উপেন্দ্রনাথের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ পড়লে মনে হয় নির্জলা-কৌতুকই অত্যাচার সইবার ‘রেসিপি

স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী, সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্মঃ- ৬ জুন, ১৮৭৯ – মৃত্যুঃ- ৪ এপ্রিল, ১৯৫০)(‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ এবং “সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান” অনুযায়ী)

উপেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন হুগলী জেলার চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায়। অল্প বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে ভারবর্ষের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। পরে আবার সংসারে ফিরে আসেন। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। এই সময়েই ‘যুগান্তর’ পত্রিকা গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৭ সালে আলিপুর বোমার মামলায় অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও আরও কিছু বিপ্লবীর সঙ্গে উনিও ধরা পড়েন। ১৯০৯ সালে ওঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১২ বছর কারাদণ্ড ভোগের পর উনি মুক্তি পান এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘নারায়ণ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। পরে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের সঙ্গে ‘বিজলী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর পর তিনি প্রকাশ করেন বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘আত্মশক্তি’। এই সময়ে দেশ-বিরোধী লেখার জন্য ইংরেজ সরকার আবার ওঁকে ৩ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। মুক্তিলাভের পর বিভিন্ন সময়ে তিনি লিবার্টি, অমৃতবাজার পত্রিকা, দৈনিক বসুমতী ইত্যাদি সংবাদপত্রের সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ ৫ বছর তিনি দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক ছিলেন।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নির্বাসিতের আত্মকথা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি স্বয়ং শান্তিকেতনে ক্লাশ করার সময়ে ছাত্রদের বইটি পড়তে বলেছিলেন (‘ময়ূরকণ্ঠী’ – সৈয়দ মুজতবা আলী)। বইটি মূলতঃ উপেন্দ্রনাথের আন্দামানে কারবাসের কাহিনী ও জেলে যাবার আগেকার কিছুদিনের কথা। বইটি উপেন্দ্রনাথ লিখেছেন হাল্কা চালে। যেমন-” ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে তখন শীতকাল। আসর বেশ গরম হইয়া উঠিয়াছে। উপাধ্যায় মহাশয় সবেমাত্র ‘সন্ধ্যা’য় চাটিম চাটিম বুলি ভাঁজিতে আরম্ভ করিয়াছেন; অরবিন্দ জাতীয় শিক্ষার জন্য বরোদার চাকরি ছাড়িয়া আসিয়াছেন; বিপিনবাবুও পুরাতন কংগ্রেসীদল হইতে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন; সারা দেশটা যেন নূতনত্বের প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে। আমি তখন সবেমাত্র সাধুগিরির খোলস ছাড়িয়া জোর করিয়া মাস্টারিতে মনটা বসাইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় এক সংখ্যা ‘বন্দেমাতরম্’ হঠাৎ একদিন হাতে আসিয়া পড়িল। ভারতের রাজনৈতিক আদর্শের কথা আলোচনা করিতে করিতে লেখক বলিয়াছেন – ‘We want absolute autonomy from British control’। ……একেবারে ছাপার অক্ষরে ঐ লেখাগুলি দেখিয়া আমার মনটা তড়াং করিয়া নাচিয়া উঠিল।”উপেন্দ্রনাথ বেশ কিছু বই লিখেছেন: ‘উনপঞ্চাশী’, ‘পথের সন্ধান’, ‘ধর্ম ও কর্ম’, ‘স্বাধীন মানুষ’, ‘জাতির বিড়ম্বনা’, ‘ভবঘুরের চিঠি’, প্রভৃতি। কিন্তু ওঁর শ্রেষ্ঠ বই নিঃসন্দেহে ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’। বইটি পড়ে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী লিখেছিলেন, “….. কেটেছে লোটাকম্বল হাতে তীর্থে তীর্থে ঘুরে, বা জেলের নির্জন কুঠুরীর অকথ্য কষ্টের মধ্যে বসে’, বা আন্দামানের অপমানের কশাঘাতের জ্বালা সয়ে, – কেটেছে রোষে, ক্ষোভে, নিরাশায়, উত্কণ্ঠায়, – কেটেছে অর্ধাশনে, অনশনে, প্রাণান্ত পরিশ্রমে, অসাধারণ যন্ত্রণায়। ১২/১৪ বত্সর এইরূপ জীবন যাপনের পর পাগল না হয়ে উল্টে যার হাত থেকে এই রকম বই বেরোয়, তার হাতের পেছনে যে মন আছে, সে মন আমাদের নমস্য।”
সেই সময়ে কলকাতা থেকে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সেটা ছিলো একটি বিপ্লব কেন্দ্রের মুখপত্র। উপেন্দ্রনাথ লিখছেন, “কলকাতায় যুগান্তর অফিসে আসিয়া দেখিলাম ৩/৪টি যুবক মিলিয়া একখানা ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া ভারত উদ্ধার করিতে লাগিয়া গিয়াছেন। যুদ্ধের আসবাবের অভাব দেখিয়া মনটা একটু দমিয়া গেল বটে, কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। গুলি-গোলার অভাব তাঁহারা বাক্যের দ্বারা পূরণ করিযা দিলেন।”
কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রনাথ যুগান্তরের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত হলেন। আলিপুর বোমার মামলায় ওঁর আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হল। আন্দামানে বন্দীদের অমানুষিক পরিশ্রম করানো হত। কাজে ফাঁকি দিলে জুটতো নানাবিধ অত্যাচার। সেই প্রসঙ্গে উনি লিখছেন, “……মাঝে মাঝে দুই-একজন ওস্তাদ মিলে যাহারা কাজের ভয় পাগল সাজে। একজন বাঙালীকে ঐরূপ দেখিয়াছিলাম। একদিন বেগতিক বুঝিয়া সে মাথায় কাপড় বাঁধিয়া গান জুড়িয়া দিল। চোখে চোনের সামান্য গুঁড়া লাগাইয়া চোখ লাল করিয়া লইল; আর আবোল-তাবোল বকিতে আরম্ভ করিল। ভাত খাইবার সময় মুখ ফিরাইয়া বসিয়া রহিল। প্রহরীরা তাহাকে জেলারের ধরিয়া লইয়া গেল। জেলার গোটা দুই কলা আনিয়া তাহার হাতে দিলেন। সে কলা দুটো খাইয়া পরে খোসাগুলোও মুখে পুরিয়া চিবাইতে লাগিল। জেলার স্থির করিলেন লোকটা সত্য সত্যই পাগল; তা’ না হইলে খোসা চিবাইতে যাইবে কেন?লোকটা ফিরিয়া আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম – “হ্যাঁরে, খোসা চিবুতে গেলি কেন?”সে বলিল – “কি করি বাবু সাহেব, বেটাকেতো বোকা বানাতে হবে। একটু কষ্ট না করলে কি আর পাগল হওয়া চলে?”
ব্যথা-বেদনার অনেক গভীর অনুভূতিও তিনি প্রকাশ করেছেন এই রকম লঘু সুরেই। কিন্তু পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হয় না কী নিদারুণ দৈহিক ও মানসিক অত্যাচারের মধ্যে তাঁর বন্দীজীবন কেটেছে। যে অত্যাচারে উল্লসকর দত্ত ও বালেশ্বর মামলার জ্যোতিষচন্দ্র পাল পাগল হয়ে গিয়েছিলেন বা ইন্দুভূষণের গলায় ফাঁস লাগিয়ে বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ, তাতে রুষ্ট, ক্ষুব্ধ বা হতাশ বোধ করলেও, তাঁর মনোবল শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। উনি গেরুয়া বসন ছেড়েছিলেন বটে, কিন্তু সন্ন্যাসী-মনটা ত্যাগ করতে পারেন নি। তাই নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করতে পেরেছেন সহজ হাল্কা সুরে। আমার কাছে সেটাই এই আত্মকথা-র সবচেয়ে বড় গুণ।সৈয়দ মুজতবা আলী একবার উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন: “আমার ইচ্ছে ছিল দেখবার যে বারো বত্সর নরকযন্ত্রণার পর তিনি যে তাঁর নিদারুণ অভিজ্ঞতাটাকে হাসি-ঠাট্টার ভিতর দিয়ে প্রকাশ করলেন তার কতখানি সত্যই তাঁর চরিত্রবলের দরুণ – এই বিশেষরূপ নিল আর কতটা নিছক সাহিত্য-শৈলী মাত্র।”তাঁর চরিত্রবল আলী সাহেব কিভাবে মেপেছিলেন সেটা অবশ্য বিশদ করেন নি, তবে লিখেছিলেন, “আমার মত একটা আড়াই ফোঁটা ছোকরাকে যে আদর করে কাছে বসালেন, তার থেকে তত্ক্ষণাৎ বুঝে গেলাম যে, তাঁর ভিতর মানুষকে টেনে আনবার কোন আকর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল, যার জন্য বাঙলাদেশের তরুণ সম্প্রদায় তাঁর চতুর্দিকে জড় হয়েছিল।”

পরাধীন ভারতের বিপ্লবীদের কী খাবার জুটত সেই কালাপানির জেলখানায়? উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যুগান্তর দলের কর্মী, বোমার মামলায় ধরা পড়ে শেষে চালান হলেন আন্দামানে। কলকাতার জেলে বরাদ্দ লপসি – ফেন মেশানো হলে সাদা, ডাল মেশানো হলে পীত, আর গুড় মেশানো হলে লাল। কোনও দিন এক বাটি রেঙুন চালের ভাত, খানিকটা অড়হর ডাল, পাতা ও ডাঁটা সেদ্ধ, সঙ্গে তেঁতুল গোলা। তবে বিপ্লবীরা টের পেলেন ‘পয়সা থাকিলে’ সেকালেও ‘জেলখানার মধ্যে বসিয়াই সব পাওয়া যায়।’ দক্ষিণা অনুযায়ী ভাতের ভিতর কই মাছ, রুটির ভেতর আলু-পেঁয়াজের তরকারি, পাহারাওয়ালার পাগড়ির ভেতর পান-চুরুট । আন্দামানে সে নবাবি নেই। কথায় কথায় হাতে পায়ে বেড়ি আর পেনাল ডায়েট ‘কঞ্জি’। কঞ্জি মানে খানিকটা খুদ ফুটিয়ে দেওয়া। বেশ কয়েক বছর থাকার পর ধর্মঘট ইত্যাদি করে বারীন্দ্র, হেমচন্দ্র, উপেন্দ্রনাথ জেলে খানিকটা সুখের মুখ দেখলেন। কচুপাতা সেদ্ধ আর তাদের খেতে হবে না, সকাল দশটা থেকে বারোটার মধ্যে নিজেদের রান্না তাঁরা নিজেরা করবেন। হেমচন্দ্র নাকি খানিক রাঁধতে পারতেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী গম্ভীর ভাবে রান্না শুরু হল — মোচার ঘণ্ট । পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে কালো রঙের যে পদার্থটি শেষ অবধি পাতে পড়ল তা একেবারে ‘মোচার কাবাব’। এক দিন ঠিক হল শুক্তো করা হবে। হেমচন্দ্রের অনবদ্য প্রণালী, ‘তরকারির মধ্যে এক আউন্স কুইনাইন মিক্চার ফেলিয়া দিলেই তাহা শুক্তো হইয়া যায়।’ উপেন্দ্রনাথের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ পড়লে মনে হয় নির্জলা-কৌতুকই অত্যাচার সইবার ‘রেসিপি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.