একবাটি টক দই, দুটো রুটি ও পোস্তর বড়া- এই খেয়েই দৌঁড় লাগালেন ট্রেন ধরার জন্য। আয়োজন ছিল অনেক কিছু। মাছ ভালোবাসেন, তাই নানারকম মাছ ও তরিতরকারি রান্না হয়েছিল আমার ই আবদারে।
কেশবভবনের মেডিক্যাল খাবারে অভ্যস্ত প্রচারকেরা অনেকেই আমার মায়ের রান্নার গুণগ্রাহী। বাবা বললেন, নামে আমীর! কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে তো দেখছি একেবারেই ফকিরি!
আমীরচাঁদ জী বললেন, অন্য সময়ে এসে খাব। এখন একটা সংকল্পে আছি। অধিক আহার গ্রহণ করছি না।
বাবা জ্যেঠা সুভাষ বসুর অনুগত, ছোটবেলায় বাড়ির অন্য দিদিদের সঙ্গে কাপড়ের নীচে লুকিয়ে বোমা পিস্তল নিয়ে বিপ্লবীদের আখড়ায় পৌঁছে দেওয়া আমার মাও বিলক্ষণ জানেন দেশের জন্য সংকল্প – এই কথার প্রকৃত অর্থ।
আমীর চাঁদ ছুটছেন উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে। ভারত সরকারের “লুক ইস্ট” পলিসি কার্যকর করার অনেক আগেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ধ্বস্ত উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ভারতীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটানোর কাজ শুরুর সংকল্প রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের।

কাজটা শুনতে যতটা আনন্দের, বাস্তবে কিন্তু অত্যন্ত ভয়ানক।

ত্রিপুরা থেকে জঙ্গিরা সংঘের প্রচারক কার্যকর্তাদের অপহরণ করে হত্যা করার ঘটনায় সংঘ দমে না গিয়ে জোর কদমে জাগরণের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল। কোথাও ক্রীশ্চান মদতে আবার কোথাও মুসলিম জিহাদী শক্তির রমরমা। ভারত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করার ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে একজোট গোটা সঙ্ঘ পরিবার।

কোলকাতা কে কেন্দ্র করে আমীরচাঁদজী উত্তরপূর্বাঞ্চলের পাহাড় পর্বত চষে বেরিয়েছেন। খুঁজে বার করেছেন প্রাচীন জনজাতির অপূর্ব সব শিল্পকলা। অরণ্য অধ্যুসিত মানুষ, সূর্য যাদের মুখ দেখে নি, তাদের নিয়ে এসেছেন নয়া দিল্লির রাষ্ট্রপতিভবনের প্রাঙ্গনে। সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্যে পরিপূর্ণ ভারতীয় সংস্কৃতিকে সংস্কার ভারতীর মাধ্যমে তুলে ধরা- এ এক অভাবনীয় সাফল্য।

আমার এখনো মনে আছে- প্রভাতের নতুন সূর্যকিরণে নববর্ষবরণ অনুষ্ঠান গুয়াহাটিতে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। শেষ চৈত্রের অস্তাচলে যাওয়া সূর্যকিরণ গায়ে মেখে শিল্পীরা অপেক্ষা করবেন নব প্রভাতের। এক অপুর্ব ভাবনা! রূপকার আমীরচাদঁ। নদীর তীরে বিশাল মঞ্চে সেই অপূর্ব অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে উপস্থিত হয়েছেন হাজার হাজার জনতা। ভূপেন হাজারিকা, অনুপ জালঠা, সোনাল মান সিং, শেখর সেন- কে নেই সেদিনের উতসবে?
শুনেছিলাম, জিহাদি মদতে আলফা এবং আরো জঙ্গি সংগঠনের রমরমার আসামে রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক ক্ষমতা নিয়ে গৌহাটিতে এতবড় কার্যক্রমে ভয় পেয়েছিলেন খোদ পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক সুদর্শনজী। বারবার তিনি খবরাখবর নিয়েছেন।
সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে এমনই দৃঢ়চেতা ছিলেন আমীরচাঁদজী।

উত্তরপ্রদেশের বালিয়ার স্বয়ংসেবক, সঙ্ঘের জেলা প্রচারক আমীরচাঁদ, সংস্কার ভারতীর অখিল ভারতীয় সংগঠনের দায়িত্বে এসে দেশের রাষ্ট্রবাদী সমস্ত শিল্পী কলাকুশলীদের সঙ্গে এমন চমৎকার সখ্যতা গড়ে তুললেন যা সংস্কার ভারতীর কাজে জোয়ার এনে দিল। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হেনে কাশীতে চলচ্চিত্রকার দীপা মেহতার ওয়াটার ছবির কাজ বন্ধ করে দেওয়ার সাহসী পদক্ষেপের মধ্যে দিয়েই আমীরচাঁদজীর কাজের পরিচয়।

সবসময় সৃষ্টিশীল, অভিনব, অপূর্ব সব ভাবনা চিন্তা মাথায় খেলত। উড়িষায় মহানদীর তীরে নবপ্রভাতের অনুষ্ঠানের চিত্র দেখে রাগতস্বরে বলেছিলাম কোলকাতায় থাকেন অথচ অনুষ্ঠান করে বেরান গোটা দেশে। এখানের জন্য ভাবনা চিন্তা নেই কেন?
ছলছল করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “ কলকাতায় বড় বড় চিন্তাবিদেরা রয়েছেন। আমার পরিকল্পনা তারা মানবেন কেন?” বুঝলাম, বড় অভিমানে ঘা মেরেছি! আর দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন করার সাহস হয় নি।
বাঙ্গালীর ভাষা, বাঙ্গালীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কীর্তন, উপাসনা বাদ্য ঢাক, ঢোল, শ্রীখোল ইত্যাদিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার কাজে আমাদের সমবেত প্রয়াস তাঁর কানেও পৌঁছে ছিল। গত জানুয়ারি মাসে কোলকাতায় ক্ষেত্রীয় বৈঠকে এবং এরপর একদিনের ঝটিকা সফরে কোলকাতায় এসে বলেছিলেন ‘প্রবীর তুমি হাল ছেড় না। আমাকে দেখেছো তো! কত বিরোধীতা সত্বেও সংকল্পে অবিচল থেকেছি। বাধাই যদি না আসে তাহলে বড় কাজ কিসের?’

হিলালয় ছিল তাঁর বড় প্রিয়। বছর কয়েক আগে বলেছিলেন, অনেক হল সংস্কার ভারতীর কাজ। বাকি জীবন কাটাব হিমালয়ে, নৈমিষারণ্যে। এক বৃহত স্বপ্নের পরিকল্পনা রয়েছে সেখানে। তবে, ২০১৮ য় দিল্লি অধিবেশনে আমীরচাঁদজীর হাতেই তুলে দেওয়া হল সংগঠনের নেতৃত্বভার। আশা ছিল স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে সুচারু পরিকল্পনায় তিনি ফুটিয়ে তুলবেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনত্তোর ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক চালচিত্র। কাজ শুরু করেও দিয়েছিলেন। ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন গোটা দেশ।
উপরাষ্ট্রপতির আসন্ন অরুণাচল প্রদেশে চীনের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ডাক দিয়েছেন অরুণাচল চলো। পঁচাত্তরজন জওয়ান দিল্লে থেকে বাইক রযাূরলিতে অরুণাচল। শেলা পাসে পাহাড় চিরে গুহা পথ তৈরি করায় নরেন্দ্র মোদী সরকারের অসামান্য সাফল্য। ধরে রাখা যায় নি আমিরচাদঁজীকেও। অরুনাচল যে তাঁর বড় প্রিয় জায়গা। প্রতিটি পাহাড়, অরণ্য তাঁর চেনা। জনজাতির মানুষজন সঙ্গে নিয়ে এই বিজয় আনন্দে মেতে উঠতে তিনিও। পৌঁছুলেন তাওয়াং। সমুদ্রতল থেকে দশ হাজার ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের এই প্রান্তসীমায়।

প্রাচীন ভারত-তিব্বতের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে তাওয়াং হোল এক অসামান্য পার্বত্য এলাকা। যুগযুগ ধরে ভারতীয় ঋষি মুণিরা এই পথ ধরেই তো বহির্ভারতে ছুটে গেছেন বিদ্যা চর্চা আর সাংস্কৃতিক আদান প্রদানে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আমীরচাঁদজী। অক্সিজেনের অভাব অনুভব করায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্থানীয় সামরিক হাসপাতালে। না!কিছুটা সফল হলেও শেষ চেষ্টায় তারা বিফল। ধরিত্রী মাতা তাঁর সু সন্তানের জন্য কোল পেতে বসে আছেন। এই যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। আরো একটি বড় প্রিয় জায়গা, তা হোল কাশী। বাবা মহেশ্বর এবং মা অন্নপূর্নার চরণেই অগ্নিশুদ্ধ হয়ে চির বিদায় নেবেন আমাদের সকলের প্রিয় আমীরচাঁদ।

প্রবীর ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.