( স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) দেশের 40% জিডিপি দিত l সারা দেশ থেকে মানুষ কলকাতায় আসতো নিজের ভাগ্য ফেরাতে l আজ 3% l দেশ যেখানে আজ উন্নতির শিখরে, সেখানে একটা রাজ্য কিভাবে পিছিয়ে গেল? 73 বছরের ইতিহাসের বিশ্লেষণ ও সংকট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক l )
চানক্য পন্ডিত বলে গেছেন, রাজা যদি ব্যবসায়ী হয়ে যায়, তবে সে দেশের মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না l ভারতীয় সমাজব্যাবস্থায় ক্ষত্রিয়ের ব্যবসা নিষেধ l প্রশাসক যাতে ব্যবসাকে প্রভাবিত না করে, সেটাই চানক্য পন্ডিতের নির্দেশ ছিল ( একপ্রকার Conflict of Interest এড়ানো) l কিন্তু রাজা / সরকারের হাতে রাশ থাকার নির্দেশ দেন ভারতের অর্থনীতির আদি শিক্ষক l ( আজকের দিনে যেমনটি TRAI, SEBI এর মত রেগুলেটরি অথরিটি করে ) l কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আমাদের দেশের অর্থব্যাবস্থায় বেদ হিসেবে মানা হত l উনি মারা যাবার 1500 বছর পর পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে একনম্বরে ছিল ভারত ওনার শিক্ষার উপর ভিত্তি করে l তারপর সাড়ে সাতশ বছরের পরাধীনতার পরে যখন আমরা স্বাধীনতা পেলাম, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্ক্সবাদের খপ্পরে পড়লাম l ভারতের উপর মার্ক্সবাদী অর্থনীতি চাপানো শুরু হল, যা সনাতন ভারতীয় অর্থনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার একটি তত্ত্ব l যদিও এর অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সারা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে মার্ক্সিয় অর্থব্যাবস্থার অন্তস্বারশূন্যতা বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে 1992 এর মধ্যেই l 1966 পর্যন্ত মিশ্র-অর্থব্যাবস্থায় অন্ততঃ কংগ্রেস নেতাদের পেটোয়াদের কিছু সুযোগ দেয়া হত l সুযোগ ছিল কিছু বিদেশী কোম্পানিরও l কিন্তু শাস্ত্রীজির মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধীর রাজ্যাভিষেকের পর ভারত পুরোপুরি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে চলে এল l ইন্দিরা গান্ধী আমাদের অর্থনীতিকে সোভিয়েত ধাঁচ দিতে সচেষ্ট হন l প্রতিটি পদক্ষেপই ব্যর্থ হয় l কিন্তু প্রতিবারই আরও উদ্ধতভাবে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অতি জাতীয়তাবাদের ঢালকে কাজে লাগিয়ে উনি রাজনৈতিকভাবে জয়ী হন l ওনার ঢাল ছিল সোভিয়েতের আশীর্বাদ, যারা তখন অন্যতম বিশ্বশক্তি l ফলতু প্রথম দশবছর উনি প্রায় বিরোধীহীন ছিলেন l
ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi) নিজের রাজনৈতিক কতৃত্ব কায়েম করতে বেশ কয়েকটা রাস্তা নিলেন l যাঁরা মোরারজি দেশাইকে বঞ্চিত করে তাকে প্রধানমন্ত্রী করেন, তিনি তাঁদের রাজনৈতিক ভাবে অপ্রাসঙ্গিক করে নিজের সিংহাসন নিস্কন্টক করলেন প্রথমেই l নিন্দুকেরা বলে, কলকাতা ও মাদ্রাসে তার নিজের দল কংগ্রেসের হার সুনিশ্চিত করেন তিনি নিজেই l অতুল্য ঘোষ ও কামরাজের পতন হল 1967 বিধানসভার ভোটে কংগ্রেস হারার পর l ইন্দিরা গান্ধীর গুরুত্ব বেড়ে গেল দলে l এরপর ইন্দিরা গান্ধী অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে না জানিয়ে একদিন সকালে ব্যাংক জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত দেশকে জানিয়ে দিলেন অর্ডিন্যান্স জারি করে l এরপরই কংগ্রেস দল ভাগ হল 1969 তে l উনি নিজের দল গড়লেন কংগ্রেস (R) l আদি কংগ্রেস হল কংগ্রেস (O) l কয়েক বছর পর কংগ্রেস (O) জনতা দলে মিশে গেলে, কংগ্রেস (R) নিজেদের আসল কংগ্রেস বলে দাবী করা শুরু করল l প্রসঙ্গত, আজকের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস 125 বছরের আদি কংগ্রেস নয় l.এটা 1969 এর কংগ্রেস (R ) মাত্র l বলাই বাহুল্য, অনুপ্রেরণায় সোভিয়েত রাশিয়া l
সংসদে, ব্যাংক জাতীয়করণের প্রতিবাদ করলেন স্বতন্ত্র পার্টি ও জনসঙ্ঘ l স্বতন্ত্র পার্টির দক্ষিণপন্থী সাংসদ তথা ব্যারিস্টার মিনু মাসানি সেদিন সংসদে যা বলেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে পরের পঞ্চাশ বছরে l তিনি তিনটি পরিণতির কথা বলেন,
এক, এর ফলে আমলাতান্ত্রিক লালফাস ও অদক্ষতা বাড়বে l
দুই, ব্যাঙ্কিংএ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতি বাড়বে
তিন, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হবে
আর অটলজি বলেছিলেন এই সিদ্ধান্ত এক, অশোভনীয় ( Ugly ), দুই, অনুচিত ( Improper ), তিন, অকারণ ( Without justification ) এবং চার অনাবশ্যক ( Unnecessary ) l
এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, এই ঘটনার 22 বছর পর দেশ দেউলিয়া হতে বসেছিল, যার হাত থেকে দেশকে বাঁচান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পামুলাপুর্তি ভেঙ্কট নরসিমা রাও এবং এই ঘটনার 29 বছর পর অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের সাধারণ মধ্যবিত্তরা ব্যাংক থেকে বাড়ি, গাড়ি, কৃষি ও শিক্ষার জন্য ঋণ পাওয়া শুরু করে l
এরপর বিপুল কর বাড়ানো, বিদেশী বিনিয়োগে শৃঙ্খলা, লাইসেন্স রাজ/কোটা রাজের দুর্নীতি এমন ভাবে বাড়তে থাকে, বিদেশী বিনিযোগকারীরা একে একে দেশ থেকে পালাতে থাকে l
লাইসেন্সরাজ ও কোটারাজ ইন্দিরাজির পিতা নেহেরুজির আনা আইন l কিন্তু গন্ডগোল হল উনি আসার পর প্রশাসনে দুর্নীতি ও অদক্ষতা বহুগুনে বেড়ে গেল l নারায়ণ মূর্তি IIT দিল্লিতে একটি ভাষণে বলেছেন, 1991 এর আগে একটা কম্পিউটার কিনতে শুধু লাইসেন্স পেতে তিন বছর লাগতো এবং তার জন্য ব্যাঙ্গালোর থেকে যাতায়াত করে মোট বিনিয়োগ ছিল এক লক্ষ ডলার একটা মেশিন কিনতে l বছর পর যখন লাইসেন্স পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল ওই কনফিগারেশন এর কম্পিউটার IBM আর বিক্রি করে না l তখন ওই নতুন কনফিগারেশনের কম্পিউটার এর লাইসেন্স এর জন্য আরও এক বছর l ঠিক এই কারণে ভারতে কম্পিউটার এলেও, সফটওয়্যার শিল্প 1991-92 এর আগে আসেনি l
1966 থেকেই বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি দেশ ছাড়তে শুরু করে l এদিকে খাদ্যের আকাল দেখা দেয়া l বেকারত্ব আকাশ ছুল l কারখানা থেকে শ্রমিক ছাটাই শুরু হয় l বেকারদের জন্য চাকরির রাস্তা বন্ধ হয় l এমনকি শিবপুর, যাদবপুর ও IIT খড়্গপুরের ইঞ্জিনিয়াররা বেকার হয়ে ব্যাংক, মিলিটারিতে যোগ দেয়া শুরু করে l ইন্দিরাজি করের পয়সায় জাতীয়করণ শুরু করলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ কমে যায় l ডাক্তার ও শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় l ওদিকে লাইসেন্স রাজ, কোটা রাজের দুর্নীতির জন্য ব্যবসাও করা যাচ্ছে না ( বাংলা ছবি ‘সবরমতি’, ‘জনঅরণ্য’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘আপনজন’, ‘এখনি’ কিংবা হিন্দিতে ‘নমকহারাম’, ‘মেরে আপনে’, ‘গোল্ডেন সিটি’, ধীরুভাই আম্বানির বায়োপিক ‘গুরু’ এই ইতিহাসের সাক্ষী ) l কিন্তু কংগ্রেসকে রাজনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে দেয় 1971 এর পাকিস্তানের যুদ্ধ l
এরপর উনি আনলেন FERA l এবার বাকি বিদেশী কোম্পানিগুলোও দেশ ছেড়ে পালালো l তারপর সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে গম ব্যবসা জাতীয়করণ করলেন l চাষী, ব্যবসায়ী থেকে গ্রাহক সবাই পড়লো সরকারি বাবুদের দুর্নীতির ফাঁদে l উনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন, কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে l এবার উনি সিকিমকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে অতি-জাতীয়তাবাদের তাস খেললেন l কিন্তু অর্থনীতি নিজের পথেই যাওয়া শুরু করলো l মুদ্রাস্ফীতি 33% এ পৌছালো 1975 এ l সঙ্গে বেকারত্ব শীর্ষে পৌঁছালে, উনি জরুরি অবস্থা জারি করলেন l ( হয়তো সবার মনে আছে, গতবছর ভোটের আগে কংগ্রেস সভাপতি অভিযোগ করেছিলেন 45 বছরের বেকারত্বের রেকর্ড ভেঙেছে মোদী সরকার, এটা সেই 1974-75 এর বেকারত্বের রেকর্ড )
এছাড়া নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে শুরু হল করের পয়সায় গনহারে জাতীয়করণ l কি পেল এই জাতীয়করণে দেশ? ধরা যাক ইস্কো জাতীয়করণ l বেচে গেল আগের মালিক ও কর্মীরা l কিন্তু দেশবাসী? যাদের করের পয়সায় এটা কেনা হল? অদক্ষ এই কোম্পানির বেশী দামের লোহা এরা কিনতে পারতেন? নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কজন সরকারি চাকুরীজীবি নিজের বাড়ি বানাতে পারতেন পারতেন? কজনের বাড়ি টিভি, ফ্রিজ, গ্যাস, ছিল l বিদ্যুৎ ছিল কটা গ্রামে?
কিন্তু এতো সারা দেশের ব্যাপার? তাহলে, পশ্চিমবঙ্গ একা ভুগলো কেন? একা পিছিয়ে গেল কেন? কেন এর প্রভাব শুধু এই রাজ্যেই স্থায়ী ছাপ রেখে গেল l এর কারণ এই রাজ্যের ছয়ের দশকের দ্রুত রাজনৈতিক রূপান্তর, যা দেশের মধ্যে অতুলন ছিল l তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ বিদেশী বিনিয়োগের মূল জায়গা ও দেশের 40% জিডিপির অংশীদার ছিল l ঝড়ে সবচেয়ে বড় গাছ আগে পরে l
পশ্চিমবঙ্গ বেশ কটি নেতিবাচক রাজনৈতিক রূপান্তর একসাথে দেখল একই বছরে l 1967 এর চারটা বড় পরিবর্তন নিয়ে এখানে আলোচনা করা যাক l
- অতুল্য ঘোষের পতন : প্রফুল্ল সেনের পরাজয়ে অতুল্য ঘোষের রাজনৈতিক ক্ষমতা শেষ হয়ে গেল l সুভাষ বোস, শ্যামাপ্রসাদের পর যদি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কোন বাঙালী মুকুটহীন সম্রাটের ভূমিকা পালন করেন, তিনি এই অতুল্য ঘোষ l উনি ছিলেন কিং মেকার ও ভারতীয় রাজনীতির সেই সময়ের মেকিয়াভেলী l নেহেরুর মৃত্যুর পর উনি মোরারজি দেশাইকে না বসিয়ে শাস্ত্রীজিকে প্রধানমন্ত্রী করেন l এর দুবছর পর শাস্ত্রীজির সোভিয়েত ইউনিয়নে অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে, ইন্দিরা গান্ধী, বি বি মিশ্র, বাবু জগজীবনরামরা এই অতুল্য ঘোষের সাহায্য নিয়েই আবার মোরারজিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরান ও ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করেন l কিন্তু ঘোষ বা কামরাজ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে গলার কাঁটা ছিলেন, যেমন বৈরাম খাঁ ছিলেন সদ্য যুবক হাওয়া আকবরের কাছে l 1967 তে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে হারাতে যে বাংলা কংগ্রেস তৈরি হয়েছিল, অতুল্য ঘোষ রাজনীতি থেকে সন্যাস নিলে সেই দল 1969 তে গঠিত ইন্দিরা গান্ধীর নতুন দল কংগ্রেস (R) এর সহযোগী হিসেবেই কাজ করে l নিন্দুকেরা বলে, বাংলা কংগ্রেস ইন্দিরাজির নিজের তৈরি তার নিজের দলকে পশ্চিমবঙ্গে হারানোর জন্য l
- সুবোধ ব্যানার্জীর উত্থান : 1967 এর নতুন সরকারের শ্রমমন্ত্ৰী তথা বিশিষ্ট SUCI নেতা সুবোধ ব্যানার্জীর রাজনৈতিক উত্থান আরেকটা বিপদ ডেকে আনল রাজ্যের শিল্পে l মন্ত্রিত্ব পেয়ে রাজ্যের সব শিল্পের পূর্ণ তথ্য সুবোধ ব্যানার্জীর হাতে চলে এল l ইন্দিরা গান্ধী তখন সোভিয়েত রাশিয়ার চাপে বিদেশী পুঁজি তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত আর অধিকাংশ বিদেশী কোম্পানি আছে এই কলকাতায় l যুক্তফ্রন্ট সরকার দুটি আলাদা ফ্রন্টের জোট ছিল l প্রথমটি People’s United Left front ( CPI, AIFB, বালশোভিক পার্টি ) ও দ্বিতীয়টি United Left Front ( CPM, SUCI & others ) l আর ছিল বাংলা কংগ্রেস, যারা এই দুই ফ্রন্টকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো l এই দলের নেতাদের নাম শুনলে অনেকেই আজ বিশ্বাস করতে পারবে না l ইন্দিরা গান্ধীর তিনজন সবচেয়ে বিস্বস্ত সেনাপতি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, গণিখান চৌধুরী ও প্রণব মুখার্জী l এই তিন নেতা রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন এতগুলো বামপন্থী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ও ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে, আজকের কোন কংগ্রেস নেতা সেটা জানেন? নিন্দুকেরা বলে, এরা সবাই পুতুল আর দড়িটা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর হাতে l উপরোক্ত PULF ছিল রাশিয়াপন্থি কমিউনিস্টদের ফ্রন্ট আর ULF ছিল চীন পন্থি l PULF ইন্দিরা গান্ধীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ULF ছিল না l কিন্তু SUCI এর সুবোধ ব্যানার্জী ইন্দিরা গান্ধীর কাজ সহজ করে দিলেন l প্রতি দিনে একটা একটা কোম্পানির সামনে ঝান্ডা নিয়ে ঘেরাও শুরু করে, তাঁদের বাধ্য করলেন জলের দরে কোম্পানি বিক্রি করতে l কিছু জাতীয়কারণ হল তারা পরের আড়াই দশক বেঁচে গেল l বাকিদের? বজবজ থেকে কল্যাণী কিংবা হাওড়া থেকে চুঁচুড়া শিল্পাঞ্চল তার সাক্ষী l (বিস্তারে পরে লিখছি )l তবে খেলাটা উনি শুরু করেছেন মাত্র l শেষ করেছেন চিত্তব্রত মজুমদার, জ্যোতিবাবু, শ্যামল চক্রবর্তী, অশোক মিত্র ও অসীম দাশগুপ্তরা l
- চারু মজুমদারের উত্থান: 1964 যখন নেহেরু সব বামপন্থীদের গ্রেপ্তার করলেন, জেলেই চীন ও রাশিয়াপন্থীদের লড়াই হল বলে শোনা যায় l চীনপন্থীরা সিপিএম গঠন করলেন বেরিয়ে এসে l চারুবাবু CPM থেকে বেরিয়ে নিজের দল গড়লেন l 1967 এ চারুবাবুদের ভাগে কিছুই জুটলো না l এবার ফজরুল হকের 1935 এর কৃষকপ্রজা পার্টির জমিবন্টনের দাবী নিয়ে ভাগ হওয়া বাংলায় নতুন অবতার হিসেবে আরও ভয়ঙ্কর রূপে জন্ম নিল নক্সাল আন্দোলন l প্রথমে শুরু হিন্দু জমিমালিকদের উপর আক্রমণ l সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজ যোগ দিল l হিন্দু কলেজ ছিল ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ‘IIM’ l 1967 এ তখনও দেশের প্রথম IIM কলকাতায় শুরু হয় নি l ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো হিন্দু কলেজ চালু করেছিল, তাঁদের ব্যাবসার ম্যানেজমেন্ট চালানোর মানব সম্পদ তৈরির জন্য l কিন্তু ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো যাদের হাতে শেয়ার বেচে চলে যাচ্ছে, তাঁদের তো শিক্ষিত লোক দরকার নেই l দেশি মালিকরা মামা-ভাগ্নে ম্যানেজমেন্ট প্রথায় বিশ্বাসী l প্রেসিডেন্সির ছেলেরা যোগ দিল চারুবাবুর দলে l কলকাতায় ব্যবসা তো দুরস্ত, বসবাস করা বিপদ হয়ে উঠল l
- জ্যোতি বসুর উত্থান : মাত্র তিন বছরের দল হলেও ULF ছাড়া সরকার গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ছিল l জ্যোতি বাবুকে উপমুখ্যমন্ত্রী করা হল l লীগ সিস্টেমে কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিএম আর নক্সালদের মারপিট শুরু হল l বলাই বাহুল্য, জ্যোতি বাবুর ব্যাপারে লিখতে গেলে একটা অনুচ্ছেদ কম বললেও কম হবে l একটা পর্ব, কিংবা একটা বই কম পরে যাবে l ওটা পরে আসছি l তবে বাংলার সবচেয়ে বড় বিপদের সূচনা হল l মাদ্রাসের সঙ্গে কলকাতার খেলা আলাদা ইন্দিরা গান্ধী ততদিনে বুঝে গেছেন l ওখানে কামরাজকে যারা ঘুম পারলেন তারা দক্ষিণপন্থি l কিন্তু এখানে বামপন্থী l প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যা দেশের কাছে বিষফোঁড়ার মত হয়ে গেল l আবার খুব কড়া হলেও চলবে না l রাশিয়া আছে দেশের কমিউনিস্টদের সঙ্গে l ইন্দিরা এই যুক্তফ্রন্ট থেকেই দলে আনলেন প্রণব মুখার্জী, গণিখান চৌধুরীকে l কিন্তু আরও একজনকে আনলেন যিনি পরের সাত বছর পশ্চিমবঙ্গের মুকুটহীন সম্রাট হলেন l আরেক বঙ্গসন্তান যিনি অতুল্য ঘোষের বিদায়ের ঠিক তিন বছরের মধ্যেই (1970) অলিখিত ভাবে দেশের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী চেয়ারটিতে এসে বসলেন l নেহেরুজি, শাস্ত্রীজির সময় যে চেয়ারে বসতেন অতুল্য ঘোষ, সেই চেয়ারে এবার বাংলার রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র l সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের প্রত্যাবর্তন l
পরের সাত বছর জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন একটু কম হল বটে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর নতুন দেশি মালিকদের আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কীয় জ্ঞানের অভাব, কারখানা চালানোর অভিজ্ঞতার অভাব ও দেশের প্রশাসনের সততার অভাব l কিন্তু সবচেয়ে বড় যে অভাব নতুন মালিকপক্ষের ছিল তা হল নীতি ও মূল্যবোধের অভাব l ফলে অধঃপতন বন্ধ হল না l মালয়েশিয়া ভেঙে সিঙ্গাপুর তৈরি হতেই পশ্চিমী দেশের বিনিয়োগকারীরা কলকাতা ছাড়ল l চা বাগানের মালিকরা গেল কিনিয়াতে l.খনি বিষয়ক কোম্পানিগুলি অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় l কলকাতার নাভিশ্বাস উঠতে বসেছে l ইন্দিরা গান্ধী বুঝলেন ভুল হয়ে গেছে l আগামী কয়েক বছর বাংলার ভাগ্যে আবার বেশ কিছু প্রাপ্তিযোগ এল, যা দিল্লি/বোম্বে/মাদ্রাসও পায় নি l বিশ্লেষণ আগামী পর্বে l
( চলবে )
লেখক : সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)
(লেখক বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা URS কনসাল্টিং ইন্ডিয়ার ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার )