কেমন হল থিয়েটার-সিনেমার মিশেলে তৈরি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’, জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন

শেক্সপিয়ার সেই কোন কালে লিখে গিয়েছিলেন, সারা পৃথিবীটা একটা মঞ্চ। সেই মঞ্চে আমরা এক এক জন এক একটি পুতুল। আমরা একে একে আমাদের সময় মতো সেই মঞ্চে প্রবেশ করি, বিধাতার দেওয়া বাক্য বলি এবং যথা কালে সেই মঞ্চ থেকে বিদায় নিই। রঞ্জন ঘোষ পরিচালিত ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ দেখতে দেখতে বার বার সেই কথাটাই মনে হচ্ছিল। প্রথমেই বলা দরকার, এই ছবির কোনও চরিত্রের কোনও নাম নেই। তারা এক একটি চরিত্রই। তারা পর্দার সামনে আসে, তাদের সংলাপ বলে এবং একে একে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করে। পুরো ঘটনা ঘটে কোনও এক গ্রামের এক পুরনো বনেদি বাড়ির উঠোনে। সেখানে দু’দিন পরেই ষষ্ঠী। মায়ের মূর্তি গড়া প্রায় সম্পূর্ণ।

সেই মঞ্চে প্রবেশ ঘটে চার জন কলেজের ফাইনাল বর্ষে পড়া ছেলেমেয়ের। তারা তাদের ‘ম্যাম’-এর বাড়িতে এসেছে পুজো কাটানোর জন্য। ‘ম্যাম’ দেশের প্রথম হতে-চলা নভশ্চর। আপাতত তিনি ভারতীয় বায়ুসেনার টেস্ট পাইলট। তিনি সংবেদনশীল, নারীবাদী, অন্যের দুঃখে কাতর। এর মধ্যেই খবর আসে যে, পাশের ধানক্ষেতে পাওয়া গিয়েছে এক কিশোরীর গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা দেহ। পর্দায়, থুড়ি মঞ্চে নেমে আসে স্তব্ধতা। সেই স্তব্ধতাকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে নিয়ে যায় বাড়ির পাশের আবর্জনা বিনে কুড়িয়ে পাওয়া একটি শিশুকন্যা। ম্যাম এবং ছেলেমেয়েরা শিশুকন্যাটিকে নিয়ে আসেন। তারাই তার দেখভাল করে।

ছবিতে কোনও নির্দিষ্ট গল্প নেই। টুকরো টুকরো পোস্টকার্ডে উঠে এসেছে নানা ইস্যু। দেশের মেয়েদের উপর অত্যাচার, পুরুষতান্ত্রিকতা, ধর্ষণ, এখনও জন্মের পর ফেলে দেওয়া কন্যাসন্তানের মতো ইস্যু। বা ধর্ষিতার ধর্ষকদের সুবিচার দেওয়ার বদলে যেখানে চলে ধর্মের রাজনীতি।

রঞ্জন ঘোষ পরিচালিত ছবি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ র একটি দৃশ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু মহিষাসুর কি শুধু মূর্তিতেই আবদ্ধ? সমাজের রক্তমাংসের মহিষাসুরদের কী হবে? পরিচালক এই সব বাস্তব টুকরো ছবির সঙ্গেই মিশিয়েছেন পুরাণকে। যেখানে সেই কবে থেকেই চলে আসছে সীতার সতীত্ব প্রমাণ করার তাড়না। যেখানে সূর্পণখার নাক কেটে দেওয়া হয়। যা চুঁয়ে পড়েছে এই মঞ্চের উপর হাঁটাচলা করা বাস্তব চরিত্রদের জীবনের ঘটনাবলির উপরও। ম্যাম এক জায়গায় বলেন, মহাত্মা গান্ধীর এ বছর ১৫০ বছর পূর্ণ হল। কিন্তু কস্তুরবা গান্ধীরও যে ১৫০ বছর হল সে কথা মানুষ কি আদৌ মনে রেখেছেন? বা মানুষ বিনয়-বাদল-দীনেশের কথা বলেন। কিন্তু বিপ্লবী বীণা দাসের মৃতদেহ খুন হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে ছিল। সে কথা এখন কত জন মনে রেখেছেন? আছে বর্তমানের কলঙ্কিত রাজনীতিবিদও। যে কি না এক সময়ে ইউনিয়নের নেতা হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠে-ময়দানে গলা ফাটাত, সে-ই এখন বাচ্চা মেয়ে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থেকেও আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যায়। পরিচালক প্রশান্ত কিশোরের মতো একটি চরিত্র এনেছেন ছবিতে। সে বিবাহিত। কিন্তু ডেটিং সাইটে নিজের নাম লিখিয়েছে। এর মধ্যেই আসে একটি আলো-করা চরিত্র— একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্ণধার যাঁরা বেওয়ারিশ লাশ দাহ করার দায়িত্ব পালন করেন। অন্য দিকে পরিশেষে শিশুকন্যার বেঁচে ওঠাকে কেন্দ্র করেও পরিচালক একটি আশার বার্তা রাখেন।

ছবিতে সিনেমার সঙ্গে থিয়েটারকে মিশিয়েছেন পরিচালক। সেই জন্যই বাড়ির উঠোন মঞ্চের রূপ পায়। প্রথম থেকে শেষ— এক পোশাকেই অভিনয় করে গিয়েছেন শিল্পীরা। মাত্র একটি রাতের ঘটনা উন্মোচিত হয় ছবি জুড়ে। ছবিতে সে রকম কোনও ক্লাইম্যাক্স নেই। ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ দেখতে দেখতে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মুখোমুখি’ ছবির কথা মনে পড়ে। সে ছবিতেও ছিল এ রকম থিয়েটার এবং সিনেমার মিশেল।

মাঝেমাঝে ছবির সংলাপ একটু উচ্চকিত মনে হয়। ইস্যুভিত্তিক যে ঘটনাবলী পরিচালক সংলাপের মধ্যে দিয়ে এনেছেন তা আরও একটু বিস্তৃত ভাবে দেখানো হলে বোধ হয় আরও ভাল হত। শিল্পীরা সবাই ভাল অভিনয় করেছেন। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (ম্যাম), শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (রাজনীতিবীদ), পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের (প্রশান্ত কিশোরের চরিত্র) অভিনয় নিয়ে বলার কিছু নেই। সম্পূর্ণ গ্ল্যামার-রহিত ঋতুপর্ণাকে দেখতে বেশ সুন্দর লেগেছে। চার জন তরুণও ভাল করেছেন। ছোট্ট একটি চরিত্রে (মুসলমান নেতা-গোছের একটি চরিত্র) থিয়েটারের কৌশিক কর খুব ভাল। ভাল অতিথিশিল্পী হিসেবে সাহেব ভট্টাচার্যও। ছবির চিত্রনাট্যও রঞ্জনের। সেখানে কোনও গলদ নেই। পরিচালক যা এবং যে রকম ভাবে দেখাতে চেয়েছেন তাই দেখিয়েছেন। ছবির রঙের গ্রেডিং খুব ভাল। সঙ্গীতও মিনিম্যাল। যেটা ছবির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, ‘মহিসাসুরমর্দ্দিনী’ রঞ্জনের সবচেয়ে পরীক্ষামূলক ছবি। তাঁর আগের ছবিগুলোর থেকে এই ছবি স্বাদে-গন্ধে-সৃজনে একেবারে আলাদা। এই প্রচেষ্টার জন্য তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। দর্শক এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাবেন, এ আশা করাই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.