লালসন্ত্রাস বনাম #জাগ্ৰতবিবেক – বরিস বাঝানভ

একেই বলে দূরদর্শিতা ! সঠিক সময়ে ইউ টার্ন নিয়ে প্রাণে বাঁচা। স্তালিনের এত কাছে থেকেও বেঁচে যাওয়া এক বিরল ঘটনা। এক্কেবারে পলিটব্যুরোর সদস্য আর স্তালিনের ব্যক্তিগত সচিব। বিভিন্ন মিটিং – এ নোট নেওয়ার কাজ করতেন। তাই তার স্মৃতিকথা থেকে এমন অনেক তথ্যই উঠে আসে যা জানা প্রায় অসম্ভব ছিল। গুলাগ-ফেরত নোবেলজয়ী লেখক অ্যালেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিন (Aleksandr Solzhenitsyn) তার আত্মকথা ‘The Gulag Archipelago’ তে মৃত বলে ধরেই নিয়েছিলেন স্তালিনের এই সহচর কে কিন্তু প্যারিসে হঠাৎ করে দেখা পেয়ে তাকেও নিজের স্মৃতিকথা লেখার উৎসাহ দেন।

বোরিস জর্জিভিচ বাঝানভ (Boris Georgievich Bazhanov) ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি ১৯২৩ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত যোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন — সেই সময় যখন স্তালিন সমস্ত ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করছে।তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি স্তালিনের অভ্যন্তরীণ চক্র থেকে পালিয়ে পশ্চিমে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং জীবিত অবস্থায় কমিউনিস্ট শাসনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং ষড়যন্ত্রের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

বাঝানভ জন্মগ্রহণ করেন ১৯০০ সালে ইউক্রেনে। শৈশবে তিনি মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হন এবং বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাজ করার সুযোগ পান এবং সেখান থেকেই স্তালিনের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

বাঝানভ যখন ক্রেমলিনে কাজ করছিলেন, তখন তিনি কাছ থেকে দেখতে পান কিভাবে স্তালিন ক্ষমতার লোভে ধূর্ততা, মিথ্যাচার, হত্যার মাধ্যমে সবকিছু নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। তিনি ক্রমে বুঝতে পারেন যে, মার্ক্সবাদ এমন একটি আদর্শ যা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকারকে হরণ করে। স্তালিন ছিলেন এর চূড়ান্ত প্রতিভূ।

তিনি তাঁর অনূদিত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘Bazhanov & the Damnation of Stalin’ এ মন্তব্য করেন —- “To tell the truth, the more I got into Marxist theory, the more this gibberish which sought to represent itself pompously as an economic science, nauseated me. ” অর্থাৎ “সত্যি বলতে, যতই আমি মার্ক্সবাদী তত্ত্বে গভীরভাবে প্রবেশ করতাম, ততই এই অর্থহীন কথাবার্তা, যা নিজেকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে একটি অর্থনৈতিক বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করত, আমাকে বিতৃষ্ণায় ভরিয়ে দিত”।
এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি মার্ক্সবাদের প্রতি যে আকর্ষণ নিয়ে বলশেভিক পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, তার সম্পূর্ণ বিপরীত এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হন।

বাঝানভ শুরুতে ছিলেন একজন কট্টর মার্ক্সবাদী। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কাজ করার সময় তিনি দেখেন —
কিভাবে ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব’ এক ব্যক্তির একনায়কত্বে পরিণত হয়েছে , কিভাবে দলীয় শুদ্ধিকরণের নামে (The Great Purge ) হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে , কিভাবে বিরোধী কণ্ঠকে দমন করতে গুপ্তচর সংস্থা (চেকা, পরে GPU/NKVD) ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই অভিজ্ঞতাই তাঁর চোখ খুলে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, মার্ক্সবাদ বাস্তবে মানবাধিকারের শত্রু এবং আদর্শের নামে একটি দানবীয় শাসন কায়েম করেছে।
১৯২৮ সালে বাঝানভ মধ্য এশিয়ার এক সরকারি সফরের সুযোগে তুর্কমেনিস্তান হয়ে , ইরানে পালিয়ে যান। ইরান – সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে প্রত্যর্পণের চুক্তি হলে বাজানো ভারত হয়ে ফ্রান্সে শরণার্থী হন। এরমধ্যে বাজানভ কে ধরতে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ; জর্জেস আগাবেকভ (Georges Agabekov) — সেও ফ্রান্সে পালিয়ে যায়। ১৯৩৭ পর্যন্ত বাঝানভ কে আততায়ীর মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
বাঝানভ ফ্রান্সে বসবাস করে বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে স্তালিন শাসনের নৃশংসতা ফাঁস করেন। তাঁর সাক্ষ্য সোভিয়েত-বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে ওঠে।
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রথম দেশত্যাগী বাজানভ ‘The Storm Petrels: The Flight of the First Soviet Defectors’ – বইতে ‘মার্ক্সবাদের বিকৃত পথ’ সম্পর্কে তার বক্তব্য —
You know, as I do, that our civilization stands on the edge of an abyss … Those who seek to destroy it put forth an ideal. This ideal [of communism] has been proven false by the experience of the last sixty years … the problem of bringing freedom back to Russia is not insoluble … the youth of Russia no longer believe in the system, despite the fact that they have known nothing else. If the West [develops its] confidence and unity, [it] can win the battle for our civilization and set humanity on the true path to progress, not the twisted path of Marxism.
[তুমি যেমন জানো, আমিও জানি — আমাদের সভ্যতা এক গভীর খাদে পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে… যারা একে ধ্বংস করতে চায়, তারা এক আদর্শ তুলে ধরে। এই আদর্শ [কমিউনিজমের] মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে গত ষাট বছরের অভিজ্ঞতায়… রাশিয়ায় স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সমস্যা অমীমাংস্য নয়… রাশিয়ার যুবসমাজ আর এই ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস রাখে না, যদিও তারা জীবনে আর কিছু চেনেইনি। যদি পশ্চিমা বিশ্ব আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য গড়ে তুলতে পারে, তবে তা আমাদের সভ্যতার যুদ্ধ জয় করতে পারবে এবং মানবজাতিকে প্রকৃত উন্নতির পথে পরিচালিত করতে পারবে — মার্ক্সবাদের বিকৃত পথে নয়।]

বোরিস বাঝানভ একজন বিরল ব্যক্তি যিনি সোভিয়েত প্রশাসনের অন্তঃস্থলে থেকে তার ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছিলেন এবং বিশ্ববাসীর সামনে সত্য উদ্ঘাটনের সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁর লেখা এবং বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায়, কিভাবে একজন আদর্শবাদী যুবক ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট আদর্শের ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে মানবতাবাদ ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নেন। বোরিস বাঝানভ কে স্তালিন মারতে পারে নি যেমন দমন করা যায় নি বরিসের আত্মকথা কে যার ফলে মার্ক্সবাদের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে বরিস বাঝানভের আত্মকথা এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.