মিশ্র আর্থ-সামাজিক গঠনের মধ্যে রাসবিহারীতে বিজেপির অবস্থান ঠিক কোথায়? কী ভাবে তাদের উত্তরণ? এলাকাবাসীর কেনই বা ক্ষোভ বর্তমান রাজ্য শাসকদলের উপর?

মিশ্র আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রের ত্রিনয়নের একটি যদি হয় কালীঘাট মন্দির, তবে বাকি দু’টি নয়নের একটি হল অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা আদিগঙ্গার ধারের বসতি, গোপালনগর বস্তি, দুর্গাপুর ও সাহাপুরের মতো কয়েকটি কলোনি, মসজিদপাড়া প্রভৃতি। অন্যটি হল যোধপুর পার্ক, গড়িয়াহাট, হিন্দুস্থান পার্ক, সিংহী পার্কের মতো বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। এই মিশ্র আর্থ-সামাজিক গঠনের মধ্যে বিজেপির অবস্থান ঠিক কোথায়? কী ভাবে তাদের ওই উত্তরণ? উত্তরণ তো বটেই। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে এই বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি গত লোকসভায় এগিয়ে ছিল ৫৪২১ ভোটে।

আর সেই সাফল্যকেই পাখির চোখ করে বিজেপি এমন এক জনকে এ বার এখানে প্রার্থী করেছে, যিনি ধারে-ভারে তাদের তালিকায় তারকা।বিজেপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব যাঁদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, তাঁদের এক জন এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা। সুতরাং, রাসবিহারী কেন্দ্র বিজেপির কাছে মর্যাদার লড়াই। অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য সুব্রতবাবুর জন্ম কলকাতায়। পড়াশোনাপুরুলিয়ার সৈনিক স্কুল ও কলকাতার সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজে। চাকরি সূত্রে রাজ্যের বাইরে থাকা সুব্রতবাবু শুধু ৮২-৮৫, এই তিন বছর ছিলেন ডুয়ার্সের বিনাগুড়িতে। এর বাইরে নিজভূমের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে শুধুই বেড়াতে আসা। সেই অর্থে এই কেন্দ্র কেন, আশপাশেও তেমন পরিচিতি নেই তাঁর। এ সব নিয়ে আদৌ কি চিন্তিত প্রার্থী? তা জানতে বহু চেষ্টা করেও প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মেলেনি। তবে স্থানীয় বিজেপি নেতার আত্মবিশ্বাস, “এই সব কোনও সমস্যাই নয়। গত কয়েক বছরে এই কেন্দ্রে গজিয়ে ওঠা আবাসনের ভোট এ বারেও আমাদেরই থাকবে। এ ছাড়াও বস্তি বা মধ্যবিত্ত এলাকা থেকেও ভোট আসবে।’’ বিজেপির দক্ষিণ কলকাতা জেলার সাধারণ সম্পাদিকা শশী অগ্নিহোত্রী বলেন, “মোদীজীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠন হোক, মানুষ সেটা চেয়েছিলেন। তার প্রতিফলন ছিল ওই ফল। এ বার ওই ব্যবধান আরওবেড়ে জয় আসবে। কারণ, সিন্ডিকেট রাজ, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সব স্তরের মানুষ বিরক্ত। কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের তোষণ না করে উন্নয়নে সবার সমান অধিকার, এই বার্তাই আমাদের জয় আনবে।”

দীর্ঘদিনের তৃণমূলের ঘাঁটি এই কেন্দ্র ঘুরলে বোঝ যায় কিছু এলাকায় পরিষেবা সেই অর্থে না পৌঁছনো নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। যেমন, গোবিন্দপুর বস্তির বাসিন্দা তারক সরকার বলছিলেন, “এখানের অনেকটা অংশে পরিশোধিত জলই পৌঁছয়নি।” রয়েছে টিপু সুলতানের স্মৃতি বিস্মৃত মসজিদপাড়া। ওয়াকফ বোর্ডের জমিতে অতি ঘিঞ্জি বস্তি এলাকায় এত বছরেও কোনও নিকাশি ব্যবস্থা না থাকাই বাসিন্দাদের বড় মাথাব্যথা। সঙ্গে রয়েছে বিরোধীদের ছোট্ট খোঁচা। “স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ শোভনদেববাবু। কিন্তু দেবাশিসবাবুর প্রভূত সম্পত্তির উৎস কী, এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়”— দাবি বিরোধীদের।

যা শুনে তৃণমূল প্রার্থী দেবাশীষ বাবুর বক্তব্য, “পরিষেবা যেটুকু বাকি আছে, জিতে তা দেওয়ার চেষ্টা করব। মসজিদপাড়ার সমস্যার কথা জানি। ওয়াকফ বোর্ডের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হবে। ওই জমিতে পুরসভা একা কিছু করতে পারবে না।” পাশাপাশি তাঁর উত্তর, “আমি ব্যবসায়ী। সম্পত্তি তো থাকবেই। এ বছর ৪২ লক্ষ টাকা আয়কর দিয়েছি। আমার কী কী আছে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েওছি।”

মসজিদপাড়ার কবরের উপরেই তৈরি এক ফালি ঘরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ রাজেশ সাউ বলেন, “কত ভরসা ভাঙতে দেখলাম গত ষাট বছরে। কিন্তু আমাদের ভরসার কি গুরুত্ব দেওয়া হয়? না হলে ফি সপ্তাহে এলাকায় আচমকা ঢুকে পড়া নোংরা জলে কী করে জীবন বয়ে যায়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.