কসাই – বনফুল

‘শালা হারামিকা বাচ্চা…’

একটু চটলেই এই তার বুলি, কখনও স্বগত–কথনও প্রকাশ্যত। ছোট নিষ্ঠুর চোখ দুটো, মুখময় ছোট-বড় কতকগুলো আঁচিল, একটা ছোট আরও আছে ডান দিকের চোয়ালটার নিচে। ভ্রু নেই বললেই হয়। দাড়ি আছে। কটা, কোঁকড়ানো, অবিন্যস্ত। হঠাৎ দেখলে মনে হয় একটা ওলের উপর কটা চুল গজিয়েছে কতকগুলো। তাকে কেউ বোঝে না। সেও কাউকে বুঝতে চায় না। তাই উদীয়মান কমিউনিস্ট লেখক কমরেড দুলাল দত্ত যখন গল্প লেখার রসদ সংগ্রহ করবার উদ্দেশ্যে তার বাড়ি গিয়ে জিন্নাহ-গান্ধী সম্পর্কিত আলোচনা করে, মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং পাকিস্তান যে কতদূর ন্যায়সঙ্গত, তা বিচার করে, তার প্রকৃত মনোভাব জানবার চেষ্টা করছিল তখন সে তার হলদে শ্বাদন্ত বার করে হাঁ বাবু, হাঁ বাবু, বলে সায় দিচ্ছিল। কিন্তু মনে মনে সে আওড়াচ্ছিল–‘শালা হারামিকা বাচ্চা–‘

সে জানে কপালে যে লেবেল সেঁটেই আসুক না কেন ফরসা জামা-কাপড়-পরা বাবুমাত্রেই হারামিকা বাচ্চা। ছেঁড়া ময়লা কাপড়-পরা হারামিকা বাচ্চাও সে অনেক দেখেছে। কিন্তু তারা এমন স্বার্থপর ছদ্মবেশি নয়। ‘এই বাবু’রাই ‘আসলি হারামজাদা–‘

কোট-প্যান্ট-পরা আচকান-চাপকান- চড়ানো, খদ্দরধারী মোল্লা-মৌলভী, ডাক্তার-উকিল, হাকিম-ডেপুটি অনেক দেখেছে রহিম কশাই। তার চক্ষে সব শালাই হারামিকা বাচ্চা। সব শালা…

বিশেষ করে ওই দুলালবাবুর বাপটা। শালা সুদখোর। চতুর্থ পক্ষে বিয়ে করেছে হারামজাদা। তাগদের জন্য কচি পাঁঠার ঝোল খায় রোজ। ছেলেও হয়েছে একটা। নধরকান্তি শিশুটা পাশের গলিতে এসে খেলা করে যখন, রহিম কশাই চেয়ে চেয়ে দেখে মাঝে মাঝে। জোঁকের বাচ্চা। বড় হয়ে রক্ত চুষবে। দুলালবাবু আবার দরদ দেখাতে এসেছেন আমাদের জন্য–উড়ুনি উড়িয়ে পাম্পশু চড়িয়ে..শালা হারামিকা বাচ্চা…।

ঘোলাটে চোখ দুটোতে হিংস্রদীপ্তি ফুটে ওঠে। নড়ে ওঠে কটা কোঁকড়ানো দাড়িগুলো। ভারি ধারালো ছোরাটা চালাতে থাকে সজোরে।।..প্রকাণ্ড খাসির রান টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

পুরোহিত যেমন নির্বিকারচিত্তে ফুল তোলে, লেখক যেমন অসংকোচে শাদা কাগজে কালির আঁচড় টানে, রাঁধুনী অবিচলিত চিত্তে যেমন জীবন্ত কই মাছগুলো ভাজে ফুটন্ত তেলে, রহিমও তেমনি ছাগল কুচো করে অকুণ্ঠিত দক্ষতা সহকারে, একটুও বিচলিত হয় না।

একটা খাসি, একটা পাঁঠা, গোটা-দুই বকরী প্রত্যহ জবাই করে সে। আধসের পাঁঠার মাংস দুলালবাবুর বাপকে দিতে হয়। সুদস্বরূপ। কবে পঁচিশ টাকা ধার নিয়েছিল তা আর শোধই হচ্ছে না। ভিটে-মাটি সব বাঁধা আছে। সুদের সুদ..হিসাবের মার-প্যাঁচে বিভ্রান্ত হয়ে শেষে এই সোজা হিসাবে রাজী হয়েছে সে। রোজ আধসের কচি পাঁঠার মাংস। চতুর্থ পক্ষের অনুরোধে শালা তবু রাজী হয়েছে।

কিন্তু এ-ও আর পেরে উঠছে না রহিম। এই দুর্মূল্যের বাজারে রোজ কচি পাঁঠা জোটানো কি সোজা কথা! এ অঞ্চলের যত কচি পাঁঠা ছিল সব তো ওই শালার পেটে গেল। রোজ কচি পাঁঠা পায় কোথা সে। অথচ শালাকে চটানো মুশকিল। এক নম্বর হারামি, হেলথ অফিসারটা পর্যন্ত ওর হাতে-ধরা…ওর কথায় ওঠে-বসে। একটু ইঙ্গিত পেলেই সর্বনাশ করে দেবে।।..সেদিন সমস্ত রোদে ঘুরে ঘুরে রহিম হতাশ হয়ে পড়ল। একটু ভয়ও হল তার। কচি পাঁঠা কোথাও পাওয়া গেল না। কী হবে কে জানে!

হঠাৎ খুন চড়ে গেল তার। কচি পাঁঠা! চতুর্থপক্ষে বিয়ে করেছে শালা, কচি পাঠার ঝোল খাবে রোজ।

হারামিকা বাচ্চা। চিবুকের করা দাড়িগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল।

তার পরদিন বাবুর বাবুর্চি বললে এসে–‘কাল তুই যে মাংস দিয়েছিলি একেবারে ফাস্ট কেলাস। খেয়ে বাবুর দিল তর হয়ে গেছে। চেয়েপুটে খেয়েছে সব…।’

রহিম নীরব।
কেবল দাড়ির গোটা কয়েক চুল নড়ে উঠল। বাবুর্চি বলতে লাগল–‘খোকাটাকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাবুর মনে সুখ নেই, তা না হলে তোকে ডেকে বকশিশই দিত হয়তো। পাশের গলিতে খেলছিল–কোথায় যে গেল ছেলেটা। বাবু বলেছে, যে খুঁজে দিতে পারবে তাকে পঁচিশ টাকা বকশিশ দেবে। একটু খোঁজ করিস, বুঝলি…কি রে কথা কইছিস না কেন…রহিম পচ করে একবার থুথু ফেলে নীরবে মাংস কুচোতে লাগল। তার চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছিল।
Labels: গল্প, জ্যৈষ্ঠ ১৪২১, বনফুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.