মিশরে মাখন চোর

মিশর দেশে বড়ো এক শহর আছে, তার নাম ‘কনক’। পুরাকালে সেখানে আমাদের মতোই ছিল রাজা-রানি, মন্দির, বিগ্রহ এবং পূজাপদ্ধতি। পৌরাণিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, মর্ত্যে গঙ্গার আবির্ভাব হয়েছিল মহাবিষ্ণর পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে। ভাগবত পুরাণ থেকে জানা যায়, ভগবান বিষ্ণু বামন অবতারে মহাপরাক্রমী অসুর বলির অহংকার চূর্ণ করার জন্য তার রাজসভায় যান এবং ‘তিনপদ’ ভূমি ভিক্ষা করেন। শুধুমাত্র বাম পায়ে সারাবিশ্ব আবৃত করে বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছাদকে বিদীর্ণ করে গঙ্গার আবির্ভাব ঘটান। সেইজন্য তার অন্য নাম হচ্ছে। বিষ্ণুপদী। গঙ্গা তারপর ব্রহ্মলোকে চলে যান। ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মলোক থেকে মর্ত্যে নেমে আসার পূর্বে শিবের জটায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সারা জগতের সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণু হচ্ছেন হিন্দুদের পরম আরাধ্য দেবতা। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, আকাশ, পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, এমনকী তেত্রিশ প্রকার উপদেবতা অর্থাৎ রুদ্র, বাসু, আদিত্য, মারুত ইত্যাদিরও সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর। তিনি স্বয়ম্ভু। ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণত্বমস্য’ (গীতা : ১১/৩৮), “বায়ুর্বমোহগ্নিবরুণঃ শশাঙ্কঃ প্রজাপতিত্ত্বং প্রপিতামহশ্চ” (গীতা : ১১/৩৯)।
মিশর দেশেও আমাদের পৌরাণিক ইতিহাসের মতোই এক প্রচলিত উপকথা আছে। ‘কর্ণকের’ প্রাচীন ইতিহাসে। তাদের সবথেকে বড়ো দেবতার নাম ‘আমন’বা “আমন-রা। আর মিশরের সব থেকে বড়ো নদীর নাম হচ্ছে নাইল বা নীলনদ, যেমন আমাদের আছে পবিত্র নদী গঙ্গা। তাদের ধারণা পবিত্র নীলনদও বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আমনরা’-র পায়ের আঙুল থেকে সৃষ্টি হয়েছে মিশরবাসীর কল্যাণের জন্য।
নীলের অর্থ হচ্ছে সর্বব্যাপী, গভীর, অসীম ও অনন্ত। আকাশের রং নীল। মহাসমুদ্রের বর্ণ নীল। মহাবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের রংও তাই সনাতন ধর্মে নীল দেখানো হয়েছে।
‘আমনরা’-র গাত্রবর্ণ নীল, দ্বিভুজ অস্ত্রধারী মূর্তি এবং উষ্ণীষ শোভিত। আর মাথার ওই মুকুটে লাগানো আছে দুটি লম্বা পাখা। সবথেকে বড়ো ভারতের জাতীয় পাখি হচ্ছে ময়ুর। আর একমাত্র ময়ূরের পাখাই এত লম্বা হতে পারে। আমাদের প্রাণগোবিন্দ নীলাম্বরধারী শ্রীকৃষ্ণের গাত্রবর্ণ কলিযুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গাঢ়নীল হয়েছে এবং তার মাথার মুকুটেও আছে দুটি ময়ূরপুচ্ছ। অদ্ভুত মিল!
‘আমনরা’-র মূর্তির সঙ্গে সর্বদাই থাকে একটি স্ত্রী মূর্তি, ‘মুথ’ আর একটি পুরুষ মূর্তি ‘খ’। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন ভগিনী এবং ভ্রাতা, আবার অন্য কেউ বলেন স্ত্রী ও পুত্রের মূর্তি। আমাদের পৌরাণিক উপকথাতে বর্ণিত হয়েছে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের রাজসভায় রুক্মিণীর সঙ্গে প্রদ্যুম্নর উপাখ্যান। তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণ, সুভদ্রা ও বলরামের ত্রিমূর্তির চিত্র সারা বিশ্বের হিন্দুর কাছে অত্যন্ত পরিচিত।
আমরা সবাই ছোটোবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি, প্রতিবছর বর্ষাকালে মিশরের নীল নদীতে বান আসে আর তা সমস্ত মিশরকে ভাসিয়ে দেয়। এটা নীলনদের অভিশাপ না আশীর্বাদ তামিশরবাসীরাই জানেন। কিন্তু সেই বর্ষাঋতুতে আবহমানকাল থেকেই নাকি চলে আসছে ‘আমনরা’র পূজা। কনক থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত লাক্সর আরও একটি শহর। থেবিয়ান প্রথা অনুযায়ী আমনরা’র সেই ত্রিমূর্তির, স্নান, অভিষেক, নতুন বস্ত্র পরিধান এবং তিনটি বৃহৎ আকারের সুসজ্জিত নৌকায় চাপিয়ে কনক থেকে লাসর ২ কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করতো শোভাযাত্রা সহকারে। প্রতিবছর যা ছিল “আমনরা’কে সাক্ষী রেখে রাজার রাজ্যাভিষেক।
সাবার আগে ফারাও অর্থাৎসম্রাট ত্রিমূর্তির পূজা করতেন। তারপর প্রধান পুরোহিত-সহ অন্য ভক্তদের জাঁকজমক সহকারে, নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যগীতের মাধ্যমে দেবতার পূজা করতে করতে লারের মন্দিরে পৌঁছানোর কথা বর্ণিত হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় উপকথায়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন স্ফিংসের ‘কলনাড’ রাজমার্গ ধরে পায়ে হেঁটে, আবার অন্যরা বলেন তিনটি মাস্তুল সমন্বিত বিশালাকৃতি তিনটি জাহাজে ওই ত্রিমূর্তি বহন করে নদীপথে এই শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী ‘নুবিয়ান’ সংগীতশিল্পী ও ‘থেবিয়ান’নর্তকীদের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। নতুন বছরের সূচনা স্বরূপ বর্ষাঋতুর আগমনের সঙ্গে মিশরবাসীদের এই বার্ষিক উৎসবের নাম ছিল ‘ওপেত। প্রাচীনকালে ‘কনক’ ও ‘লাক্সর’ শহরে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হতো এই জাতীয় উৎসব। খ্রিস্টীয় ৬৪০ সালের পর অর্থাৎ মুসলমান খলিফার বিধ্বংসী আক্রমণ ও বিজয়ের পর যথারীতি সমৃদ্ধিশালী বাইজান্টাইন ও সেসানিড সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিলোপ ঘটে অচিরেই।
‘লাক্সরে’র মন্দিরে পৌঁছানোর পর ‘আমনরা’র হাত থেকে পবিত্র রাজদণ্ড গ্রহণ করে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে রাজ্য পরিচালনা করার দায়িত্ব ও অনুমতি নিতেন ফারাও। এটা শুধু রাজকীয় শাসন ব্যবস্থার নাটকীয় রূপই ছিল না, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্যের বৈশিষ্ট্যও ছিল বিদ্যমান। বছরের শুরুতে বর্ষাঋতুর আগমন এবং আপামর মিশরবাসীর যোগদান, অর্থনৈতিক লেনদেন, সম্রাট, সৈনিক, পুরোহিত এবং প্রজার একত্র সহাবস্থান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সহভাগী হওয়ার মধ্যে সামাজিক সমতার কথাই বেশি করে প্রকট হয়। বিশেষজ্ঞের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে ওই সামাজিক উৎসবে মন্দির কর্তৃপক্ষ প্রায় ১১,৩৪১টি খাদ্য মোড়ক ও পানীয়র ব্যবস্থা করতেন। বিশেষজ্ঞের মতে লাক্সারের রাজমার্গ ও মন্দির দুটিই নাকি তৈরি করেছিলেন রানি ‘হাতসেপসুট। আমনরা’র ত্রিমূর্তি লাসারে আগমন করলে, সেখানে রানি যথারীতি পূজা করতেন এবং ২৬ দিনের মাথায় ‘কলনেডে’র রাজমার্গ ধরে সুসজ্জিত নৌকায় চড়ে অসংখ্য পুরোহিতের ঘাড়ে চেপে, সাধারণ মিশরবাসী আর সৈনিক পরিবৃত হয়ে, শোভাযাত্রার সঙ্গে আবার ‘কর্নকের’ মন্দিরে ফিরে আসতেন। স্মরণাতীতকাল ধরেই নাকি এই প্রথা চলে আসছিল মিশরের কনক শহরে।
মিশরের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে খ্রিস্টপূর্ব ২০৫৫ থেকে ১৬৫০-এর মধ্যে দ্বাদশ রাজবংশীয় সম্রাট প্রথম সেনুরেথের সময় মিশরের প্রধান দেবতা ছিল ‘আতুম’– যার নামে উৎসর্গিত হয়েছিল বিশাল এক মন্দির। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা স্তম্ভগুলির লিপিতে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। পরবর্তী অষ্টাদশ রাজবংশীয় সম্রাট তৃতীয় আমেনহোটেপের সময় প্রথম ‘আমনরা’র বিবরণ পাওয়া যায়। “আমনরাই ছিলেন আদি দেবতা যিনি অন্যান্য দেবতারও সৃষ্টিকর্তা বলে উল্লেখিত হয়েছেন। মিশরের ‘কর্নকের সঙ্গে পুরীর কোণারকের হয়তো কোনো সম্বন্ধ থাকলেও থাকতে পারে যা বিশেষ অনুসন্ধান সাপেক্ষ। তবে প্রাচীনভারতবিষয়ক একবিশিষ্ট গবেষক ও জার্মান ইতিহাসকার অধ্যাপক পিটার ভন বোলেনের কথায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে সমুদ্রপথে ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে প্রাচীন মিশরের সুগভীর সম্পর্ক ছিল, এটা প্রমাণিত সত্য। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অভিজ্ঞতা নেই এমন হিন্দুর সংখ্যা বিরল। মিশরের কনক মন্দিরের ওপেত উৎসব এবং পুরীর রথযাত্রার হুবহু মিলের কথা শুনে যে কোনো হিন্দুরই গর্ব বোধ হওয়ার কথা।
পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, নারদপুরাণ, এমনকী রামায়ণেও বর্ণিত হয়েছে। জগন্নিবাস জগন্নাথের পূজা-অর্চনার মধ্যে দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় ও মোক্ষপ্রাপ্তির কথা। অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে বর্ষাঋতুতে পুরীর বার্ষিক জগন্নাথদেবের পূজা। মহাভারতের যুদ্ধের শেষে শ্রীকৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগ এবং কলিযুগের আরম্ভ থেকেই পুরীর জগন্নাথদেবের পূজার প্রচলন। জরা। ব্যাধের তিরের আঘাত, মধ্যপ্রদেশ থেকে ওড়িশার সমুদ্র উপকূল ধরে জরা ব্যাধের শ্রীকৃষ্ণের অনুসন্ধান, নীলগিরি পাহাড়ের নির্জন বনের মধ্যে নীলমাধবের পূজা-অর্চনা, ওড়িশার রানি গুণ্ডিচার স্বপ্নাদেশ এবং নীলমাধবের খোঁজ, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সঙ্গে নিষাদরাজের যুদ্ধ, বিদ্যাপতির। নীলমাধব উদ্ধার এবং পুরীর মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে ধর্মপ্রাণ হিন্দু অবহিত আছি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, ভারত থেকে “সিল্করুট’ অথবা‘রেশমি-রাস্তা ধরে আফ্রিকা, মধ্য-এশিয়া এমনকী প্রাচীন গ্রিস ও রোমের মাধ্যমে সারা ইউরোপে বিবিধ পণ্য সামগ্রীর আমদানি ও রপ্তানি করা হতো। ভারতের মসলিন, হাতির দাঁত, সোনা, মণিমুক্তা, মশলা ও সুগন্ধীপণ্যের বিশেষ সুখ্যাতি ছিল সারা বিশ্বে।
সমুদ্র পথেই যে প্রাচীন মিশরের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ছিল তা ১৮৮১ সালে কলকাতাস্থিত থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির (আজকের কলেজ স্কোয়ারের পিছনের মহাবোধি সোসাইটি) জার্নালে কর্নেল হেনরি স্টিল ওয়ালকটের বর্ণনা থেকেও জানতে পারি। তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন, প্রাচীন মিশর ছিল যেন ভারতেরই অঙ্গীভূত একটি রাজ্য। মিশরের লোকেরা নিজেদের পূর্বপুরুষদের দেশ হিসাবে ভারতেরই বর্ণনা করেছেন। তাদের আঁকা এবং খোদাই করা শিলাস্তম্ভগুলির চিত্রলিপিতে পাওয়া যায় রাজা ‘প্ৰাহু’ এবং রানি ‘অতি’র নাম। তাদের নিখুঁত বর্ণনাতে আছে সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত বিশাল ভূভাগ এবং তার বিচিত্র প্রাণী এবং উদ্ভিদকুলের অপূর্ব বর্ণনা যা ভারত ছাড়া আর অন্য কোনো দেশের সঙ্গেই মিল খায় না। সমুদ্রের ধারে মসলিন, সুগন্ধি, মশলা, হাতি, ময়ূর, নারকেল গাছের সারি—আর অন্য কোন দেশে পাওয়া যায়?
মুসলমান আক্রমণ ও বহুবার অত্যাচার সহ্য করেও কিন্তু জগন্নাথদেবের বার্ষিক অনুষ্ঠান আজও অব্যাহত আছে। পুরীর রথযাত্রা আর মিশরের ওপেত উৎসবের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। আষাঢ় মাসের (জুলাই মাসের মাঝামাঝি) বর্ষাঋতুতে জগন্নাথের স্নান, অভিষেক, নতুন রথ, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, পাণ্ডা-পুরোহিত আর সারাবিশ্বের লক্ষাধিক ভক্তের সমাপম, ওড়িশার রাজা কর্তৃক সোনার বঁটা দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা, পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে ত্রিমূর্তির স্নান, রথের রশি টানা এবং রানির প্রতিষ্ঠিত ‘গুণ্ডিচা মন্দির, যা কিনা ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, তার সামনে ৪০-৪৫ ফিটের বিশালাকৃতির তিনটি রথের আগমন— ওপেত উৎসবের তিনটি বিশাল নৌকার কথাই মনে করিয়ে দেয়। পুরীর রথযাত্রার সঙ্গে মিশরীয় ওপেত’উৎসবের মতো সাদৃশ্য পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশের কোনো উৎসবের সঙ্গে মিল খায় না।
বিখ্যাত গবেষক ডাঃ এডলফ এরমান লিখেছেন, প্রাচীনকালে, ২০০ বছর ধরে হিস্কস নামক বহিঃশত্রুর অত্যাচার থেকে মিশরবাসীদের রক্ষা করার জন্য মিশরের ধার্মিক দুই রাজা আহমেস ও কামেস, নীলগাত্র বর্ণ বিশিষ্ট, মাথায় সুদীর্ঘ পাখির পালক লাগানো উষ্ণীষধারী দেবতা আমনরার আশীর্বাদে বহিঃশত্রুর পরাজয় নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এযেন শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে পাণ্ডবদের কৌরব বিজয়!
এটা ভাবা কি অলীক হবে যে ভারত থেকেই শত্রু দমনে মিশরের উদ্দেশে সেনাসহ ভারতীয় কোনো রাজা মিশরে গেছিলেন সমুদ্র পথে এবং হয়তো সেই সময়ই শ্রীকৃষ্ণকে মেনে নেওয়া হয়েছিল সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর বলে ?যদি ২৫০০ বছর আগে আলেকজান্ডার স্থলপথে হিন্দুকুশ অতিক্রম করে ভারত আক্রমণ করতে পারেন তবে সমুদ্রপথে ভারতীয় কোনো বীর কেন মিশর পৌঁছাতে পারবেন না? ভারতীয় মশলা আর মসলিন যদি মিশরবাসীর প্রধান আকর্ষণ হতে পারে, তবে প্রাচীন মিশরে, বৈদিক দেব-দেবী অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ, সূভদ্রা আর বলরামের পূজা-অর্চনা হতে বাধা কোথায় ? যদি সোনা, রুপা ও ও হাতির দাঁত পৌঁছাতে পারে তবে সেনাসহ ভারতীয় রাজারা সমুদ্রপথে মিশরে যেতে পারবেন না কেন?
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রাচীন মিশরের লোকরা নিজেরাই বলত, তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে এসেছে যার নাম ছিল পোয়ানিত বা যার অপভ্রংশ হচ্ছে ‘পুন্ত’ বা ‘পুণ্যভূমি। ডাঃ এরমান লিখছেন, যা ছিল দেবতাদের বা পূর্বজদের বাসভূমি। লোহিত সাগর পেরিয়ে, সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সমুদ্র ঘেরা বিশাল এক ভূভাগ, যেখানে আছে, দুই দাঁতওয়ালা হাতি, চিতা, বাঘ, লম্বা-লেজ বিশিষ্ট বানর, লম্বা-লেজওয়ালা বড়ো মাপের পাখি, নারকেল গাছের সারি, বিচিত্র সুগন্ধিযুক্ত গাছ এবং বহুমূল্য মণি-রত্নের সম্ভার। ‘দার-এল-বাবুরি’তে অবস্থিত রানি হাতসেপসুত’-এর মন্দিরের শিলাহস্তে খোদাই করা চিত্রলিপিগুলিতে লেখা আছে এই সেই পুণ্যভূমির কথা।
ওড়িশার রানি গুণ্ডিচার নীলমাধব, রাজস্থানের মেবার নিবাসী রানি মীরাবাঈয়ের নীলাম্বরধর গিরিধারী নাগর আর মিশরের রানি হাতসে্যুতের নীলবরণ আমরা সকলের মাথার উষ্ণীষে কিন্তু আছে। ময়ূরের দুটি পালক বা শিখী-গুচ্ছ। মিশরের পাশেই আছে ইথিওপিয়া। ভারতীয়রা নাকি ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে, সেখানেই তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। তারা এসেছিলেন সিন্ধু নদীর দেশ থেকে। একথার প্রমাণ পাওয়া যায় এউসেবিয়াস ও ফিলোস্ট্রটাসের নথি থেকে। তাছাড়া অধুনা লুপ্ত সপ্তম শতাব্দীর সেন্ট ইন্সিডোরের লেখা, এনসাইক্লোপিডিয়া অব নলেজে স্বীকার করেছেন, পুরাকালে ভারতীয়রা সিন্ধু নদীর পার থেকে এসেছিল মিশরে। তারা লোহিত সাগর ও নীলনদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
একথার পুষ্টি সাধিত হয়েছে তার পরবর্তী লেখক ও বিশিষ্ট প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা বিষয়ক গবেষক, আর্নল্ড আরমাল লাডউইগ হিরেনের বিশ্লেষণে। তার কাথায়, “সিন্ধু নদীর তীরবর্তী ভারতীয় বৈশ্যরা আফ্রিকা ও মিশরে বাণিজ্য করতে এসেছিল এবং উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। হিন্দু রীতিনীতি ও ধার্মিক প্রথার প্রচলনও করেছিল। প্রাচীন মিশরের উপর, লোরনা ওক এবং লুসিয়া গাহালিনের লেখা বই, ‘এনসেন্ট ইজিপ্ট’ বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। এটা কোনো কল্পকাহিনি নয়। উপরিউক্ত বিশ্লেষণ থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, পুরাকালে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব তিন বা চার হাজার বছর সময়কালে, ইহুদি, খ্রিস্টধর্ম বা ইসলামের জন্ম হয়নি, সেই সময় সম্ভবত ভারত উপমহাদেশ থেকেই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল সভ্যতা আর সংস্কৃতির ঐতিহ্যময় গৈরিক পতাকা। এটা কোনো অনুমান ভিত্তিক রচনা নয়, বরং নৃতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক শিলালিপি এবং নথিপত্রের পর্যালোচনা করে সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে ভারত থেকেই শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি মিশর প্রদেশে এসেছিল যা পরবর্তী সময়ে ‘আমনরা’র মূর্তিতে পূর্ণতা পেয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ দাস
(লেখক বিশিষ্ট চিকিৎসক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.