বিএসএফের পূর্ণম দেশে ফিরে আসায় সকলে উচ্ছ্বসিত! আমি ওঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, লিখলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা

যে দিন বৈসরন উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী হামলা হল, ঘটনাচক্রে তার পর দিনই আন্তর্জাতিক সীমান্তে কর্তব্যরত বিএসএফ কনস্টেবল পূর্ণমকুমার সাউ পাকিস্তানি রেঞ্জার্সের হাতে ধরা পড়লেন। শোনা গেল, সীমান্তে টহলদারির সময়ে ভুল করে তিনি পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছিলেন। তখনই পাক রেঞ্জার্সরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।

২২ দিন পাক হেফাজতে কাটিয়ে পূর্ণম মুক্তি পেয়েছেন। ভারতের হাতে বন্দি পাক রেঞ্জার্সের জওয়ানকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে পূর্ণমকে দেশে ফেরানো গিয়েছে (যদিও দেশের সংবাদমাধ্যমের একটা অংশ সেই তথ্যটা প্রায় এড়িয়েই গিয়েছে। কেন কে জানে)। তার পর থেকে পূর্ণমকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত সকলে। স্বাভাবিক। ভারত-পাক সংঘাতের যে আবহ চলছে, তার মধ্যে এক বিএসএফ জওয়ান যদি পাকিস্তানের হেফাজত থেকে দেশে ফিরে আসেন, তা হলে দেশের মানুষ আবেগতাড়িত হবেন। এটাই প্রত্যাশিত। পূর্ণমের পরিবার আনন্দিত। তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী উদ্বেগ নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। তিনিও এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত।

পূর্ণমের ঘটনাটা দেখতে দেখতেই অভিনন্দন বর্তমানের কথা মনে পড়ছিল। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানবহরের হামলা ঠেকাতে মিগ-২১ বাইসন ফাইটার জেট নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলট অভিনন্দন। পাকিস্তান স্বীকার করুক বা না করুক, মিগ-২১ বাইসনের মতো পুরনো জমানার ফাইটার জেট নিয়েই পাক বাহিনীর অন্তত একটি এফ-১৬ ফাইটারকে তিনি ঘায়েল করেছিলেন। কিন্তু তার পরে অভিনন্দনের নিজের বিমানটিও ধ্বংস হয়। বিধ্বস্ত বিমান থেকে তিনি ‘ইজেক্ট’ (ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের আসন থেকে নিজেকে উপড়ে নেওয়া। পরে প্যারাস্যুটে অবতরণ) করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্যারাস্যুট নেমেছিল পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে।

প্রথমে স্থানীয়েরা এসে ভারতীয় পাইলটকে ধরে ফেলেন। তার পরে ঘটনাস্থলে পাক রেঞ্জার্স পৌঁছোয় এবং অভিনন্দনকে হেফাজতে নেয়। ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত গড়াতে থাকে। ভারত সরকারের হুঁশিয়ারির মুখে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অভিনন্দনকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই তাঁকে ভারতে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে অভিনন্দন দেশে ফিরেও আসেন। কিন্তু ফেরার পরে অভিনন্দনকে অন্তত ছ’মাস বিমান ওড়াতে দেওয়া হয়নি। পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। এখনও আমরা জানি না অভিনন্দন ভারতীয় বায়ুসেনার কোন বিভাগে কর্মরত।

অভিনন্দনের সঙ্গে পূর্ণম‌ের ঘটনার একটা তফাতও আছে। অভিনন্দন লড়াইয়ে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁকে পূর্ণমের মতো ২২ দিন ধরে পাকিস্তানে আটকে থাকতে হয়নি। তা সত্ত্বেও দেশে ফেরার পরে অভিনন্দনকে ছ’মাস বিমান ওড়াতে দেওয়া হয়নি। কারণ, তিনি শত্রুর হাতে ধরা পড়েছিলেন। শত্রুর হাতে ধরা পড়া একজন সৈনিকের জন্য ‘গৌরবজনক’ নয়।

যে কোনও বাহিনীর যে কোনও সদস্য শত্রুর হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরলে প্রথমেই তাঁকে ‘গ্রেফতার’ করা হয়। সেটাই রীতি। তার পরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এবং পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে ‘কমিশন অব এনকোয়্যারি’ (তদন্ত কমিশন) গঠন করা হয়। নানা পর্বের মধ্য দিয়ে সেই কমিশন ঘটনার সব দিক খতিয়ে দেখে। এই সব পর্ব অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি হয়। সেই তদন্তের ভিত্তিতেই বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়।

পূর্ণমের ক্ষেত্রেও তেমন হবে নিশ্চয়ই। যেমন এ-ও নিশ্চিত যে, তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাসও চলবে। দেশজোড়া সেই উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক প্রাক্তন সদস্য হিসাবে আনন্দবাজার ডট কম-এর মাধ্যমে পূর্ণমকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই।

এক: টহলদারির সময়ে আপনি ভুল করে পাকিস্তানে ঢুকে পড়লেন কী ভাবে?

যেখানে আপনি কর্তব্যরত ছিলেন, সেই ফিরোজপুর এলাকায় ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত। সেখানে ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ নেই। আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। যেখানে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থাকে, সেখানে কাঁটাতার থাক বা না থাক, সীমান্ত স্তম্ভ (পিলার) খুব স্পষ্ট দৃশ্যমান থাকে। দু’দেশের সীমান্ত স্তম্ভের মধ্যে প্রশস্ত ‘জ়িরো পয়েন্ট’ও থাকে। আপনি ১৬ বছর ধরে বিএসএফে কাজ করছেন। অর্থাৎ, যথেষ্ট অভিজ্ঞ কনস্টেবল। এত দিনে আপনার হেড কনস্টেবল হয়ে যাওয়ার কথা। আপনি সীমান্ত, সীমান্ত স্তম্ভ, জ়িরো পয়েন্ট বুঝতে পারলেন না? পাকিস্তানে ঢুকে পড়লেন এবং সেখানে একটি গাছের তলায় ঘুমিয়েও পড়লেন?

দুই: আপনি যখন পথ ভুলে পাকিস্তানে ঢুকে পড়লেন, তখন আপনার সঙ্গীরা কী করছিলেন?

বিএসএফ সূত্রে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল, আপনি সীমান্তে টহল দিচ্ছিলেন। টহলদারি, অর্থাৎ ‘পেট্রলিং ডিউটি’। পেট্রলিং ডিউটিতে কখনও কোনও জওয়ান একা তো থাকেন না। এক সঙ্গে কয়েক জন মিলে থাকেন। একে তো পাকিস্তান সীমান্ত। তার মধ্যে পহেলগাঁওয়ের ঘটনার ঠিক পর দিন। ধরেই নেওয়া যায়, উচ্চ সতর্কতায় থাকা আন্তর্জাতিক সীমান্তে আপনি একা একা টহল দিচ্ছিলেন না। সে ক্ষেত্রে আপনি যখন পথ ভুলে পাকিস্তানে ঢুকে পড়ছিলেন, তখন আপনার সঙ্গী টহলদারেরা কী করছিলেন? তাঁরা কেউ কিছু দেখতে পেলেন না?

তিন: আপনি গুলি চালালেন না কেন?

আপনি টহলদারিতে ছিলেন। আপনার হাতে তো একে-৪৭ রাইফেল থাকার কথা। অন্তত সশস্ত্র থাকার কথা তো বটেই। আপনাকে ধরার সময় বাধা দিলেন না কেন? যে কোনও সৈনিকের এই পরিস্থিতিতে গুলি চালানো উচিত। আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় এটা বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, কিছুতেই শত্রুর হাতে ধরা পড়া যাবে না। পরিস্থিতি যেমনই হোক, হয় গুলি চালিয়ে মেরে দাও। নইলে নিজে গুলি খাও। ধরা পড়লে চলবে না।

চার: আপনার ঘটনায় বাহিনীর সদস্যদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছোচ্ছে না তো?

আবার বলছি, সৈনিক হিসেবে সব সময় আমাদের মাথায় রাখতে হয় যে, কিছুতেই শত্রুর হাতে ধরা পড়া চলবে না। ধরা পড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে হয় গুলি চালিয়ে মেরে ফিরে এসো। না হলে নিজে গুলি খেয়ে শহিদ হও। কিন্তু কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। আপনার ঘটনার পরে বাহিনীতে এই প্রশ্ন জাগার অবকাশ তৈরি হতে পারে যে, প্রাণ বাজি রেখে দেশের জন্য লড়ে কি লাভ? শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গেলে দেশের সরকার নানা কাঠখড় পুড়িয়ে আমাকে ফিরিয়ে আনবে। আপনার ঘটনায় বাহিনীর কাছে কোনও ভুল বার্তা গেল না তো?

পাঁচ: কিছু কি গোপন করা হচ্ছে?

সেনাবাহিনীর সদস্য থাকার সুবাদে জানি, সীমান্তবর্তী এলাকায় নানা ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ চলে। তাতে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের ভূমিকাই সবচেয়ে বড়। কিন্তু সেই দুষ্কৃতীদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কারও কারও যোগসাজশের অভিযোগও ওঠে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সকলেই যে এমন দোষে দুষ্ট তা নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে কয়েক জনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাপ্রবাহে তেমন কিছুর ছায়া নেই তো?

পূর্ণম কবে তাঁর রিষড়ার বাড়িতে ফিরবেন, তা ঠিক করবেন বাহিনীর পদস্থ আধিকারিকেরা। আমি তাঁর সুস্থতা এবং দীর্ঘ জীবন কামনা করি। আশা করি, তিনি তাঁর স্ত্রী-সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হবেন। কিন্তু একই সঙ্গে আশা করি, বাহিনীর তদন্ত কমিশন এই প্রশ্নগুলি তাঁর সামনে রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.