আমরা ক্ষমারও অযোগ্য…

-স্যার, ভদ্রমহিলা আবারো এসেছেন । ভেতরে আসতে বলবো ?’
ডি আই সাহেব একটু বিরক্তির সুরে বললেন, ‘বল।’
ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধা। দক্ষিণ কলকাতায় এক স্কুল থেকে দশ বছর আগে রিটায়ার করেছেন। এখনো পেনশান পাননি। তদ্বির করতে এসেছেন বৃদ্ধা।

 ভেতরে ঢুকতেই ডি আই অব স্কুল তাঁর ফাইলে কৃত্তিম মনোযোগ নিক্ষেপ করে বললেন, 'যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন।'
 মহিলা তাঁর আঁচলে মুখের ঘাম মুছলেন। চশমার কাঁচ মুছলেন। তারপর ক্ষীণকন্ঠে একটা চেয়ারের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, 'স্যার ! আমার ফাইলটা মুভ করেছে?'
 টেবিলের অপর প্রান্তে ফাইলে মুখ গুঁজে ডি আই এর  উত্তর ভেসে এলো, 'কী করে করবে? এ জি বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। যথাযথ রিপ্লাই না পেলে আপনার ফাইল পাঠিয়ে কোন লাভ হবে না।'
 প্রৌঢ়া বললো, 'কী প্রশ্ন জানতে চান ?'

ডি আই বিরক্তির সুরে বললেন, ‘আপনার সার্ভিস বুক থরোলি চেক করে আপনাকে আমি আগেও যে প্রশ্ন করেছিলাম এ জি ঠিক সেই প্রশ্নই করেছে … তবুও আপনি আমায় রিকোয়েস্ট করেছিলেন এ জি-তে ফাইলটা পাঠাতে। আই হ্যাভ ডান মাই ডিউটি । নাও আই হ্যাভ নাথিং টু ডু। আপনার সার্ভিস বুকে আপনার কোয়ালিফিকেশানের কোন উল্লেখ নেই। আপনি যে বি এ পাশ করেছেন তার প্রমাণ কোথায়? আপনাকে স্কুল কমিটি সিলেক্ট করেছিল কমপ্যাশানাট গ্রাউন্ডে। সার্ভিস বুকে শুধু লেখা রয়েছে, -সী হ্যাস বীন সিলেক্টেড অন রেকমেনডেশান অব এ সিনিয়র ক্যাবিনেট মিনিস্টার এন্ড দ্যা স্কুল কমিটি হ্যাজ বীন কমপেলড টু রিক্রুট হার অন কমপ্যাশানেট গ্রাউন্ড দ্যাট সি ওয়াজ এ ফ্রীডাম ফাইটার এন্ড হ্যাড বীন ইন জেল ফর এ সেভারেল লঙ ইয়ার্স।’

 বৃদ্ধার মুখে এবারে ফুটে উঠলো অপমানের ছাপ।

সত্যিই তো, তিনি যে বি এ পাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে প্রমাণ কোথায়? তিনি বি এ পাশ করার পর একটা চোথা কাগজ পেয়েছিলেন বটে যেটাকে মার্কশিট বলে। কিন্তু সেটাই বা কোথায়? ১৯৩১ সালে বি এ পাশ করলেন ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে। পরের বছরে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। সেই সমাবর্তনে তাঁর সারফিকেট পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হল কৈ? সেদিনই যে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলো। তারপর দীর্ঘ কারাবাস। কারাবাস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন পুলিশ ঘরে ঢুকে তাঁর বইপত্র সবকিছু তছনছ করে চলে গেছে। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না তাঁর সেই মার্কশিট । আর সেনেট হলের সেই ঘটনার পরেই তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সারটিফিকেট বাতিল করে দিল। তাঁর তখন মনে হয়নি ঐ সারটিফিকেটের মূল্য কতখানি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর আবারো জেলে গেলেন ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে। দেশ স্বাধীন হল। তাঁর মনে হল, এই স্বাধীনতাই কি তাঁরা চেয়েছিল? পেটের দায়ে নেতাদের দয়ায় দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে চাকরি করলেন ক’বছর। তখন কি করে বুঝবেন যে এ দেশে কমপ্যাসানেট গ্রাউন্ডে চাকরি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ইউনিভার্সিটির বাজেয়াপ্ত সারটিফিকেট পাওয়া যায় না ! এই সারটিফিকেটের জন্যে তিনি বহুবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রেজাল্ট সেকশানে তদ্বির করেছেন। শেষে একজন এসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার অনেক ফাইল ঘেঁটে-ঘুটে তাঁকে শেষে বলেছিলেন, ‘আপনার সম্পর্কে সে সময় সিনেটে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা বর্তমান সিনেট কনডোন করে আপনাকে সার্টিফিকেট দেওয়ার সুপারিশ না করা পর্যন্ত আপনাকে কোন সারটিফিকেট দেওয়া যাবে না।’
অনেক চেষ্টা করে বৃদ্ধা একবার ভাইস চ্যান্সেলারের সাথে গিয়েও দেখা করেছিলেন। ভি সি যদিও খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনিও তাঁকে সেই একই কথা বলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস অনুযায়ী সিনেটের পারমিশান ছাড়া কাউকে সারটিফিকেট দেওয়ার কোন প্রভিশান নেই। একজন সিনেট সদস্য একবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে ইউনিভার্সিটির তরফে সারটিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব তুলেছিলেন। কিন্তু সিনেট তো আসলে দলীয় রাজনীতির আখড়া। যিনি প্রস্তাব তুলেছিলেন তিনি তো দলীয় রাজনীতির বিচারে মাইনরিটি। তা তাঁর প্রস্তাব বাকিরা মানবে কেন? ফলে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান হল। আফটার অল, বৃদ্ধা একজন কংগ্রেসি মন্ত্রীর রেকমনডেশনে স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলেন। কংগ্রেসিরা রাজ্য শাষণ থেকে বিদায় নিয়েছে। বৃদ্ধা আজও মনে-প্রাণে কংগ্রেসি। ক্ষমতায় এখন বামপন্থীরা। তাদের সেনেটররা এটা মানবেন কেন? কংগ্রেসিদের যত কিছু ছলাকলা সেসব গঙ্গাজলে ধুয়েমুছে শিক্ষাক্ষেত্রকে স্যানিটাইজ করার জন্যেই তো বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছেন।

 দোরে দোরে ঘুরেও সমস্যার কোন সুরাহা হল না। উপরন্তু যারা তাঁকে কর্মসূত্রে চেনে বা জানে তারা আড়ালে-আবডালে বলতে লাগলো, মন্ত্রীর সুপারিশে কোন সারটিফিকেট ছাড়া এতো বছর চাকরি করেও ক্ষিদে মেটেনি। এখন আবার পেনশনের জন্যে বুড়ি তদ্বির করতে শুরু করেছেন এখানে ওখানে। একদিন কথাটা কানে গেলো বৃদ্ধার। তাঁর স্বামীও ছিলেন একজন প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী । তিনিও গত হয়েছেন। নিঃসন্তান, সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধার দু-চোখে তখন শুধু অন্ধকার। মনে করে দেখলেন, যেদিন তিনি কলকাতা ইউনিভারসিটির সারটিফিকেটের পরোয়া না করে শহিদ বিনয় বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউনিভারসিটির চ্যান্সেলর স্টানলি জ্যাকসনের দিকে তাক করে রিভলবার চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেদিন কিন্তু তাঁর দু-চোখে একটুও অন্ধকার ছিল না। ছিল শুধু স্বপ্ন ! সে স্বপ্ন হল একদিন না একদিন দেশ স্বাধীন হবেই হবে। সে সব কোন যুগের কথা। আর কেই বা সেসব কথা মনে রেখেছে ? 

 হতাশায় নিমজ্জিত, আশাহীন বৃদ্ধা চোখের জল ফেলতে ফেলতে একদিন মনের দুঃখে চলে গেলেন হরিদ্বারে। তারপর হরিদ্বার থেকে একদিন এলেন হৃষীকেশে। কবে গেলেন হরিদ্বার আর কবেই বা এলেন হৃষীকেশে ---- সেসব এখন ডাস্টবিনের জঞ্জাল ! 

 কলকাতা শহরটাকে তাঁর নিশ্চয়ই তখন মনে হয়েছিল এক জেলখানা। যে জেলখানার চেয়ে ইংরেজের জেলেখানায় কষ্ট এবং গর্ব ---- দুইই ছিল ঢের ঢের বেশি। এই গর্বই একদিন সব দুঃখ-কষ্ট ভোলাতে সাহায্য করেছিল তাঁকে। কিন্তু এখন এখানে থাকবেন কার ভরসায় আর কীসের আকর্ষণে ? এখানে তো দুহাত ভরে কুড়িয়েছেন শুধু অপমান আর অপমান।

 হৃষীকেশে কার কাছে গেলেন তিনি ? কে তাঁকে আশ্রয় দিল ? হয়তো দেখা যাবে কোন আশ্রমে সকালে  ও সন্ধ্যায় অনাথ ভিখিরিদের সাথে পাত-পেরে তিনিও বসে গেছেন দুটো অন্নের লোভে ! মানুষের পেটের দায় যে বড় বেশি ! 

 কতদিন হৃষীকেশে ছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই। কে রাখবে সে খোঁজ ? কত মানুষ সেখানে নিত্য আসে যায় ! তবে হ্যাঁ, একদিন হৃষীকেশের পুলিশের কাছে খবর এলো যে অমৃতবাহিনী গঙ্গার কোলে এক নির্জন স্থানে এক বেওয়ারিশ লাশ দেখা গেছে । লোক্যাল মানুষেরা কেউ তাকে চেনে না। পুলিশ গিয়ে সেই লাশ উদ্ধার করলো। পুলিশ দেখলো লাশটি এক মহিলার। বয়েস আনুমানিক সত্তর। তাঁর কাপড় পরার ধরণ দেখে পুলিশের মনে হল মহিলা সম্ভবত বাঙালি। শরীরে কোন অলংকার নেই। লোক্যাল পেপারে মহিলার মুখের ছবি ছাপা হল। পেপারের খবরটা নজরে এলো ড. ত্রিগুণা সেনের। তিনি তখন কনখলে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম রয়েছেন। ড. ত্রিগুণা সেন ফোন করলেন তাঁর এক ছাত্রকে হৃষীকেশে। সেই ছাত্রের কাছে সংবাদের সত্যতা যাচাই করে ছুটে এলেন নিজে। হৃষীকেশে।

 এসে কী দেখলেন ত্রিগুণা সেন ? পুলিশ মর্গে গিয়ে দেখলেন কীভাবে নিশ্চিন্তে 'ঘুমের দেশে' চলে গেছেন এক বীরাঙ্গনা যিনি একদিন বাংলার ছোটলাটকে সেনেট হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুলি চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যিনি ছিলেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ বীর ও দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্রের জীবনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত বেণীমাধব দাসের কন্যা। যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নীতিগত কারণে। অথচ যিনি বহু চেষ্টা করেও আইনের বজ্রআঁটুনির জন্যে নিজের প্রাপ্য পেনশান আদায় করতে পারেননি সরকারের থেকে। বঞ্চিত হয়েছিলেন ন্যায্য অধিকার থেকে। বলা বাহুল্য যে, ত্রিগুণা সেন বীণাকে চিনতেন। যাদবপুরে যখন তিনি ভি সি তখন অনেক অনুষ্ঠানেই বীণার সাথে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। 

 বীরাঙ্গনা বীণা দাস ! তোমায় আমরা তোমার ন্যায্য অধিকার থেকে সেদিন বঞ্চিত করে যে অন্যায় করেছিলাম তার জন্যে তুমি আমাদের মতো এই অধম, অধঃপতিত ও নির্বোধ জাতিকে ক্ষমা করো।

Debasis Gautam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.