যুদ্ধ ও সংগ্রাম আমাদের প্রতিনিয়ত করতে হয়। কৃষিক্ষেত্র থেকে যুদ্ধক্ষেত্র; গোষ্ঠী আক্রমণ থেকে বৈদেশিক আক্রমণ — সব ক্ষেত্রেই টিকে থাকার লড়াই জারী থাকে, জয়ী হবার অদম্য বাসনা স্থান পায়। জীবনের লড়াইয়ে নামার পথে প্রেরণাদায়ী সুভাষণ যেমন আছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে, আছে ব্রত-পালপার্বণের নানান বৈচিত্র্য। ভাইফোঁটার প্রকৃত তাৎপর্য হয়তো লড়াইয়ের ময়দানে যাবার আগে সহযোগিতা, সমমর্মিতার প্রকাশস্থল। তারই নৈকট্য ও অবয়ব বড় করার অনুষ্ঠান। ভ্রাতৃত্বের জগৎ যতটা বাড়বে, জয়ের সীমানা ততটাই বেড়ে যাবে। দোরগোড়ায় জয়ধ্বনি দিয়েই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জয়ের পরিকল্পনা শুরু করতে হয়। যমের দুয়ারে কাঁটা ফেলে ভাইকে জীবনযুদ্ধে অতিরিক্ত সাহস যোগান বোন। যুদ্ধে যাবার পথে বিজয়ী হবার শুভকামনা জানান ভগিনীমন্ডলী। বোনের মান-মর্যাদা-ইজ্জত রক্ষা করার শপথ নেন ভাই। আর ফিরে এসে তারই বিজয়োৎসব চলে, এর মধ্যেই চিরকালীন যুদ্ধ-চারণা বা War-lore এর জন্ম। ভাইফোঁটার মধ্যে এই দুই অনুভব, অব্যক্ত-কথন কালের গতিতে সংযুক্ত হয়ে গেছে কখন, তার টেরও পাইনি।
অতীত-চারণার মধ্যে তার রূপক-সংকেতগুলি সরিয়ে মূল-কাঠামো বের করার মধ্যেই তার যথাযথ তাৎপর্য। ভাই যাবে যুদ্ধে, সংগ্রামে — জীবন সংগ্রাম থেকে ধর্মযুদ্ধে। সর্বত্রই তাকে জয়ী দেখতে চান ভগিনীবৃন্দ। তাই প্রয়োজন হয় মানসিক শক্তি বিতরণের প্রয়াস। দৈনন্দিন ঘরকন্নার কাজে নিয়ত নির্ঝরিণীর মতো ভগিনীদের সমবেত উদ্যোগ গ্রহণ, আর বাইরের অশুভ শক্তিকে প্রবল বিরুদ্ধাচারণের মধ্যে দমন করা, জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার মধ্যেই ভাইবোনের চিরকালীন জীবনচর্যা। তারই আলোকে ভাইয়ের কপালে বোনের জয়তিলক পরানোর পার্বণ। যমে-মানুষে টানাটানির মধ্যেই বেঁচেবর্তে থাকার শাশ্বত প্রয়াস। আবহমান কাল ধরে প্রচলিত সংস্কৃতির মধ্যে তার কতটা খোঁজ আমরা রেখেছি? কতটাই বা সুলুকসন্ধান করেছি? বোনের মান-ইজ্জত বাঁচাতে কখন ভাইকে অস্ত্র ধরতে হবে, কখন ধর্ষককে প্রতিহত করে সমাজকে সুন্দর রাখতে হবে — তার ইতিবৃত্ত যদি আমরা অনুমান করতে অসামর্থ্য হই, তাহলে আমরা অনেক জরুরি বিষয়কে বুঝতে অপারগ হবো। লাভ-জেহাদ, নারী মাংসের পিন্ড ভোগ-লালসার সংস্কৃতি যেখানে ধর্মের মোহে অত্যাচার হয়ে দেখা দেয়, সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়াকে তার বিপ্রতীপে সজাগ ও সক্ষমতার লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দেবে। হিন্দু ভাই-বোনের সম্প্রীতির দ্যোতক হয়ে উঠবে সেই পরব।
একটি অনাথ বালকাশ্রমে কেটেছে আমার ছোটোবেলা। ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে যেসব ছাত্রেরা বাড়ি যেতে পারতো না, আশ্রম কর্তৃপক্ষ অবস্থানরত ছোটো বালকদের দিয়েই অন্য ছাত্রদের ফোঁটা দেওয়াতেন। ভালোমন্দ খাবারের বন্দোবস্ত থাকতো। মহারাজরা বলতেন, এই ফোঁটা ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগ্রত করবে। বড় দাদারা জীবনের পথে দাঁড়িয়ে ছোট ভাইদেরকে স্বনির্ভর করে তুলবে, তাদের পড়াশোনার খোঁজ নেবে, কখনও পড়ানোর খানিক খরচ যোগাবে, প্রতিষ্ঠিত হবার নানান দিকদর্শন করবে, তারজন্যই আমাদের এই প্রয়াস। ভাইফোঁটায় বোনের অবস্থান যেমন অনেকটা কোমলতাকে রক্ষার জন্য, এখানেও অনাথ ছোটো ভাইদের প্রতিষ্ঠা করার শপথ নিক বড় দাদারা, আমরা এটাই আকাঙ্খা করি, জানিয়েছিলেন সেদিনের সন্ন্যাসীরা। হয়তো তাই। শরীরের কারণে নারী অনেকটা দুর্বল, তাদের রক্ষা করতে পারে ইস্পাত-সম পেশীবহুল পুরুষ। বয়সের কারণে আগে প্রতিষ্ঠা পাবে, আশ্রমের বাইরে আগে লড়াইয়ের ময়দানে নামবে উঁচু ক্লাসের বালকেরা। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে তারা কমবয়সীদের খোঁজ খবর নেবে, এটাই আশ্রম কর্তৃপক্ষের ভাবনা ছিল।
ভাইফোঁটাকে হিন্দু সমাজ আজ পবিত্র এক সামাজিক অনুষ্ঠান হিসাবে গ্রহণ করুক। আমাদের দেশের কোনো কোনো স্থানে বিশেষত সীমান্তবর্তী জেলা/শহর/গ্রামে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যখন দেখি হিন্দু মেয়েরা বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারে না; দূরে পড়াশোনা করতে যাওয়া নিরাপত্তার কারণে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়; লোলুপ নারী-লুণ্ঠনকারীরা দিনের নির্জনতায়, রাতের অন্ধকারে রক্তপিপাসু বন্য-শ্বাপদের মতো ওৎ পেতে থাকে; সেখানে ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়া কি পারে না, এই কোমলপ্রাণ হিন্দু নারীর সম্ভ্রম সমবেতভাবে রক্ষা করতে? পাশাপাশি হিন্দু বোনটি কি সক্ষমতায়, ক্ষাত্রতেজে দাদার সমান হয়ে ওঠার শপথ নিতে পারে না? পাড়া-মহল্লায় ভাইবোনের এক হয়ে শপথ নেওয়ার দিন হোক ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। এক পশুশক্তিকে নারীদেহ খুবলিয়ে খেতে দেওয়া চলে না, কোনো অবস্থাতেই নারীকে ভোগ্যপণ্য করে তোলা চলে না, কখনোই অবলাকে অশুভ শক্তির কাছে ছেড়ে দেশত্যাগ করা চলে না। ভাইফোঁটায় সহোদরা ভগিনী কেবল নয়, পুরো গ্রাম, শহর, নগরের সকল ভগিনীকে রক্ষা করার শপথ নিতে হবে; ভগিনীবৃন্দ তারজন্যই জয়-তিলক পরিয়ে দেবে সম্ভ্রম রক্ষাকারী সমন্বিত ভ্রাতৃশক্তিকে।
ভাইফোঁটায় ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যে ছড়া আবৃত্তি করা হয়, তাতে ভাই-এর আয়ু বৃদ্ধির প্রার্থনা আছে। ভাইকে অমর করার হোয়াইট ম্যাজিক যেন! মৃত্যুর দেবতা যমের দুয়ার থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার অগ্রীম মেয়েলি আচার। তা যমের লিখন রদ করার লক্ষণীয় প্রার্থনা, দীর্ঘ জীবনের এক অনাময় আকাঙ্খা, ভাইবোনের এক নিষ্কাম স্নেহ-শুভেচ্ছার বাতাবরণ —
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥”
এইজন্য ভাইফোঁটার নাম কোথাও কোথাও যমদ্বিতীয়া। যেহেতু কার্তিক মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই উৎসব, তাই ‘দ্বিতীয়া’। লোকবিশ্বাস এই, এদিন মৃত্যুর দেবতা যম তার আপন ভগিনী যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন, তাই ‘যমদ্বিতীয়া’। কেন যমুনা তার ভাইকে ফোঁটা দিলেন, তা আর এক লোকায়তিক কাহিনী। সূর্য (বিবস্বান) এবং সংজ্ঞার গর্ভে যম (বৈবস্বত) ও যমুনা নামক যমজ সন্তানের জন্ম হয়। তারপর দেখা যায়, সূর্যের প্রবল তাপ সইতে না পেরে ছেলেমেয়ে এবং নিজের ছায়াকে সূর্যালোকে রেখে ফিরে যাচ্ছেন সংজ্ঞা। এদিকে সেই ছায়াই হয়ে উঠলো সূর্যালোকের অধিশ্বরী। তারই দাপটে যম-যমুনা হলেন স্বর্গছাড়া। অবশেষে নানান ঘাত-প্রতিঘাতে যম হয়ে উঠলেন মৃত্যুপুরীর রাজা, পৃথিবীর নদী যমুনা হয়ে ঠাঁই পেলেন বোন। একদিন বোন নিমন্ত্রণ করলেন তার দাদাকে। দাদা এলেন, দাদার যথাযোগ্য যত্নআত্তি করলেন বোন, কপালে পড়ালেন টিকা। দুজনের অনেক গল্প হল, খাওয়া দাওয়া হল, তারপর ফিরে গেলেন দাদা। লোকবিশ্বাস সেই থেকেই যমদ্বিতীয়ার আয়োজন। যে দেবতা মৃত্যুর অধীশ্বর, তার কাছেই জীবনের প্রার্থনা — এ এক অপরূপ বৈপরীত্য।
শুধু বঙ্গদেশ নয়, ভারতের নানান অঞ্চলে ভাইফোঁটা নানান নামে উৎযাপিত হয়। কোথাও এর নাম ‘ভাইদুজ’ (পশ্চিম ভারত), কোথাও ‘ভাইবিজ’ (মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটক), কোথাও ‘ভাইটিকা’ (নেপাল, দার্জিলিং)। কোনো কোনো লোকবিশ্বাস এই রকম — শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রার কাছে ফোঁটা নিয়েছিলেন নরকাসুরকে বধ করার পর। এইভাবে অসুর বা অশুভ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধের প্রেরণা হয়ে ওঠে ভগিনীশক্তি। পৃথিবীতে ভগিনীর জন্য নিরাপদ বাসভূমি গড়ে তুলবে ভ্রাতা। ভাইফোঁটা মানে নারীশক্তির বসবাসের ভূমি প্রতিষ্ঠা করে নিরাপদ আলয় রচনার উৎসব। ভ্রাতৃশক্তি যত দ্রুত ভগিনীর গৃহ রচনা করে দিতে পারবে, ততই বাংলা ও ভারতবর্ষে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার উৎযাপন সার্থকতা লাভ করবে।
কল্যাণ গৌতম