অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ইন্দোনেশিয়ার জাভার প্রাম্বানান মন্দির বা ‘লোরোজোঙ্গরাং’। ২৪০টি মন্দির নিয়ে এ-এক সুবিশাল কমপ্লেক্স যা আম্বানান আর্কিওলজিক্যাল পার্কের অন্তর্গত। ‘ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’ এই প্ৰাম্বানান মন্দিরটি ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম হিন্দু মন্দির এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড়ো মন্দির প্রাঙ্গণ। ইউনেস্কোর মতে, The property is an outstanding religious complex, characteristic of Siva expression of the 10th Certury..। মূলত ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবকে উৎসর্গ করে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল আনুমানিক ৮৫০ সালে, শৈলেন্দ্র রাজবংশের রাজত্বের স্বর্ণযুগে।
প্ৰাম্বানান মন্দিরের অতুলনীয় কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে ৩টি। প্রধান মন্দির যা বিষ্ণু, শিব ও ব্রহ্মাকে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত। এই ত্রিমূর্তি মন্দিরের সামনে রয়েছে ৩টি ‘বাহন মন্দির। অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের ৩টি বাহনের মন্দির। সেগুলি যথাক্রমে, গরুড়, নন্দী ও হংস-কে নিবেদন করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণে ত্রিমুর্তি ও বাহন মন্দিরগুলির মধ্যে রয়েছে ২টি ‘অর্পিত মন্দির। অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের ৪টি প্রধান প্রবেশ দ্বারের ঠিক বাইরে। রয়েছে ৪টি ছোটো কিলিং মন্দির। এই অত্যন্তরীণ অঞ্চলেরই ৪টি কোণে রয়েছে ৪টি ছোটো পটক মন্দির’। বাকি ২২৪টি ‘পারভারা মন্দির কমপ্লেক্সের ভিতরের অংশ ও বাইরের । অংশের মাঝ বরাবর ‘চারদিকে সমকেন্দ্রিক বর্গাকারে’ সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো। বাইরের সারি থেকে ভিতরের সারির । মন্দিরগুলির সংখ্যা যথাক্রমে ৪৪, ৫২, ৬০ এবং ৬৮। মন্দির । চত্বরের একেবারে ভিতর অংশে ৪৭ মিটার উঁচু কেন্দ্রীয় ভবনটি অবস্থিত। এখানে ভগবান শিব পূজিত হন। প্রাধানানের অত্যাশ্চর্য মন্দিরটি আসলে হিন্দুদের ‘স্বর্গ’ সম্বন্ধীয় ধারণাটিকে প্রকাশ করছে (‘Pramlearar exudes Hindu canceptions of heaven’-Ancient History Encyclopedia)…।
গোটা মন্দির প্রাঙ্গণটি ৩টি অংশে বিভক্ত। পবিত্রতম। অভ্যন্তরীণ অংশে মোট ৮টি প্রধান মন্দির এবং ৮টি ছোটো মন্দির রয়েছে। দ্বিতীয় অংশটিতে রয়েছে কয়েকশো ছোটো মন্দির। এর পরে রয়েছে মন্দির চত্বরের একেবারে বাইরের অংশটি। তবে প্রাধানান মন্দির চত্বরের অধিকাংশ মন্দিরই । বর্তমানে নষ্ট হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও, মন্দিরটির আধ্যাত্মিক ও শৈল্পিক মূল্য অপরিসীম। অধ্যাপক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘প্ৰাম্বানান মন্দিরগাত্রে খোদিত চিত্রাবলীতে বিষ্ণুমন্দির গাত্রে শ্রীকৃষ্ণের জীবনলীলা বিষয় অথবা। লোরোজোঙ্গরাং শিব মন্দিরের রামায়ণী চিত্র সমূহে একটা। মানবতার আভাস পাওয়া যায়। এই কারণে এইগুলি আমাদিগকে অধিকতর আনন্দদান করে। মনে হয় যেন আজন্ম পরিচিত রামায়ণ মহাকাব্যটি প্রস্তরলিপিতে পাঠ করিতেছি। ইউনেলো বলেছে, পাথরে উত্তীর্ণ রামায়ণের শিলা-উল্কর্ষের কোনো তুলনা হয় না (The Hindu temples are decorated with reliefs illustrating the Indonesion version of the Ramayana epic which are mesterpieces of stone carvings)…। প্রসঙ্গত, প্ৰাম্বানান মন্দির প্রাঙ্গণে সেই ১৯৬১ সাল থেকে প্রত্যেকদিন। নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘রামায়ণ-ব্যালে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যে কোনো স্টেজ শোয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশ্বরেকর্ড। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই ব্যালে শিল্পীদের অধিকাংশই অন্য ধর্মের মানুষ। প্ৰাম্বানান মন্দিরের আরও এক উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মা দুর্গার এক জগতবিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। ইতিহাস। বলছে, ১৫ শ থেকে ১৬ শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায়। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে প্ৰাম্বানান মন্দির ও সংলগ্ন অঞ্চলের ৫০০টিরও বেশি মন্দির। শুধুমাত্র এক অসামান্য স্থাপত্য ও সংস্কৃতির নিদর্শন বহন করছে। শুধু নয়, এগুলি এখানকার শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থানেরও। প্রমাণ। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’— ভারতীয় সংস্কৃতির এই অন্যতম মন্ত্রটি একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ইন্দোনেশিয়ার প্ৰাম্বানান মন্দির তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
ড. স্বয়ংদীপ্ত বাগ
2019-08-17