হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি

আরে দাদা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি কি একজন নাকি? বাঙ্গালি কি প্রতিভায় এতটাই দীন? বঙ্গভূমি হলাে প্রতিভার নন্দনকানন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নাকি রাসবিহারী বসু? বাঘা যতীন, নাকি মাস্টারদা? শ্রীরামকৃষ্ণ, নাকি স্বামী। বিবেকানন্দ? জগদীশচন্দ্র বসু, নাকি সত্যেন বসু? জয়দেব, নাকি রবীন্দ্রনাথ ? বঙ্কিম, নাকি শরৎ? অতীশ দীপঙ্কর, নাকি লালন ফকির ? কাকে ছেড়ে কাকে ধরি? তবুও দেখুন, বিবিসি বাংলা ফস করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির প্রতিযােগিতা করে বসল, আর সেই প্রতিযােগিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি ঘােষিত হলেন মুজিবুর রহমান। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে আজকাল বাঙ্গালি শব্দটাই লােগমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাঙ্গালির প্রিয় উৎসব দুর্গাপূজা নয়, ইদ-উল-ফিতর। বাঙ্গালির প্রিয় খাদ্য মাছ নয়, গােস্ত! কোনােদিন। বলবে, বাঙ্গালির পােশাক ধুতি নয়, আরবি আলখাল্লা ! বাঙ্গালি হওয়ার সংজ্ঞাটাই তাে বদলে দিচ্ছে এরা! এসব দেখে সন্দেহ হচ্ছে, আমি সত্যিই বাঙ্গালি তাে?

যাক গে যাক! যে যা করে করুক, আমার মনে আমি ১০০ শতাংশ খাঁটি বাঙ্গালি। তাই বিবিসি যাক চুলাের দোরে, আমার মতাে করে আমি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি নির্বাচিত করতে চাই। যে কোনাে নির্বাচনেই কিছু প্রাথমিক নিয়ম ঠিক করতে হয়। আমার এই নির্বাচনে বাবার চেয়ে ছেলেকে বড়াে দেখানাে চলবে না। যেমন শরৎচন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন রবিঠাকুরের কাধে, রবিঠাকুর আবার দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্কিম-জয়দেব-বিদ্যাপতির কঁাধে। শরৎচন্দ্রকে মান দিতে গিয়ে তাঁর পূর্বসূরীদের যেন অপমান না ঘটে ! গােড়ায় যেতে হবে। কিন্তু খুব বেশি গােড়ায় গেলেও চলবে না। যেমন, চর্যাপদ না হলে পদাবলী হতাে না। কিন্তু সাধক ভুশুকুপাদের কতটা প্রভাব আজ আছে এই বঙ্গভূমিতে? সেটাও ভারতে। হবে। এই গেল প্রথম নিয়ম। দ্বিতীয় নিয়ম হলাে অধ্যাত্ম জগৎ থেকেই কাউকে বাছতে হবে। কারণ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ধর্মই আমাদের। আত্মা। কবিতা থেকে বিজ্ঞান, সবই তাে অধ্যাত্ম থেকেই অনুপ্রাণিত। বিশ্বাস হয় না? বিজ্ঞানীশ্রেষ্ঠ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনী ও সাহিত্যকীর্তি পড়ে দেখুন।

বাঙ্গালি হিন্দুদের মধ্যে মূলত দু’রকম উপাসনা পদ্ধতি প্রচলিত আছে—শাক্ত ও বৈষ্ণব। আধুনিক বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক চৈতন্যদেব। সেই নিরিখে, আধুনিক শাক্তধর্মেরও একজন প্রবর্তক রয়েছেন। তার নাম কৃষ্ণানন্দ। আগমবাগীশ। যাবতীয় প্রচলিত তন্ত্রসাধনার নির্যাস সংগ্রহ করে তিনি ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’ বলে একটা বই সংকলন করেন। মা কালীর আধুনিক রূপকল্পনার তিনিই রূপকার। তন্ত্রশাস্ত্রের তিনিই । ব্যাসদেব। আশ্চর্য ব্যাপার হলাে, নিমাই মিশ্র ও কৃষ্ণানন্দ মৈত্র অর্থাৎ চৈতন্যদেব ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ উভয়েই নবদ্বীপের একই চতুষ্পঠীর ছাত্র। ছিলেন! পাঁচশাে বছর আগে নবদ্বীপের সেই চতুস্পাঠীতে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, সেটা বাঙ্গালির আত্মাকে সমুলে বিনাশ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

চৈতন্যদেবের জীবদ্দশাতেই বৈষ্ণব আন্দোলন সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজিদমন বা রূপ সনাতন যবন হরিদাসেই তা শেষ হয়নি। চৈতন্যের প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম আচার্য প্রভুপাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে পৌঁছয়। আচার্য প্রভুপাদের কৃপাতেই আজ পৃথিবীর এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ সনাতন ধর্মের অনুগামী, যাদের সঙ্গে ভারতের রক্তের সম্বন্ধ নেই দূর দূর পর্যন্ত। কাণ্ড দেখুন—একদিকে কিছু তথাকথিত বাঙ্গালির সন্তান নিজের ধর্মকে বােঝার জন্য মাস্টার রেখে আরবি শিখছে, অন্যদিকে এইসব বিদেশি বৈষ্ণবরা চৈতন্য চরিতামৃত পড়ার জন্য বাংলা শিখছে! বাঙ্গালির আত্মবােধ রক্ষায় চৈতন্যদেবের প্রভাবের এর চেয়ে বড় নিদর্শন আর কী দেবাে? ইন্টারনেটে বেশ কিছু ভিডিয়াে আছে, ইস্কনের সন্ন্যাসীরা কীভাবে পৃথিবী জুড়ে চৈতন্যদেবের ধর্মমত প্রচার করছেন, সেই নিয়ে। দেখলাম এঁরা বিভিন্ন গোঁড়া ইসলামিক দেশে ঢুকে পথচলতি লােকজনের হাতে গীতা ধরিয়ে দেন। ‘আপনিও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, আমিও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। এই গীতা হলাে সেই এক ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাণী!” এই বলে আলাপ জমিয়ে নেন। কৃষ্ণনাম পৌঁছে যায় এমন সব জায়গায়, যেখানে যাওয়ার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমার কিছু পরিচিত লােকজন আছে, যাদের এখনাে বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজন আছে। তাদের। কাছেই শুনেছি, বাংলাদেশের হিন্দুরা অনেকেই ইসলামিক আগ্রাসন ঠেকানাের জন্য নিজেদের সম্পত্তি ইস্কনকে লিখে দেয়। ইস্কন রাতারাতি সেখানে আশ্রম। বানিয়ে সংকীর্তন শুরু করে। জেহাদিরা ভয় পায় ইস্কনকে।

এতাে গেল চৈতন্যদেবের কথা। এবার কৃষ্ণানন্দের বা বৃহত্তর রূপে দেখতে গেলে শাক্ত প্রভাবের কথায় আসি। শােনা যায়, মিরকাশেমের জেল থেকে বেরিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের। জীবনের লক্ষ্য বদলে যায়। বাঙলার অধিকাংশ হিন্দু জমিদারদের সঙ্গেই তার ছিল গভীর সখ্য। এই জমিদারদের নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে নিজের অবশিষ্ট জীবদ্দশাতেই শারদীয়া দুর্গাপূজার পরম্পরাকে তিনি বাঙ্গালির জনজীবনের অঙ্গীভূত করে ফেলেন। কৃষ্ণানন্দের শিষ্য সাধক রামপ্রসাদ, যিনি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন, তার প্রভাবে শাক্ত ভক্তি আন্দোলনের যে জোয়ার এল, তার ফলেই আমরা পেলাম রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, অরবিন্দকে। তার থেকেই জন্ম নিল অনুশীলন দল, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। স্বাধীনতা পেল ভারত। ভারতের স্বাধীনতা চেতনার মূল স্রোত যে গঙ্গোত্রী থেকে উৎসারিত, সেই বন্দে মাতরম্‌, সেই দেশমাতৃকার কল্পনা, সেও তাে শাক্তধর্ম থেকেই এসেছে।

একটা দিন ছিল, যখন হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী আর গান্ধার থেকে ব্রহ্মদেশ অখণ্ড ভারতবর্ষের কেন্দ্রে ছিল বঙ্গভূমি। আর আজ? বাঙ্গালি আজ কোণঠাসা প্রান্তিক খণ্ডিত এক জনগােষ্ঠী। আজ এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এখান থেকে বাঙ্গালির পূর্বগৌরবের পরিস্থিতিতে কী করে ফিরে যাওয়া যায়? যাওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের ভৌগােলিক কেন্দ্রে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ, পুরনাে অখণ্ড ভারতের মানচিত্রকে পুনর্জীবিত করতে হবে। অসম্ভব? এককালে মনে হতাে, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মিলন অসম্ভব। আর আজ? আমাদের ধ্যেয়পথের। মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু বিজাতীয় এক প্রতিবিম্ব। নিজেদের হায়না ভাবা সিংহশিশুদের মনে বিদেশি আক্রমণকারী বিজেতাদের প্রতিবিম্ব এখনাে প্রবল। তাই তারা হায়নার দলে মিশে খেউ খেউ ডেকে বেড়ায়। সেই প্রতিবিম্বকে ভাঙতে হবে আরও শক্তিশালী এক বিজয়ীর প্রতিবিম্ব দিয়ে। সেই প্রতিবিম্ব চৈতন্য-কৃষ্ণানন্দের প্রতিবিম্ব। মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা সবসময় সঙ্গে একখণ্ড গীতা রাখতেন। বৈষ্ণব ও শাক্ত যখন একসঙ্গে একই উদ্দেশ্যে কাজ করে, তখন কী। মহাজাগরণ উপস্থিত হয়, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম তার প্রমাণ।

গােড়ার কথায় আসি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি কে? চৈতন্যদেব ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, এই দু’জনকেই আমি যুগ্মবিজয়ী ঘােষণা করলাম। তবে ঘােষণা করেই দায়ীত্ব থেকে নিষ্কৃতি হচ্ছে না। আজ থেকে পাঁচশাে বছর আগে নবদ্বীপের চতুষ্পঠীর দুই যুবক। নিমাই ও কৃষ্ণানন্দ যে কাজের সূত্রপাত করেছিলেন, প্রয়ােজন সেই বিপ্লবকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাতেই সিদ্ধিলাভ হবে বাঙ্গালির!

প্রবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.