স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করাকালীন জানতে পেরেছিলাম যে পৃথিবীর বহু দেশে, বিশেষ করে ইউরোপে Indology নিয়ে বেশ চর্চা হয়। প্রত্যেক প্রিমিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ইউনিভার্সিটিতে Indology-র বড় বড় সেকশন আছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, স্প্রেন, জার্মানি সর্বত্রই Indology-র সেকশন আছে। ভারতের প্রতি পুরো পৃথিবীর এত আগ্রহ দেখে তখন বেশ গর্ব হোত। কিন্তু এখন দেখছি পাশ্চাত্য যে Indology-র চর্চা করে এটা ভারতকে ভালোবেসে করে না, ভারতবর্ষকে ভাঙার জন্য করে। এটা কোন পূজার দান নয়, এটা খাঁড়ার ঘা। এটাও লক্ষ্য করেছি যে ভারতের ইতিহাস নিয়ে ভারতীয় পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদরা যা বলে থাকেন সেগুলো সাধারণত সবই পাশ্চাত্য Indology-র প্রতিধ্বনি। গত সত্তর আশি বছর ধরে পাশ্চাত্যে যে Indology-র চর্চা চলছে তারই তোতাপাখি এরা।‌ এখন আস্তে আস্তে এই ট্রাডিশন পাল্টাচ্ছে। সেই কথাতেই আমি আসছি।

সময়ের সাথে সাথে Indology-তে একটার পর একটা ঢেউ বা ফ্যাশন উঠেছে, তার প্রথম ফ্যাশন ছিল মার্কসিজম। মার্কসিস্টরা ইংরেজদের সমর্থন করেছে কারণ কার্ল মার্কস মনে করতেন যে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ ভালো ঠিকই কিন্তু এই ভারতীয়রা হনুমান ও গরুর পুজো করে, অতএব এরা অসভ্য। তাই এদের জন্য ইংরেজ শাসনই কাঙ্খিত। গ্রামের অর্থনীতি ভালো বলতে তিনি গ্রামের স্বনির্ভর অর্থনীতির কথা বলেছেন। এখানে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপার ছিল, যে মডেলকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী, এমনকি গান্ধীজিও ভারতের জন্য আদর্শ বলেছিলেন। গ্রামকে কারুর দিকে তাকাতে হোত না, গ্রামগুলো নিজের মধ্যে থেকেই সমস্ত resource পেয়ে যেত। গ্রাম থেকে ব্যবসা করতে বালি, সুমাত্রা ও জাভাতে জাহাজ চলে যেতে। বালির সেই সমুদ্র অভিযানকে উদযাপন করতে আজও অনেক জায়গাতে বালি উৎসব হয়। তখন জাহাজে করে কোথাও ব্যবসা করতে যাওয়ার জন্য দিল্লির প্রশাসনের কাছ থেকে পারমিশন নেওয়া বা লাইসেন্স নেওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না। এটাই ছিল গ্রামের স্বনির্ভরতা। গ্রামে নাপিত, মুচি, চাষী, শিক্ষক, বৈদ্য, দোকান, চাষবাস, শিক্ষা অর্থনীতি সবই ছিল। গ্রামের কোন সমস্যা হলে কোর্ট বা হাইকোর্টে যাওয়ার কোনো ব্যাপার ছিল না, গ্রামের মোড়লরাই সেগুলো মিটিয়ে দিতেন। এই গ্রামীণ সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ডি-সেন্ট্রালাইজড ছিল। তাই আলাদা করে কোনো পলিটিক্যাল এন্টিটি ছিল না ঠিকই কিন্তু এক ধরনের সাংস্কৃতিক এন্টিটি ছিল। সকলের নিজের ভারত পরিচয়ে কোন ভুল ছিল না বা সারা দেশে যে শিবের প্রভাব ছিল, সারা দেশে যে একই দেব-দেবী ও প্রতীকের প্রভাব ছিল সেখানে কোনো ভুল ছিল না। কার্ল মার্কস গ্রামের স্বাধীন অর্থনীতি দেখে গ্রামের মডেলকে ভালো বলেছিলেন কিন্তু এখানকার মানুষদের গরু ও হনুমানের পুজো করাকে বর্বরোচিত বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এদের জন্য ইংরেজ শাসনটাই ভালো। কিন্তু কেন তিনি ইংরেজ শাসনকে ভালো বলেছিলেন? কারণ ইংরেজরা শাসনে এলে তবেই এদের মধ্যে একদিন রেভলিউশন বা সসস্ত্র বিপ্লব হবে, আর সশস্ত্র বিপ্লবই কমিউনিজমের একমাত্র কাম্য। ভারতবর্ষ অর্গানিক হয়ে থাকলে তো সশস্ত্র বিপ্লব হবে না। তাই Indology-র প্রথম যুগের চর্চা মার্কসিজমের বিপ্লব করার দিকে বাঁক নিল।

কিন্তু ওরা যখন দেখল যে এখানে বিপ্লব করা সম্ভব নয় তখন দ্বিতীয় ধাপে Indology কলোনিয়ালিজমের গল্প শোনাতে শুরু করলো। ওরা বলতে শুরু করল সে ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার যে সব অঞ্চলে সাহেবেরা গেছিল সেখানকার যা কিছু ভালো সেগুলো সব সাহেবরাই নিয়ে এসেছে। ওদের এই গল্পটাকে আমি আগেই খণ্ডন করেছি। এখন ওরাও এটা ভালো করে জেনে গেছে। বিশেষ করে আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান বামপন্থীরা মানতে বাধ্য হয়েছে যে কলোনিয়ালিজমের পরিণতি ভয়ংকর, যা ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষকে শেষ করে দিয়েছে। কলোনিয়ালিজমের দ্বারা শুধু ইউরোপ নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে। এর ফলে Indology এখন কলোনিয়ালিজমের নিন্দা করছে এবং ভারতে ব্রিটিশ সময়টাকে সাংঘাতিক সমালোচনা করছে। এই সমালোচনার নাম দেওয়া হয়েছে Post-Colonialism. প্রসঙ্গত বলে রাখি যে ‘ism’ বা ‘বাদ’ হচ্ছে মানুষের তৈরি করা। যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদ মানুষের তৈরি, কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্ম হচ্ছে সর্বজনীন সত্য। যাইহোক এই Post-Colonialism-এর মূলকথা কী? এর মূল কথা হচ্ছে ভারত সুপার পাওয়ার ছিল, শিক্ষা সমাজ অর্থনীতি সবদিক দিয়ে ভারত খুবই উন্নত রাষ্ট্র ছিল, ইংরেজদের জন্য ভারতের সেই সুপার পাওয়ার স্ট্যাটাসটা নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ভারতের এই আসল সুসময়টা মোগল শাসনের কারণে এসেছিল, তার আগে কিস্যু ছিল না। এটাই হচ্ছে Post-Colonialism. এরা কিছুতেই ভারতের বৈদিক যুগকে স্বীকার করতে চাইছে না, কারণ বৈদিক যুগকে স্বীকার করে নিলেই ওদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হবে; ওদের আর্য তত্ত্ব সম্পূর্ণ নস্যাৎ হয়ে যাবে। ওরা বুদ্ধকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে কারণ বুদ্ধ মাত্র আড়াই হাজার বছর আগেকার একজন মানুষ, কিন্তু তার বেশি পিছনে ওরা কিছুতেই যাবে না। কারণ ওদের গল্প অনুযায়ী তার আগে ভারতের সব কিছুতেই ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও জংলিপনার ছাপ ছিল। এটাই Post-Colonialism.

তারপর এল Post-Modernism. এটা কী? পোস্ট-মর্ডানিজমের মূলকথা হচ্ছে নেশন-স্টেট। এই নেশন-স্টেট কনসেপ্টটা খুবই আধুনিক, মাত্র দুশো থেকে আড়াইশো বছর আগেকার ব্যাপার। তার আগে দেশ ছিল কিন্তু রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সব দেশের ক্ষেত্রেই একই অবস্থা ছিল। ভারত বা অন্যান্য দেশ বলতে তখন একটা সাংস্কৃতিক অবস্থান ছিল। পলিটিকাল মানচিত্র অনুযায়ী এখানে ভারত শেষ হলো এবং তারপর থেকে অন্য দেশ শুরু হলো — এই নেশন-স্টেট কনসেপ্টটা সাম্রাজ্যবাদের যুগের সময় থেকে শুরু হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এটাকে স্ট্যাটিক করে দেওয়া হয়েছে। Nation-State কনসেপ্টের মূল কথা হচ্ছে one language, one religion এবং one race, অর্থাৎ একটাই ভাষা, একটাই ধর্ম ও একটাই জাতি। আর Post-Modernism-এর অতি বাম শক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে নেশন-স্টেট ভেঙে দেওয়া কারণ পোস্ট-মর্ডানিস্টদের মতে Nation বা State মানেই হচ্ছে শোষণের প্রতিষ্ঠান — টেররিস্টরা যা টেরোরিজম করতে পারে তার থেকে অনেক বেশি টেরোরিজম তৈরি করে স্টেট। এটা পোস্ট-মর্ডানিজমের বক্তব্য। এবার ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে এখানে নেশন-স্টেট বলে কিছু ছিল না, অতএব ভারত তো কোন নেশনই নয়, ভারত তো অনেক নেশনের জোড়াতাপ্তি লাগানো একটা জায়গা। এখানে অনেক জাতি, অনেক ভাষা ও অনেক ধর্ম আছে। তাহলে প্রত্যেকটা জাতির জন্য আলাদা দেশ হওয়া উচিত, প্রত্যেকটা ধর্মের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেশ হওয়া উচিত, প্রত্যেকটা ভাষার জন্য পৃথক দেশ হওয়া উচিত। অতএব ভারতকে ভেঙে অনেকগুলো টুকরো টুকরো দেশ করে দাও। এটা পোস্ট-মর্ডানিস্টদের বক্তব্য।

সবকিছুর যেমন বিবর্তন হয়, তেমনি পোস্ট-মর্ডানিজমেরও বিবর্তন হয়েছে। ফলস্বরূপ এসেছে Subaltern Studies. এটা এখন চলছে। অর্থাৎ বিকল্প বা উপবিকল্পের মধ্যে যারা আছে তাদের ইতিহাস চর্চা করো। যাদের ইতিহাসে কেউ কোনদিন জানতে পারেনি, যারা প্রান্তিক হয়ে আছে, যে সমস্ত জাতি বা আদিবাসীদের ইতিহাস কেউ মনে রাখেনা, তাদের ইতিহাস জানতে হবে কারণ ওদের ইতিহাসটাই আসল ইতিহাস। এটা বলার জন্য ভারতের Indology সেকশনে নতুন তত্ত্ব আসছে, আর এগুলো সব ভারতের বাইরে থেকে আমদানি হচ্ছে। এগুলোর কোনটাই ভারতীয় পণ্ডিতদের মস্তিষ্ক উদ্ভূত নয়, ভারতীয় পণ্ডিতরা শুধু ইউরোপিয়ান গল্পের প্রতিধ্বনি করে, আমাদের স্কুল-কলেজ, কনফারেন্সে ও সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা শুধু ওদের কথাগুলোই রিপিট করি। ভারতের জন্য Subaltern Studies-এর নতুন তত্ত্ব হচ্ছে ভারতের আসল বাসিন্দা হচ্ছে মুন্ডা। অর্থাৎ দ্রাবিড়রাও বহিরাগত ছিল। দ্রাবিড়রা এসে মুন্ডাদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা বসেছে, তারপর আর্যরা এসে দ্রাবিড়দের তাড়িয়েছে। এই গল্পের পেছনে খুব সূক্ষ্ম চাতুরী কাজ করছে, ওরা এভাবে ভারতকে যত টুকরোতে ভাঙা যায় তারই চেষ্টা করছে, ওরা একে অপরের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করে দিতে চাইছে। ওরাই ভাগগুলো তৈরি করেছে, আবার ওরাই ঝগড়া লাগিয়ে দিচ্ছে। আসলে কিন্তু Dravidism বলে কিছু নেই। বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর নাগাস্বামী, যিনি দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের একজন অন্যতম প্রধান গবেষক, তিনি বলছেন তামিলনাড়ুতেই অন্ততপক্ষে পঁচাশি হাজার মন্দির রয়েছে, তার মধ্যে অন্তত পঁয়ষট্টি হাজার মন্দির বেশ পুরনো এবং সেগুলোতে যেসকল দেব-দেবী আছে, সেই মন্দিরের যে স্টাইল, সেখানে যে কাহিনী বর্ণিত আছে তার সাথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মন্দিরের কোন পার্থক্য নেই। তাহলে প্রশ্ন, কিসের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে দ্রাবিড় ও আর্য আলাদা বা‌ সাউথ ইন্ডিয়া ও নর্থ ইন্ডিয়া আলাদা? উনি বলছেন যে ইউরোপিয়ানরা তর্ক করে বলেন যে সংস্কৃতের থেকেও তামিল নাকি অনেক প্রাচীন ভাষা এবং সংস্কৃত পরে সংস্কার করা হয়েছে। ঠিকই, সংস্কৃত পরে (পাণিনির সময়) সংস্কার করা হয়েছে বলেই সংস্কৃত নামটি হয়েছে। তার আগে প্রাচীনকাল থেকে এই ভাষা অনেকবার পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে, সেই বিজ্ঞানটিকে রক্ষা করার জন্য পাণিনির হাতে তার নির্দিষ্ট ব্যাকরণ ও streamlining করা হলো। তামিল পণ্ডিতরা বলছেন প্রাচীন তামিল ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার চল্লিশ পার্সেন্ট মিল রয়েছে — একই স্ক্রিপ্ট, একটু right angle-এ ঘোরানো। সপ্ত ঋষির এক ঋষি, অগস্ত্যর হাত ধরে ব্রাহ্মীলিপি এসেছে। সংস্কৃত, তামিল ও বিভিন্ন জ্ঞান নিয়ে তিনি বিন্ধ পর্বত পেরিয়ে প্রথম দক্ষিণে গেলেন। সেই কারণে দক্ষিণ ভারতে আজও অগস্ত্যর পুজো হয়। তামিলনাড়ুর যত নাচ আছে, ভারতনাট্যম থেকে শুরু করে যত রীতিনীতি আছে সেগুলো সবই গুরুকে বা শিবকে প্রণাম করে করার রীতি আছে। এছাড়া ওদের উপবাস, আদব-কায়দা, রীতিনীতি, সংস্কার সবকিছুই বাকি ভারতের সাথে হুবহু মিলে যায়। তাহলে কী করে দ্রাবিড় ও আর্য নামে দুটো আলাদা জাতের কথা বলা হচ্ছে? এই গল্পটাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। একটা মিথ্যে গল্পের ওপর ভিত্তি করে DMK ও AIADMK নামে দুটো পলিটিকাল পার্টি তৈরি হয়ে গেছে। ভেবে দ্যাখো, একটা তৈরি করা চক্রান্তের ন্যারেশনের কত শক্তি যে দুটো শক্তিশালী পলিটিক্যাল পার্টি এতগুলো দশক ধরে শুধু দ্রাবিড় ও আর্য ডিভিশনের উপর ভিত্তি করে তামিলনাড়ুতে পালাক্রমে সরকার চালিয়ে যাচ্ছে! ওরা কিন্তু এসবে মোটেও বিশ্বাস করে না, ওরা কেবল পলিটিক্স করে। প্রফেসর নাগাস্বামী বলেছেন যে তামিলনাড়ুর ঘরে ঘরে, ওদের সমাজে ও মানুষের মধ্যে দ্রাবিড় আইডেন্টিটি নিয়ে কোনো সেন্টিমেন্ট নেই। ওদের মধ্যে কেবল সনাতন ভারতীয় সেন্টিমেন্ট আছে। দ্রাবিড় কনসেপ্টটা পলিটিক্যালি ভাসিয়ে রাখা একটা সেন্টিমেন্ট। আর আগেই বলেছি যে দ্রাবিড়িজম কথাটা Indologist-দের আমদানিকৃত শব্দ।

আমাদের শাস্ত্রে আর্যাবর্তে ষোড়শ জনপদের বা ষোলটা প্রধান প্রদেশের কথা বলা আছে। এবার ওরা ষোড়শ জনপদ শব্দটাকে ব্যবহার করে বলছে ভারতকে অন্তত ষোলটা টুকরো করতে হবে। Indologist-এর এই চর্চার জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা আসছে, বিভিন্ন এজেন্সি থেকে আসা টাকা ভারতের NGO-দের কাছে যাচ্ছে। এই NGO-গুলো দুর্বল, পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর, প্রান্তিক, দরিদ্র, আদিবাসী জাতি ও গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে কাজ করার নামে সেই অঞ্চলের মানুষের মনের মধ্যে ভারত বিদ্বেষ তৈরি করছে। এই কাজটি করার জন্যই বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা থেকে টাকা ও আখ্যান আসছে। দ্রাবিড়স্তান, দলিতস্তান, আদিবাসীদের দেশ, North-East-এর আলাদা দেশ, মুসলমানদের জন্য আরও একটা দেশ হবে, বাংলা ভারতের সাথে ঠিক মিশতে পারছে না, তাই বাংলাকে আলাদা হয়ে যেতে হবে — এভাবে ভারতকে ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম নেওয়া অনেক বিপ্লবী দলও বাংলাকে ভারত থেকে আলাদা করার কথা খুব বলছে। এটা ওদের বিপ্লবের একটা মন্ত্র হয়ে উঠেছে। ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় ধর্ম, ভারতীয় সভ্যতা, ভারতীয় দর্শন মানেই ভয়ঙ্কর, ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার, এরা সবাই বিজাতীয় ও বহিরাগত, আমরা আলাদা, অতএব আমরা এদের থেকে আলাদা হয়ে যাব — এটা হচ্ছে এদের কথা। পাশ্চাত্য Indology-র চর্চা বাঙালিকে যা করতে চাইছে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ঠিক সেটা চরিতার্থ করতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইউরোপিয়ানরা চাইছে বাংলা বেরিয়ে যাক, কারণ ওরা বাঙালিকে ভয় করে। এই বাঙালিরাই একটা সময় ভারতবোধ জাগাতে চেষ্টা করেছিল। স্বামী বিবেকানন্দ আর্য তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়েছেন, ঋষি অরবিন্দ বলেছিলেন Aryan Invasion Theory is a myth. নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও ভারতের ইতিহাস, সভ্যতা এবং সংস্কৃতির উপরে জোর দিয়ে ভারতের উত্থানকে আবাহন করেছিলেন। বাংলার শাক্তধর্ম বা শক্তিপূজার ধর্মকে তিনি দেশের কাজে লাগানোর জন্য আহ্বান করেছিলেন। সেই বাংলা আজকে কী নিয়ে পড়ে আছে? আজকে যে আলোচনাগুলো হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কয়জন বাঙালি ভাবছে বা চর্চা করছে? অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু এই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, ইউরোপিয়ানদের মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে এবং তার নাম দেওয়া হচ্ছে স্বদেশী ইন্ডোলজি।

এতদিন ধরে শুধু বিদেশিরাই ভারতচর্চা করে গেছে, এবার ভারতীয়রা ভারতচর্চা শুরু করছে। আর এসব কথা বলছি বলে আমাকে ‘বিজেপির দালাল’ বা ‘হিন্দুত্ববাদী’র ছাপ্পা দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সত্য বলতে গেলে কি কারুর দালালি করতে হয়? ছ’বছর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসনে থেকে এখনকার কেন্দ্রীয় সরকার কি কোনভাবে এই ন্যারেটিভটকে পাল্টানোর জন্য, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও ইতিহাসচর্চাতে একটুও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে যে তোমরা আমার ওপর বিজেপির ছাপ্পা দেবে? ওরা তো শুধু গান্ধী স্তুতি করে চলেছে আর গুজরাটি অস্মিতা দেখিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাকে কোন রাজনৈতিক দলের ছাপ্পা দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করা মানেই তুমি আর যুক্তিতে পেরে উঠছ না, তাই আমাকে বিজেপি, হিন্দুত্ববাদী বা আর.এস.এস বলে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো। আজকে আলোচনা করার একটাই উদ্দেশ্য — আমরা শুনে আসছি যে বাঙালি নাকি মৌলিক চিন্তা করতে পারে। বাঙালির সেই শক্তিকে আমি দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই বাঙালি মিডিয়ার কথা না বলে নিজের স্বকীয় চিন্তা থেকে কথা বলছে, আমি দেখতে চাই স্কুল-কলেজের শিক্ষাকে রিপিট না করে বাঙালি নিজের পর্যবেক্ষণ ও দৃষ্টিশক্তি থেকে কিছু বলছে।

জয়দীপ মহারাজ (একটি অনলাইন আলোচনার ক্ষুদ্র অংশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.