্তি ঢাকতে এই সুযোগে বলে বেড়াচ্ছেন যতই যা হোক না কেন অর্থনীতির বৃদ্ধি তো ৮ শতাংশের আশপাশেই ছিল। ২০১৩ সালের জানুয়ারিমার্চ ত্রৈমাসিকের ৪.৩ শতাংশে নেমে আসাটা তারা বেমালুম সুবিধেজনকভাবে ভুলে যাচ্ছেন।
অর্থনীতির চলাচলের আলোচিত এই দীর্ঘ ইতিহাসের গতি অনুধাবন করে আমরা একটু ভাবতে পারি যেমধ্যবর্তীও দীর্ঘমেয়াদি স্তরে আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে অর্থনীতি একটি খারাপ অবস্থার মোড় অতিক্রম করছে। কিন্তু আমাদের ভুললে চলবেনা এমন পরিস্থিতিতে আমরা অতীতেও বহুবার পড়েছি। তাই বলছি পণ্ডিত ভবিষ্যত দ্রষ্টাদের বিপদসঙ্কেতের বোতাম টেপার কোনো প্রয়োজন নেই।
অর্থনীতির এই শ্লথগতির মূল কারণ হচ্ছে। ব্যাঙ্ক গুলির অনুৎপাদক সম্পদেকে (এনপিএ)-কে পরিষ্কার করা। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন পর্বে ব্যাঙ্কগুলির ব্যালেন্স শিট যেমন এনপিএ ঘোষণা ও তজ্জনিত ক্ষতির ফলে খারাপ হয়েছে। তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে ঋণগ্রহীতা সংস্থাগুলির B/S ও খারাপ। হয়েছে। এটি স্বাভাবিক পারস্পরিক প্রভাব। ঋণ শোধ করতে না পারায় নতুন টাকা আসেনি। ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভালো খবর, ব্যাঙ্কের এই আবর্জনা দূরীকরণ প্রক্রিয়া। এগিয়ে চলেছে। ব্যাঙ্কের কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে (clean up process), একই সঙ্গে তাদের মূলধনী-সহ অন্যান্য শক্তি বাড়াতে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে ও নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত করে বলছি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি ফিরে আসা অবধারিত। তাই, এই মধ্যবর্তী সময়ে সরকার কিন্তু লক্ষভ্রষ্ট না হয়ে তার চালু করা করা অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়াগুলি পুরোদমে যেন চালিয়ে যায়।
অরবিন্দ পানাগড়িয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.