উচ্চ হারে বৃদ্ধি ও চাকরির বাজার বাড়াতে গেলে বিপুল রপ্তানিই একমাত্র রাস্তা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রপ্তানি বৃদ্ধিকেই অন্যতম গুরুত্বের অ্যাজেন্ডা করেছেন। একেবারে নির্ভুল সিদ্ধান্ত। ভারত যদি রপ্তানি ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বেশি মনোনিবেশ করে এবং তাকে সর্বশক্তি দিয়ে বৃদ্ধির রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে তা ‘চমৎকার’ ঘটাতে পারে। বিশ্বে কোনো দেশই রপ্তানি বাণিজ্যে সাফল্য ছাড়া দুই বা তার বেশি দশক ধরে ৯ থেকে ১০ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির হার ধরে রাখতে পারেনি। বিশ্বে বাণিজ্যের অংশীদার হিসেবে ১৯৯১ সালে চীনের রপ্তানির অংশ ছিল ২ শতাংশ, ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৪ শতাংশে। উল্লেখিত দুই দশকের মধ্যে চীন মূলত একটি কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে একটি আধুনিক শিল্পোন্নত অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের অংশগ্রহণের পরিমাণ মোট বাণিজ্যের মাত্র ১.৭ শতাংশ। ২০০০ সালে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ যখন ৪ শতাংশে পৌঁছেছিল তখনই তার জিডিপি কিন্তু আজকের ভারতের জিডিপির হারের সমান ছিল। দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধি ও ভালো চাকরির সৃষ্টি করতে গেলে রপ্তানি বৃদ্ধিকে মূল। ফোকাস করে রপ্তানি-বান্ধব প্রশাসন ও প্রকল্পে উন্নতি ও বৃদ্ধি ঘটানো দরকার।
রপ্তানি বৃদ্ধির নীতি ও সঠিক কৌশল নিতে গেলে আমাদের দেশে চালু থাকা তিনটি বদ্ধমূল ধারণাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এগুলি হলো—(১) আমদানি বাণিজ্য কমিয়ে ফেলা (Import substitution), মাইক্রো ও স্মল উদ্যোগে বৃদ্ধি (MSME) ও টাকার বিনিময়। হারকে উচ্চ পর্যায়ে রাখা (strong super)। আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে বিশ্বে কোনো দেশেই বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধি ঘটার প্রমাণ নেই।
ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পদ্যোগগুলি কেবলমাত্র অল্প বেতনের কিছু উপার্জনেরই ব্যবস্থা করতে পারে। সেখানে উৎপাদনশীলতাও থাকে অত্যন্ত কম। এই ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলির সংলগ্ন যদি কোনো সফল বড়ো আকারের শিল্পোদ্যোগ না থাকে সেক্ষেত্রে এরা কোনোদিনই উচ্চ উৎপাদনশীলতা অর্জন বা কর্মীদের সমৃদ্ধ জীবনযাপনের উপযোগী বেতন দিতে পারবে না। টাকার বিনিময় হার বেশি থাকলে অর্থাৎ উদাহরণ স্বরূপ ১ ডলার= ৬৫ টাকা না হয়ে যদি ৬০ টাকা রাখার চেষ্টা হয় সেক্ষেত্রে আমদানি করা জিনিসের দাম কৃত্রিমভাবে সস্তা হবে। অন্যদিকে রপ্তানি করে তুলনামূলকভাবে কম টাকা আয় হবে। বিদেশি রপ্তানিকারীদেরও পড়তায় টান পড়বে। টাকার দাম কম থাকলে ১ ডলারের মাল পাঠিয়ে আগে ৬৫ টাকার জায়গায় এখন ৬০ টাকা পাবে। আমদানি-রপ্তানির এই বৈষম্যের ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে (সস্তা আমদানি বেশি হবে, রপ্তানির বিনিময়ে আয় কম হবে)। সরকার প্রতিকার হিসেবে তড়ি ঘড়ি আমদানির ওপর নানা শুল্ক চাপাতে শুরু করবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে সুস্থ পরিকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে তাই সর্বাগ্রে টাকার বিনিময় হারকে বাস্তবোচিত (বিশ্বের হারের নিরিখে) করা দরকার। এ প্রসঙ্গে দু’হাজার দশকটি সেরা উদাহরণ। ১৯৯০-৯১ সালে ১৭ টাকা ১ পয়সা প্রতি ডলারের দামকে কোনোভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণ না করায় প্রতিযোগিতার বাজারে ২০০১-০২ সালে তা ৪৭ টাকা ৭ পয়সায় পৌঁছয়। অর্থাৎ অর্থনীতির ভাষায় টাকার অবমূল্যায়ন বা depreciation হলো (১৭ টাকার জিনিসের ৪৭ টাকা দাম হলো)। কিন্তু আমাদের এখানের উৎপাদকরা তাদের পণ্যের রপ্তানির এক সুবর্ণ সুযোগ পেল বিশ্ব বাজারের প্রতিযোগিতায়। অন্যদিকে যারা আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তারাও এইমুক্ত অর্থনীতির সুযোগ পেলেন। টাকার দাম কমায় আমদানিকৃত মালের বিনিময়ে বেশি টাকা দিতে হলো।
পরবর্তী দশকে লক্ষণীয়ভাবে আমাদের রপ্তানিতে বিপুল বৃদ্ধি ঘটল। ২০০১-০২ অর্থবর্ষে রপ্তানি জিডিপি-র ১২.৯ শতাংশ থেকে ২০১১-১২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪.১ শতাংশে। এই ভাবে অতি দ্রুত বৃদ্ধির রপ্তানির বিপরীতে আমরা প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিও দরাজ হাতে বাড়িয়ে একই সময়সীমায় জিডিপির ১৪.৭ থেকে ৩০.৮ শতাংশে পৌঁছতে পেরেছিলাম। মনে পড়বে এই সেই সময় যখন ভারতে সেল ফোন বিপ্লব ঘটেছিল। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে লাগাতার বৃদ্ধি না ঘটলে আমরা বিপুল পরিমাণ সেল ফোনের আমদানি খরচ মেটাতে পারতাম না। ফলে এই যুগান্তকারী পরিবর্তন মাঝ রাস্তায় থমকে যেত।
২০১৪ সাল থেকে টাকার আন্তর্জাতিক বিনিময় মূল্যে সামান্য কিছু depreciation হওয়ায় আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলির তুলনায় আমাদের রপ্তানি পণ্যের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি হয়ে থাকছে। সাম্প্রতিক একটি মূল্যবান গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিযোগিতার বাজারে এই ভাবে পিছিয়ে থাকার ফলে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে। আগামীদিনে মার্কিন-চীন বাণিজ্যিক রেষারেষির কারণে চীনের ইয়ুনের দাম যদি কমে আর আমরা strong rupee নীতি নিয়ে চলি তাহলে কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্যে আমাদের দেশ রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য ক্ষেত্রের উদারীকরণ অর্থাৎ বিশ্ব বাণিজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা জরুরি। হঠাৎ হঠাৎ anti dumping tax (আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক চাপানো) বাড়িয়ে দিয়ে সাময়িকভাবে দেশের মধ্যে ওই ধরনের পণ্যের উৎপাদকদের হয়তো সাময়িক উপকার হতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভাবে তা অর্থনীতির ক্ষতিই করে। কেননা সস্তায় আমদানি করা জিনিসের চেয়ে দেশের অভ্যন্তরে বেশি দামে তৈরি বস্তু মানুষকে কিনতে হয়। চড়া শুল্ক ও অ্যান্টি ডাম্পিং রুখতে অন্যান্য কর চাপানোর ফলে যখন আমদানি কমতে থাকে, সেই সময় আর বি আই টাকার দামকে বাড়তে দেয়। এর ফলে আমাদের রপ্তানি পণ্যের দাম বিশ্ব বাজারে বেড়ে যায়। রপ্তানি মার খায়।
কী আমদানি কী রপ্তানি উভয়ক্ষেত্রেই সরকারকে বাণিজ্যিক পরিকাঠামোর সরলীকরণ করে রাখা দরকার। অপ্রয়োজনীয় ছাড়পত্র নেওয়া, বন্দরে মাল পড়ে থেকে অহেতুক দেরি ও পরিবহণ খরচে বৃদ্ধি রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। মোদী সরকারের অনুসৃত ‘ব্যবসা করার স্বাচ্ছন্দ্যের নিরিখে ভারত এখনও নীচের দিকে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এর থেকেই আমদানি-রপ্তানির সূত্রে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
আলোচনার পরিসরে বলা প্রয়োজন যে রপ্তানি বাণিজ্যে বৃদ্ধি ঘটাতে গেলে বড়ো ও মাঝারি শিল্প বাড়তে পারে এমন পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করতেই হবে। এর জন্য প্রথমেই দরকার সহজলভ্য (আইনি মারপ্যাচ ও আন্দোলন ছাড়া) জমি ও সুসংহত শ্রম বাজার। প্রচারমাধ্যমে যাই বলা হোক না কেন, শ্রম আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে সরকার যথেষ্ট অগ্রগতি দেখিয়েছে। এ প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট সময় ভিত্তিক শ্রমিকমালিক চুক্তির উল্লেখ করা যায়। এক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে সংস্থা ছেড়ে চলে যাওয়ার শর্ত শুরুতেই রেখে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু আরও অনেক কিছুই করার আছে যেমন ন্যূনতম মজুরির সীমাকে খুবই উচ্চ মাত্রায় নির্ধারণ করার চাপের মোকাবিলা করা।
ন্যূনতম মজুরির সীমা খুব উঁচু ধাপে নির্ধারিত হলে (বড়ো শিল্পের ক্ষেত্রে) ছোটো উদ্যোগগুলি বেতনের উচ্চসীমা এড়াতে সদাই আরও ছোটো Micro হয়ে যেতে চাইবে যাতে ন্যূনতম মজুরি এড়ানো যায়। বড়ো হবার ইচ্ছেটাই চলে যাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় বিশ্বের মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে ন্যূনতম মজুরি বেড়েই চলেছে কিন্তু তুলনায় দক্ষতার বৃদ্ধি অতি নগণ্য। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।
আগেই বলা হয়েছে বড়ো উদ্যোগপতির কাছে ভারতে জমি কেনা প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো। জমির মালিকানা বহু অংশে বিভক্ত। প্রায়শই মালিকানা গোলমেলেও নানা বিবাদে যুক্ত। চলতি ভয়ংকর জমি অধিগ্রহণ আইনে আশু পরিবর্তন এনে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো দরকার যদি এই প্রাথমিক সমস্যার সমাধান করতে হয়। আর একটা কথা, সত্যিই যদি না আমরা এই ধরনের সংস্কার করতে পারি সেক্ষেত্রে বড়োসড়ো এক একটি ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মতো এলাকা বা তার বেশি অঞ্চলকে Autonomous Employment Zone R6916 চিহ্নিত করতে পারি। এই অঞ্চলগুলি শিল্পোন্নয়ন ও চাকরি তৈরির জন্য যোগ্য উদ্যোগপতির হাতে দিয়ে সেখানে নমনীয় জমি ও শ্রম আইন লাগু করে উৎপাদন চালু করা যেতে পারে। তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ চীনের shenzen শিল্পাঞ্চল। এদের মধ্যে কিছু কিছু অঞ্চল সমুদ্রতীরবর্তী হলে সেগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ রপ্তানি অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। রপ্তানিই পাখির চোখ।
অরবিন্দ পানাগড়িয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.