দেশ জুড়ে অবিলম্বে কার্যকর হোক ‘এক দেশ এক ভোট’ (ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন) পদ্ধতি। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে জমা দেওয়া রিপোর্টে এই সুপারিশ করেছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি। বৃহস্পতিবার কোবিন্দ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ কমিটির সদস্যেরা রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে দ্রৌপদীর হাতে রিপোর্টটি তুলে দেন। তাতেই ওই সুপারিশ রয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে দাবি।
আট খণ্ডে বিভক্ত ১৮ হাজার পাতার ওই রিপোর্টটি কমিটির সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে বলে কোবিন্দ জানিয়েছেন। চলতি সপ্তাহেই লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হতে পারে। তার আগে এই পদক্ষেপ ঘিরে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন। প্রসঙ্গত, দেশ জুড়ে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট করানোর লক্ষ্যে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার ওই কমিটি গড়েছিল।
ছ’মাস ধরে সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক দিকগুলি পর্যালোচনার পরে ২০২৯ সাল থেকে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকরের জন্য কয়েক দফা সুপারিশ করেছে কোবিন্দ কমিটি। তাতে একসঙ্গে লোকসভা এবং সব বিধানসভা ভোট করানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিকল্প আইনি ও প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ার কথা বলা হয়েছে। ‘এক দেশ এক ভোট’ কার্যকর করার যুক্তি দিতে গিয়ে প্রথমেই উন্নয়ন এবং আর্থিক বৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনেছে কমিটি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি ভোটের আগে আলাদা করে আদর্শ নির্বাচনীবিধি ঘোষণার ফলে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ব্যাহত হয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আর্থিক বৃদ্ধিতে। একসঙ্গে ভোট হলে তা এড়ানো সম্ভব হবে।
শুধু লোকসভা-বিধানসভা নয়। পরবর্তী সময়ে সেই ‘এক ভোট’ কর্মসূচিকে পুরসভা এবং পঞ্চায়েতগুলিকেও যুক্ত করার কথা বলেছে কোবিন্দ কমিটি। রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে, পরবর্তী ধাপে লোকসভা-বিধানসভা ভোটের ১০০ দিনের মধ্যে যাতে পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোটগুলির আয়োজন করা যায়, তার ব্যবস্থাও করতে হবে। কমিটির যুক্তি, এ ক্ষেত্রে একটি ভোটার তালিকাতেই কাজ হয়ে যাবে। সরকারি এবং পুরসভা-পঞ্চায়েতগুলির কর্মীদের অন্য পরিষেবামূলক কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
বিরোধী দলগুলি ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে, ‘এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর পরে কেন্দ্রে বা কোনও রাজ্যে পাঁচ বছরের আগেই নির্বাচিত সরকার পড়ে গেলে কী হবে? এ ক্ষেত্রে কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ— প্রয়োজনে বাকি সময়টুকুর জন্য আলাদা ভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। ফলে এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করতে হবে মোদী সরকারকে।
প্রসঙ্গত, বিরোধী দলগুলি গোড়া থেকেই ‘এক দেশ এক ভোট’ পদ্ধতির সমালোচনায় মুখর। তাদের মতে, এই নীতি নিয়ে মোদী সরকার ঘুরপথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ভাবনার পরিপন্থী বলেও বিরোধী নেতৃত্বের অভিযোগ। বিশেষত বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির আশঙ্কা, ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে লোকসভার ‘ঢেউয়ে’ বিধানসভাগুলি ‘ভেসে যাবে’।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, সাংসদ এবং বিধায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেটুকু বৈচিত্রের সম্ভাবনা রয়েছে, বিজেপির আগ্রাসী প্রচারের মুখে তা ভেঙে পড়বে বলেও কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলের অভিযোগ। ইতিমধ্যেই ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির বিরোধিতায় সরব হয়েছে তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, বিজেপির অঙ্ক হল, শুধু লোকসভা ভোট হলে বিরোধী দলগুলির পক্ষে আসন সমঝোতা করা সহজ হবে। কিন্তু একই সঙ্গে বিধানসভা ভোট জুড়ে দিতে পারলে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগী আঞ্চলিক দলগুলির বিরোধ অনিবার্য।
যদিও লোকসভা ভোটের সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট সেরে ফেলার পক্ষে মোদী সরকারের যুক্তি হল, এতে নির্বাচনের খরচ কমবে। একটি ভোটার তালিকাতেই দু’টি নির্বাচন হওয়ায় সরকারি কর্মীদের তালিকা তৈরির কাজের চাপ কমবে। ভোটের আদর্শ আচরণ বিধির জন্য বার বার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে থাকবে না। নীতি আয়োগ, আইন কমিশন, নির্বাচন কমিশনও এই ভাবনাকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে বলে কেন্দ্রের দাবি। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেই মোদী ‘এক দেশ এক ভোট’ তত্ত্ব প্রকাশ্যে এনেছিলেন। গত বাদল অধিবেশনে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল জানিয়েছিলেন, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করার জন্য আইন কমিশনের দ্বারস্থ হবে কেন্দ্র।