ভারতীয় মুসলমান মহিলাদের নবজাগরণের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন মোদী

নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে ৬৮তম স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীর উদ্দেশে লালকেল্লায়। দাঁড়িয়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছিল যে তিনি শুধু তিন দশক পরে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসা একজন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি এই বহুধাবিভক্ত ১৩০ কোটি মানুষের সত্যিকারের অবিভাবক। তিনি রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে সমাজের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দিতে যেমন বদ্ধপরিকর, তেমনি স্বাধীনতার পর থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে তোষণ ও ভোটব্যাঙ্ক নির্ভর রাজনীতির ফলে যে সামাজিক বিকৃতি এদেশের মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে তারা সমূলে উৎপাটন করতেও তিনি বদ্ধপরিকর। তিন তালাক এই রকমই একটি সামাজিক বিকৃতি যাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৯৮৬ সালে। সংসদীয় গণতন্ত্রে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বিগত ১৯ মাসে তৃতীয় প্রচেষ্টায় অবশেষে সংসদের উচ্চতর কক্ষে কিছু রাজনৈতিক দলের শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার সৌজন্যে কংগ্রেসের করা আরও একটি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। তবে এক্ষেত্রেও তোষণবাদী দলগুলি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। বিলটিকে রোখার। তবে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই ৩০ জুলাই দিনটি ভারতীয় মহিলাদের ক্ষমতায়ণের ইতিহাসে এক বিশেষ দিন হিসেবে লেখা থাকবে যেদিন তিন তালাক নামক এইমধ্যযুগীয়, আমানবিক, বর্বরোচিত প্রথার হাত থেকে এই দেশের অগণিত মুসলমান মহিলাদেরমুক্তির পথ খুলে দেওয়া হলো। তবে টিভির পর্দায় যারা রাজ্যসভা এবং লোকসভায় এই বিলটির উপর আলোচনা দেখেছেন তারা আরও একবার অনুধাবন করতে পেরেছেন যে নির্লজ্জ তুষ্টিকরণ এই দেশের রাজনীতির মজ্জাগত হয়ে গেছে। এই ভোটব্যাঙ্ক নির্ভর রাজনীতি যা ক্রমেই সংবিধান, সমাজ, এমনকী মানবিকতার বুনিয়াদটুকুকেও গ্রাস করে নিয়েছে, তাকে রোখা না গেলে এক ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে আমরা দ্রুত এগিয়ে যাব। তোষণ নামক এই বিকৃতিটি ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটু একটু করে সংযুক্ত হতে হতে আজ বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ফেলেছে। আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে একটা সুস্পষ্ট প্রমাণ আমরা পাবো যেখানে একটি ধর্মীয় আগ্রাসনকে খুব সুচতুর ভাবে রাজনীতির মোড়কে এই ভূখণ্ডে বিকশিত হবার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রাক্কালে উত্তরপ্রদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের তামাম হিন্দু সিপাহীরা মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নিজেদের সম্রাট ঘোষণা করে ইউরোপীয় শাসকের গুলির সামনে বুক চিতিয়েদাঁড়িয়েছিল। যেখানে তারা নিজেদের ধর্মীয় সত্তার উর্ধ্বে উঠে ভারতমাতার সন্তান হিসেবে বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এই উদারতা এই দেশপ্রেমের বিনিময়ে হিন্দুরা কী পেল?
মহাবিদ্রোহের পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হওয়ার আগেই ধর্মের ভিত্তিতে আস্ত একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হলো। তারপর প্রথমে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং ধীরে ধীরে দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে এই ভূভাগ খণ্ডিত হলো এবং ইংরেজদের এই উপমহাদেশকে লুণ্ঠন করার কাজে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করা হলো। আর এই সবই হলো কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায়। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস লখনৌ অধিবেশনে মুসলিম লিগের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীকে স্বীকৃতি যদি না দিত তাহলে এই দেশের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। ধর্মীয় তুষ্টিকরণের যে অঙ্কুরোদ্গম ১৯১৬ সালে হয়েছিল তাই আজ বিরাট বিষবৃক্ষ হয়ে এই দেশের সমাজ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, এই তুষ্টিকরণের হাত থেকে সংবিধানও রক্ষা পায়নি। ভারতের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতি সমূহের উল্লেখ আছে। যেখানে এক একটি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রকে কী করে কল্যাণকর ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় তার দিক নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। যেমন অনুচ্ছেদ চল্লিশে গ্রাম পঞ্চায়েত গঠনের কথা বলা হয়েছে, অনুচ্ছেদ ছেচল্লিশে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের উন্নতি সাধনের কথা বলা হয়েছে, অনুচ্ছেদ ঊনপঞ্চাশে দেশের প্রাচীন স্থাপত্য সমূহের সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের এই ভাগে মোট সতেরোটি অনুচ্ছেদে এইরকম বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতিনির্দেশের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্দেশগুলিকে রূপায়ণের কিছু কিছু প্রচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দুটি অনুচ্ছেদকে কখনোই গুরুত্ব দেবার চেষ্টা হয়নি। একটি অনুচ্ছেদ নং ৪৪ যেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলনের কথা বলা হয়েছে। আর অনুচ্ছেদ নং ৪৮ যেখানে গোরক্ষার কথা বলা হয়েছে। যে সংবিধান সভার অধিকাংশ সদস্য কংগ্রেসের, সেই সংবিধান সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের উপর প্রতিষ্ঠিত এই সাংবিধানিক নির্দেশগুলিকে স্বাধীন ভারতে সুদীর্ঘ শাসনকালে কংগ্রেস শুধুমাত্র উপেক্ষাই করেনি, এগুলি যাতে বাস্তবায়িত না হয় তার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাই তিন তালাক নিয়ে কংগ্রেস তথা কংগ্রেসের উপজাত আঞ্চলিক দলগুলি যে এর বিরোধিতা করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এই তুষ্টিকরণ আর ধর্মীয় আগ্রাসনের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে দেশবাসীকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
সোমনাথ গোস্বামী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.