একমাত্র ভরসার স্তম্ভ


আগে বলা হত গনতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক আর বিচারবিভাগীয়। আমাদের দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গনতন্ত্র। তাই এই তিনটি স্তম্ভই এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিনে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কোন স্থান নেই। আজকের আফগানিস্তানে বোরখা না পরার জন্য কোন গৃহবধূকে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয় তবে মেয়েটির বাড়ির কেউ কোন থানায় গিয়ে অভিযোগ করার কথা ভাববেই না।


আজ গনতন্ত্রের একটি চতুর্থ স্তম্ভ প্রচার মাধ্যম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও এই স্তম্ভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিল। বাংলার “হিন্দু প্যাট্রিয়ট” এর হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজের জীবন দিয়ে নীলকরদের বিরোধিতা করেছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ বন্দেমাতরম, কর্মযোগিন আর যুগান্তর পত্রিকায় দেশকে রক্ষা করার পথ দেখিয়েছেন। সাংবাদিকতার এক গৌরব আর সাহস দেশভাগের পরেও এই রাজ্যে তৈরি হয়েছিল। তাই জরুরী অবস্থার সময়ও কলকাতার সাংবাদিকদের কেনা যায়নি, ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।


শিল্পী, সাহিত্যিক আর প্রবুদ্ধ মানুষেরা কবিগুরুর ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির” সেই আপ্তবাক্যকেই ধরে ছিলেন। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও এই প্রতিবাদে বহুবার নিজের ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিশোরকুমারকে অনেক লোভ বহু ভীতি প্রদর্শন করেও জরুরিঅবস্থার সমর্থনে মুখ খোলাতে পারেনি। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সেই বছর কিশোরকুমারের গাওয়া গান দূরদর্শনের পর্দায় আর আকাশবাণীতে নিষিদ্ধ হয়েছিল। সেই বছর চলচিত্র “আঁধি” দেখানো বন্ধ হয়েছিল।


বাঙালির সেই মেরুদণ্ড আজ আর নেই। রাজনৈতিক বিরোধীতা গনতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের লক্ষ্মণ। সারা ভারতের অন্য সব রাজ্যে এক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা তৈরী হয়েছে। রাজনীতি এখন প্রায় কোথাও মধ্যযুগীয় বর্বরতার পর্যায়ে নেই। আলাউদ্দিন খিলজি বা চিঙ্গিস খাঁ বিজিত রাজ্যের মানুষের রক্তের নদী বইয়ে দিতেন, পরাজিত বিরোধী পরিবারের গনধর্ষনকেই জয়ের পুরস্কার মনে করতেন। আজ সারা পৃথিবীর উন্নত দেশের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সভ্য রাজনৈতিক পদ্ধতি স্থাপিত হয়েছে।


রাজ্যের অন্যতম ঝাঁচকচকে এলাকা সল্টলেক। সল্টলেক থেকে ই.এম. বাইপাস পার হলেই দত্তাবাদ। ২ মে রাত ৯ টায় বিজেপির এক বুথের নেতার বাড়িতে চড়াও হয় বিজয়ী হার্মাদরা। ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল বিজেপির ছেলেটি। ওদের টিনের চালার পাশেই ছেলেটির দিদির বাড়ি। বিজেপির কর্মীকে না পেয়ে তার ভাগ্নিকে টেনে বের করে আনা হয়। মেয়েটিকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে একঘন্টা জনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সে রাতেই মেয়েটি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। পরদিন সকালে মেয়েটিকে নিয়ে মা তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। দেশে এত ভয়ানক মহিলা বিরোধী সরকার আর কোথাও নেই।
পূর্ববর্ধমানের বুদবুদ থানার কোঁকড়া গ্রাম। পুরো গ্রামটাই তপশিলি উপজাতিভুক্ত মানুষের বাস। ২ তারিখ বিকেল তিনটের থেকে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার অপরাধে অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। ৩ তারিখ সকালে আদিবাসীদের ১৫টা বাড়ি, মানে পুরো গ্রামটাই মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। দেশের এতবড় দলিতবিরোধী ঘটনা সাম্প্রতিক কালে হয়নি।


এই সব কিছু রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল প্রশাসনের। সেই স্তম্ভটির আদৌ অস্তিত্ব ছিলো বলে গত তিন মাসে মনে হয়নি। এইসব এত নামি দামী প্রশাসনের আধিকারিক, এঁদের সকলের নাম আর তাঁদের দায়িত্ববোধ, মানবতা, সততা আর সাহসের কথা এই কালোদিনগুলির ইতিহাসে লেখা থাকবে।


এই দুর্দিনে গনতন্ত্রের একটি মাত্র স্তম্ভ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। বট গাছের মতো আশ্রয় দিয়েছে সেই হতভাগ্য আর হতভাগিনীদের। সেটি বিচারব্যবস্থা। সিবিআই তদন্তে কতটা ন্যায়বিচার মিলবে বা সব হারানো মানুষ দেশের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা সেটা আগামী দিনে বোঝা যাবে। কিন্তু কলকাতার মহামান্য হাইকোর্টের বিচারে এটা ঠিক হয়ে গেছে যে খেলাটা শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়ে যায়নি। প্রথমার্ধের বিরতি হয়েছে মাত্র। বিরতির পর দ্বিতীয়ার্ধে সব পাপের বিচারের পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে।


মহামান্য আদালত, ওইসব সিংহহৃদয় বিচারক আর সেই সাহসী আইনজীবীদের নত মস্তকে কুর্ণিশ করছে পশ্চিমবঙ্গের ৯ কোটি মানুষ। সেই ৫১ টি মৃতের পরিবার, গনধর্ষনের শিকার হতভাগিনীদের পরিবার, বুদবুদের মত অসংখ্য আদিবাসী গ্রামের, তপশিলি পাড়ার নারীপুরুষের আর্শিবাদ বর্ষিত হবে আপনাদের উপর। পশ্চিমবঙ্গের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়কে ইতিহাস মনে রাখবে, সেই সঙ্গে পরিত্রাতা হিসাবে আপনাদেরকেও।

জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.