আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রের সংকট এখনো কাটেনি

এই কথা আর অস্বীকার করা চলে না যে, আমাদের দেশ এখন এক গভীর সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান তার প্রস্তাবনায় (Preamble) গণতন্ত্রকে (democracy) অন্যতম রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেও সেটা এখানে জনতন্ত্র, মুখ্যতন্ত্র ও মূখতন্ত্রের এক বিচিত্র আকার ধারণ করেছে। নেতাদের অনেকে সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ণ হলেও বর্তমানে অর্থ-প্রাচুর্য, অশিক্ষা ও অপরাধের মিশ্রণে তাদের একটা বড়ো অংশে দেখা দিয়েছে সর্বনাশের নেশা।
গণতান্ত্রিক শাসন প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন, এটা of the people, for the people and by the people l’oparts এটা জনগণের, জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা শাসিত ব্যবস্থা।
কিন্তু লর্ড ব্রাইস যথার্থই মন্তব্য করেছেন, জনসাধারণ একত্রিত হয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে দেশের শাসন চালাতে পারেন না জন-বাহুল্য ও মতভেদের কারণে। তার ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিদের ক্ষমতায় বসানো হয়। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে পরোক্ষ গণতন্ত্র এবং গুরুত্ব লাভ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা।
এই কারণেই এখনকার গণতন্ত্রে নির্বাচন একটা জরুরি বিষয়, আর সেটাকে হতে হয় অবাধ ও মুক্ত। এই প্রসঙ্গে ড. হরিহর দাস মন্তব্য করেছেন, ‘The success of democracy depends upon free and fair election- (ইন্ডিয়া : ডেমোক্র্যাটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ৯০২)।
আমাদের সংবিধান রচয়িতারা জানতেন যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা সরকারের হাতে থাকলে গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হবে— শাসকরা ধ্বংস করবেন গণতন্ত্রের শিকড়কেই। গণপরিষদে পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জরু বলেছিলেন, এর ফলে ‘democracy will be poisonal at the root৷ এই কারণেই আমাদের সংবিধান নির্বাচনকে একটা পৃথক পরিচ্ছেদে রেখেছেন এবং ৩২নং অনুচ্ছেদে ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচন পরিচালনা, পর্যবেক্ষণ, ফল প্রকাশ ইত্যাদির জন্য একটা নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা রেখেছেন। এই সংস্থা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। তার কাজই হলো। নির্বাচন ব্যবস্থাকে একটা সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়া—(ড. এস. সি. পাইলি—অ্যান্ ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৭২)।
সেই সঙ্গে সংবিধান ৩২৬ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীকে ভোটাধিকার দিয়েছে। আর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে এই কমিশন চেয়েছে যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রকৃত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে— (৬. এস. সি. কাশ্যপ আওয়ার কনস্টিটিউশান, পৃ. ২৫৬)।
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আমাদের নির্বাচন-ব্যবস্থা আদৌ সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ হয়নি— ক্রমে তাতে এসেছে অর্থ, অস্ত্র, অশিক্ষা ও অন্যায়ের দৌরাত্ম্য। অনেক ক্ষেত্রেই নেতা, পুলিশ ও দুষ্কৃতীদের মহা মিলনের ফলে নির্বাচন একটা ব্যয়বহুল প্রহসনে পরিণত হয়। আর তাতে অনেকেই এই ব্যাপারে আগ্রহহীন হয়ে পড়েছেন। যেখানে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে ৮০—৯০ শতাংশ মানুষ ভোট দেন, আমাদের দেশে সেটা ৬০ শতাংশের নীচেও নামে তাতে থাকে ছাপ্পা ভোটও। ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেটা ছিল মাত্র ৫৫ শতাংশ। আর কোটি কোটি ভোটার ‘নোটা’র মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের কোনও প্রার্থীকেই তাদের পছন্দ নয়।
সবচেয়ে বড়ো কথা— ব্যালটের আবির্ভাব ঘটেছিল বুলেটকে বিদায় দেওয়ার জন্য। অথচ এখন বুলেটই ব্যালটকে নিয়ন্ত্রিত করে। অনেক ক্ষেত্রে শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রার্থী পাওয়া যায় না।
প্রথমত, রাজনীতিকে এখন গ্রাস করেছে দুবৃত্তায়ন। অনেক নেতার পেছনের থাকে দুষ্কৃতীরা—তারাই ভোটকে নিজেদের কাজে লাগায়, পেছনে থাকে নেতা-মন্ত্রীর উৎসাহ। প্রত্যেক নির্বাচনে কিছু ভোটার ও ভোট-কর্মী হতাহত হন। বুথ-জাম, বুথ-দখল, ভীতি প্রদর্শন, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি এখন আমাদের নির্বাচনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ড. এ. সি. কাপুর লিখেছেন, এটা বেশি দেখা যায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে । তাঁর ভাষায় ‘Capturing of polling booths has become a routine-proceess by organised and armed gangs of hoodlums’– ( ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেম, পৃ. ৪২৫)। আগে অনেক নেতার পেছনে থাকত সশস্ত্র অপরাধীরা, তখন তাদের কেউ কেউ প্রার্থীও হতো। ডাকাতও প্রার্থী হয়েছে কোথাও কোথাও।
একবার উত্তরপ্রদেশের এক বিজয়ী প্রার্থী একজন ডাকাতকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তাকে সাহায্য করার কারণে।
গত লোকসভার ২৭৯ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধেইমামলা ছিল—তার মধ্যে লুঠ, চুরি, ভীতি-প্রদর্শন, নির্যাতন ইত্যাদি মারাত্মক অভিযোগ ছিল। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ২য়, ৫ম, ও ৬ষ্ঠ দফা নির্বাচনে যথাক্রমে ১০৭, ৯৬ ও ১৩৯ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে এই ধরনের মামলা ছিল। সুতরাং বলা চলে— এখন রাজনীতি ও অপরাধ জগৎ পাশাপাশি চলছে।
দ্বিতীয় সমস্যাটা প্রাচুর্যের। দেখা যাচ্ছে — ভোটের লড়াইতে এখন কোটিপতিদের ভিড়। দেশে এখন দরিদ্রের সংখ্যা অন্তত ৩০ শতাংশ। হিসেবে দেখা যাচ্ছে— দারিদ্র্যসীমার নীচে এখনও আছেন প্রায় ৪০ কোটি মানুষ। অপুষ্টির শিকারও অন্তত ২০ কোটি নর-নারী।‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’-এ আছে বিশ্বের ১১৯টা দেশের মধ্যে দারিদ্র্যের দিক থেকে ভারতের একটা বড়ো স্থান আছে।
অথচ কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে। অ্যাসোসিয়েশান ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস্’ ও ‘ন্যাশনাল ইলেকশান ওয়া’ জানিয়েছে যে, দেশের ৮৩ শতাংশ সাংসদই কোটিপতি। আর তারা বিভিন্ন দলের সদস্য। আরও জানা গেছে— তাঁদের ৫২১ জনের সাম্প্রতিক গড়-পরিমাণ ১৪.৭২ কোটি টাকা। তাছাড়া ১৭৪ জনের বিরুদ্ধে খুন, নারীহরণ ইত্যাদির অভিযোগও ছিল।
অবশ্যই ধনী হওয়াটা অপরাধ নয়। কিন্তু তাঁদের এই বিপুল সম্পদের উৎস আমরা জানি না। তাছাড়া অধভুক্ত, ছিন্নবস্ত্রপরিহিত মানুষদের দুঃখ-কষ্ট কি তারা বুঝবেন?
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো চেয়েছিলেন ‘ফিলসফার-কিং’-কে। আর তাঁর প্রিয় শিষ্য অ্যারিস্টটলেছিলেন আদর্শবাদী ও উচ্চ শিক্ষিত জননেতারাই আদর্শ রাষ্ট্র গড়তে পারবেন।
কিন্তু তৃতীয় সমস্যাটা এসেছে এই সূত্রেই। আমাদের দেশের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিচিত্র চিত্র উচ্চ শিক্ষিত প্রার্থীর সংখ্যাটা কমে আসছে। মনোনয়ন পত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার উল্লেখ করতে হয়। সেখানে কেউ কেউ জানিয়েছেন, তাঁরা ‘ন-ম্যাট্রিক’। কিন্তু শব্দটার অর্থ স্পষ্টই নয়। কেউ কেউ আবার নিরক্ষরও।
অবশ্যই আমাদের সংবিধান প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষার মান নির্দিষ্ট করে দেয়নি। কিন্তু অ্যারিস্টট লিখেছেন— রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নিরন্তর চর্চার মাধ্যমেই প্রতিনিধিরা মানুষকে চালিত করবেনএটাই কাম্য। কিন্তু তারা অর্ধশিক্ষিত হলে দেশকে চালিত করবেন কোন্ দিকে?
প্রাক্তন সাংসদ রেণুকা রায় তার মাই রেমিনিসেন্সেস’ গ্রন্থে লিখেছেন— হীরেন মুখার্জী, ড. লোহিয়া, হরিবিষ্ণু কামাক, আচার্য কৃপালনী প্রমুখ সদস্যরা উঠেই কংগ্রেসের নিন্দা করতেন, অথচ কংগ্রেসি হয়েও তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনতেন সেই উচ্চাঙ্গের ভাষণ।
অথচ এখন সেই রকমটা হয় না। অনেকেই আসেন না— একটা অধিবেশনে ছিলেন মাত্র ৫৬ শতাংশ সদস্য। ৪৮ শতাংশ সদস্য মুখই খোলেননি, ৫২ শতাংশ দু-একটা বিষয়ে কথা বলেছেন। তার কারণ হলো, তারা বিতর্কের বিষয়বস্তুই বোঝেননি। একজন সদস্যা একবারই একটা প্রশ্ন করেছেন পাঁচ বছরে, অন্য একজন চারটে বিষয় তুলেছেন কিন্তু তারা প্রত্যেকে নিয়ে গেছেন ১৮ লক্ষ টাকা।
উচ্চাঙ্গের বিতর্কের বদলে এখন হইচই, গণ্ডগোল বেশি হয় বলে অনেকে মনে করেন। ড. বি.সি. রাউত মন্তব্য করেছেন, অনেকের আচরণ ‘deplerable’—They donot maentain dignity and decorum’— (ডেমোক্র্যাটিক কনস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ১৫৯)। অনুরূপভাবে এস. এল. সিক্রি লিখেছেন, ‘Most of the debates are ill-attended and ineffective. They are worse than a primary-School dabates’- (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স পৃ. ১৮৪)।
তাহলে আমরা চলেছি কোথায়? এই গণতন্ত্রই আমাদের কাম্য ছিল?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, গণতন্ত্রের সাফল্য কতকগুলো শর্তের ওপর নির্ভর করে—
১. জনসাধারণকে রাজনীতি-অর্থনীতি বিষয়ে সচেতন ও শিক্ষিত হতে হবে। কিন্তু। তা না হলে সুবিধাবাদী নেতারা সহজেই সব কিছুকে গ্রাস করবেন।
২. জনসাধারণ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ দেখবেন না— তাঁদের কাছে প্রাধান্য পাবে জাতীয় স্বার্থ।
৩. জনমত হবে সদা জাগ্রত ও বুদ্ধি নির্ভর।
৪. জনসাধারণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন বুদ্ধি, বিবেচনা ও বিজ্ঞতার সঙ্গে। লর্ড ব্রাইস মন্তব্য করেছেন, ‘the gift of suffrage creates the will to use it and the gift of knowledge creates the capacity to use the suffrage’- telah ডেমোক্র্যাসিস, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭১)।
৫. আর চাই সহনশীলতা, যুক্তিপূর্ণ পরমত গ্রহণের উদারতা গণতন্ত্রকে সার্থক করে তোলে—(রিফ্লেক্সা অগভর্নমেন্ট, পৃ. ৬৩)।
কিন্তু এই দেশে প্রাথমিক কাজটাই হয়নি। এখানে কোটি কোটি মানুষ অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছেন। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দারিদ্র্য। তাই সহজেই তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও অসাধু নেতাদের কথা ও লোভের ফাঁদে পা দেন।
অ্যারিস্টটল মনে করতেন—বহুরশাসন কল্যাণমুখী হলে সেটা হয় polity— তাতে বিকৃতি এলে দেখা দেয় ডেমোক্র্যাসি। আমাদেরটা কি সেই অর্থেই গণতন্ত্র ?
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.