রবীন্দ্রনাথের পর এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য উদ্ধত নােবেলের

ভারতের টেলিভিশন চ্যানেল জি বাংলার সারেগাপা খ্যাত মাইনুল আহসান নােবেল গত বছর অনুষ্ঠানের গ্রান্ড ফিনালের আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার কথা বলেছিলেন। নােবেলের প্রকাশ্য যুক্তি ছিল রবীন্দ্রনাথ ভারতের নাগরিক এবং রবীন্দ্রনাথের চাইতেও অনেক ভালাে গান বাংলাদেশের কবি- গীতিকাররা লিখেছেন। বাংলাদেশি কারও গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলে ভালাে হতাে।

নােবেল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। তিনি সম্ভবত ইতিহাসটা জানেন না। বাহান্নর। ভাষা আন্দোলনের পথ পেরিয়ে ষাটের দশকে স্বাধিকার আন্দোলন যখন তুঙ্গে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্রনাথের এই গানটি সামনে নিয়ে আসেন। গােটা পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব অন্তত ১৮ বার কারাবরণ করেন। কারাগারে যাওয়ার সময় প্রত্যেকবারই তার সঙ্গী হতাে সঞ্চয়িতা। আটষট্টি সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হন এবং সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে বিচার শুরু হয়। মামলার অভিযােগে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিব পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গােপনে আগরতলাগিয়ে ভারত সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ঊনসত্তর সালে তীব্র গণআন্দোলনে সারাদেশ অচল হয়ে গেলে সামরিক শাসকরা মামলা তুলে নিয়ে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সেই আন্দোলনের মুখে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইউব খানকে পদত্যাগ করতে হয়। পাকিস্তানের মঞ্চে আসেন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। শেখ মুজিব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কারাগার গেটে সমবেত হাজার হাজার জনতাকে হাত তুলে অভিনন্দন জানিয়ে গেয়ে ওঠেন, “আমার সােনার বাংলা…’। সেদিনই নিশ্চিত হয়ে যায় দেশ স্বাধীন হলে নতুন দেশের জাতীয় সংগীত কী হবে।

তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং গণমাধ্যমে বলা। হয়েছিল, নােবেলের এই মন্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক মনােভাবপ্রসূত নােবেল জানেন না, পাকিস্তানে ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি বলে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে রবীন্দ্রনাথের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের সামরিক সরকার। নােবেলের কণ্ঠে এখন পাকিস্তানি শাসকদের কথা শােনা যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জি বাংলা কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি গহিত মনে হয়নি। কলকাতায়ও কোনাে প্রতিবাদ হয়নি। নােবেলের যাত্রা অব্যাহত থাকে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে পার পেয়ে যাওয়ায় নােবেলের সাহস। বেড়ে যায়। এবার মন্তব্য করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর বিরুদ্ধে। এর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ত্রিপুরায়। এখন ভারতে যাওয়ামাত্রই গ্রেপ্তার হবেন। মামলা হওয়ার পর থেকে তাকে খুঁজছে ত্রিপুরার পুলিশ। ২৫ মে ত্রিপুরার বিলােনিয়া থানায় নােবেলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কয়েকটি সূত্র নােবেলের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এদিকে ঢাকায়। মামলার বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানিয়েছেন নােবেলও। বুধবার রাতে নােবেল বলেন, মামলা হয়েছে, শুনেছি। আমি আপাতত নতুন গানের মিউজিক ভিডিয়াের শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। পরে এটা নিয়ে ভাবব।

আগরতলা থেকে খবর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীকে নিয়ে ফেসবুকে নেতিবাচক মন্তব্য করায় নােবেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ত্রিপুরার বিলােনিয়ার সুমন পাল। স্থানীয় বিলােনিয়া থানায় নােবেলের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারা এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাটি করা হয়েছে। জানা গেছে, নােবেলের বিরুদ্ধে করা অভিযােগের একটি করে প্রতিলিপি পাঠানাে হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কাছে। সেই অভিযােগের ভিত্তিতেই ভারতে ঢােকামাত্রই গ্রেপ্তার হবেন নােবেল। তাকে ত্রিপুরা পুলিশ খুঁজছে।

যােগাযােগ করা হলে আগরতলা থেকে সহকারী হাইকমিশনার কিরীটি চাকমা বলেন, মামলার বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। এখানকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নােবেলের মামলার খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, সুমন পাল অভিযােগপত্রে তার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর বিরুদ্ধে মন্দ মন্তব্য করায় নােবেলের ভারতের ভিসা বাতিল এবং তার পাসপাের্ট বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন। সুমন পাল সংবাদমাধ্যমে জানান, একজন ভারতীয় হিসেবে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন কুৎসাপূর্ণ মন্তব্য মেনে নিতে পারেননি, তাই নােবেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এ ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার জন্য নােবেলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

জি বাংলার খ্যাতির কারণে প্রচণ্ড অহংকারে স্ফীত নােবেল গত বছর এও বলেছিলেন, বাংলাদেশে তার কাজ করার মতাে কোনাে সংগীত পরিচালক নেই। এমনকী তার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান গাওয়ার যােগ্যতা দেশের কোনাে নারীশিল্পী রাখেন না। ভারতের জি বাংলার সারেগামাপা অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর নােবেল ঘােষণা দিয়েছিলেন, তিনি ‘সুনন্দ’শিরােনামে একটি গান প্রকাশ করবেন। সেটির খবর না দিতে পারলেও ‘তামাশা’ প্রচারণা করতে গিয়ে সমালােচনার শিকার হন নােবেল। গানের প্রচারের কৌশল হিসেবে দেশের সংগীতের কিংবদন্তিদের নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করে ১৯ মে বিতর্কে জড়ান। নিজের ফেসবুক পেজে নােবেল বলেছেন, লিজেন্ডদের আমি শেখাব কীভাবে ২০২০ সালে মিউজিক করতে হয়। ভারতের জি বাংলার কারণে পরিচিতি পাওয়ার পর বিতর্কের জন্ম দেওয়া নােবেলের এ ধরনের কথা শুনে দেশের সংগীতাঙ্গনের অনেকেই অবাক ও বিস্মিত হয়েছেন। অনেকে এটাকে প্রলাপও বলছেন। হঠাৎ করে কোনাে কারণ ছাড়াই নােবেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে শুরুতে কেউ বিশ্বাস করতে চাননি। ভেবেছিলেন, হয়তাে ফেসবুক পেজ হ্যাক করে কেউ লিখে দিয়েছেন।তাইপিজেন্ডদের নিয়ে এভাবে লিখেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, যিনি দেশের জাতীয় সংগীত বদল করার কথা বলতে পারেন, তার পক্ষে দেশের কিংবদন্তিদের নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলাটা কোনাে বিষয়ই নয়। পােস্ট দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ফেসবুক লাইভে আসেন নােবেল। তখন সবাই নিশ্চিত হয়ে যান, জেনে-বুঝে পােস্টটি দিয়েছেন। লাইভে তিনি বলেছেন, ‘অ্যা ভাই, কী শুনলাম আমি। পেজ নাকি হ্যাক হয়েছে। কই পেজ তাে হ্যাক হয়নি। আমি তাে নােবেল। দেখেন রক্ত-মাংসের নােবেল। গাল টানলে গাল বাড়ে, নাক ধরা যায়। আমি নােবেল। সাে নাে প্রবলেম।

এদিকে গান নিয়ে সমালােচনার রেশ কাটতে না কাটতে ইদের পরই সাত মাস আগে সেরে নেওয়া বিয়ের খবরটি প্রকাশ্যে চলে আসে। ফেসবুক-সহ নানা মাধ্যমে এটি নােবেলের তৃতীয় বিয়ে হিসেবে চাউর হতে থাকে। সংবাদমাধ্যমের কাছে নােবেল দাবি করেছেন, তৃতীয় বিয়ের ব্যাপারটি পুরােটাই মিথ্যা। ২৬ মে তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে এর আগে কোনাে মেয়ের বিয়ে হয়নি। তবে আমার সঙ্গে অনেক মেয়ের সম্পর্ক ছিল। এত মেয়ের সম্পর্ক ছিল যে গুনে শেষ করা যাবে না। এ অবস্থায় এখন যদি বলা হয়। এটি আমার তৃতীয় বিয়ে, এটি ঠিক না। তৃতীয় বিয়ের খবরটি গুজব, বিভ্রান্তিকর।

গােপালগঞ্জের ছেলে নােবেল বড়াে হয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। লেখাপড়া করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতে। গান নিয়ে মেতে ওঠেন কলকাতায় থাকতেই। মাত্র ৬০০ টাকায় পুরােনাে সিগনেচার ব্যান্ডের গিটার কিনে তা দিয়েই শুরু করেন সংগীতচর্চা। কলকাতায় মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশােনা শেষ করে ২০১৪ সালে ঢাকায় ফেরেন নােবেল। এভাবে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা করতে করতে জি বাংলায় স্থান করে নেন এবং ঔদ্ধত্যের শিখরে পৌঁছে যান।

বাসুদেব ধর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.