ভারত চীন সীমান্তে সাম্প্রতিক উত্তেজনা প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

গােটা পৃথিবীই এখন কোভিড-১৯ অতি মহামারীতে আক্রান্ত। সমস্ত পৃথিবীই লড়াই করে চলেছে ভয়ংকর করােনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যার সৃষ্টি চীনের উহানে, যে কারণে পশ্চিমে এই ভাইরাসকে উহান করােনা ভাইরাস নামেই অভিহিত করা হচ্ছে। চীনের অস্বস্তি হলেও এটাই বাস্তব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতি এমন মারাত্মক সংকটের মুখােমুখী হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অর্থনীতি এবং সমাজ গুরত্তর চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি এবং জাতি-রাষ্ট্রগুলি চেষ্টা করছে এই সংকটের হাত থেকে তাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে রক্ষা করতে। সামাজিক কাঠামাের প্রচলিত রপগুলি ভেঙে যাচ্ছে, অর্থনীতির যে ব্যবস্থাগুলাে বহুদিন ধরে গড়ে উঠেছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। রাষ্ট্রগুলিকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়কে নতুন চোখে দেখতে হচ্ছে। ঠাণ্ডাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যে বিশ্বব্যবস্থা ধীরে ধীরে সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছিল (যদিও তা একেবারেই স্থায়ী রূপ ছিল না। বরং তার মধ্যেও ক্রমাগত অদল-বদল চলছিল) তা প্রায় শেষ হতে চলেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার প্রকৃত রূপটি কী দাঁড়াবে তা এখনাে অনুমানের বিষয়। সমস্ত রাষ্ট্রই কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাব্য রদপ ও চরিত্রটিকে নিয়ে চিন্তিত এবং কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত সে নিয়েও নিজেদের মতাে করে চিন্তাভাবনা করছে।

কিন্তু একটি দেশকে এই সবকিছু থেকে বাইরে রাখা যায়। সেই দেশটি হলাে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। গােটা পৃথিবীকে করােনা ভাইরাস ‘উপহার’ দেওয়ার পরও চীন এবং সেই দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামাে কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সবকিছু যেন একেবারে স্বাভাবিক, ঠিক আগের মতােই। কোভিড-১৯ পরবর্তী যুগে নিজেকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে মশগুল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং সেই কমিউনিস্ট পার্টি মনােনীত চীনা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব। গােটা দুনিয়ায় নভেল করােনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার কারণ (যা চীন দেশেই নিহিত) অনুসন্ধানের বদলে চীন এখন সম্ভাব্য ঠাণ্ডা লড়াই এবং সেই লড়াইয়ে চীনের কৌশলগত অবস্থান তৈরিতে ব্যস্ত। সম্প্রতি চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই মন্তব্য করেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শক্তি চীন-মার্কিন সম্পর্ককে প্রায় পণবন্দি করে ফেলেছে এবং দুটি দেশ এক নয়া ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।”তার কথায় যে প্রচ্ছন্ন বার্তাটি আছে তা হলাে যদি সত্যিই পৃথিবীতে আবার ঠাণ্ডাযুদ্ধ বেধে যায়। তবে চীন সেই অনুযায়ী তার প্রতিরক্ষা এবং ভূ-কৌশলগত নীতি নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ চীন মনে করছে আগামী দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ঠাণ্ডা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতােশক্তি তার আছে এবং এই উদ্দেশ্যে এখন থেকেই এশিয়ার অন্যান্য শক্তিকে বিশেষত ভারতকে এক বার্তা দেওয়া প্রয়ােজন যাতে সম্ভাব্য ঠাণ্ডাযুদ্ধ কিংবা কোভিড-১৯ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযােগী দেশগুলি যদি চীনের ওপর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে ভারত যেন প্রত্যক্ষভাবে সেই উদ্যোগে শামিল না হয়। গত মে মাসে সিকিম সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং চীনের সেনাবাহিনী পিপল্স লিবারেশন আর্মির মধ্যে হাতাহাতি লড়াইয়ের পর আকসাই চীন অঞ্চলেও চীন এবং ভারতের সৈন্য মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতি অনেকটা ২০১৭ সালের ডােকলাম দ্বন্দ্বের মতাে। ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারত, চীন ও ভুটানের সীমানার মিলনস্থল ডােকলাম অঞ্চলে চীন এবং ভারতের সেনাবাহিনী পরস্পরের মুখােমুখী দাঁড়িয়ে ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তা কোনাে সংঘর্ষের রূপ নেয়নি। আকসাই চীন অঞ্চলে ভারত ও চীনের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে তা প্রত্যক্ষ সীমান্ত সংঘর্ষে পরিণত হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব প্রলম্বিত হতে পারে। গত মে মাসের ১৪ তারিখ ভারতীয় স্থলবাহিনীর অধ্যক্ষ মনােজ নারাভানে বলেছেন মে মাসের ৫ তারিখে লাদাখের প্যাংগং লেক অঞ্চলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপর অন্তত চারটি অঞ্চলে এবং ৯ মে সিকিমের নাকুলা অঞ্চলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি এবং ডেমচক অঞ্চলে চীন তার বাহিনীকে এমনভাবে পরিচালনা করছে তাতে ভারতকেও পালটা ব্যবস্থা হিসেবে সৈন্য সমাবেশ এবং অস্ত্র মজুত করতে হয়েছে। চীন তার পুরােনাে অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

আসলে চীন-ভারত সীমান্তে সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে কেবল ছােটোখাটো উত্তেজনা বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। দুটি সার্বভৌম দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এমন বিভিন্ন দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ছােটোখাটো দ্বন্দ্বও নতুন কিছু নয়। এগুলাে প্রায়শই ঘটে এবং উচ্চতর কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে তামিটেও যায়।কিন্তু ভারত-চীন সীমান্তে সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে ছােটোখাটো সীমান্ত দ্বন্দ্বের । পর্যায়ে ফেলা অসম্ভব। বরং ১৯৪৯ সালে একটি কমিউনিস্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওার পর চীন তার প্রতিরক্ষা ও ভূ-কৌশলগত নীতিতে নিজেদের সীমানা এবং প্রভাবের। ক্ষেত্র সম্প্রসারণের যে লাগাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেই ধারবাহিক প্রক্রিয়ারই অংশ হলাে বর্তমান ঘটনা। ২০১৬ সালে জুলাই মাসে হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের একচেটিয়া অধিকারের দাবি খারিজ করে দিলেও চীন সেই অঞ্চলের ওপর তার দাবি থেকে সরে আসেনি, বরং সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে তার আগ্রাসী কার্যকলাপ অনেকটাই বেড়েছে। চীন কখনাে তার প্রতিরক্ষা ও ভূ-কৌশলগত নীতিতেশক্তি প্রয়ােগকে বাদ দিয়ে চলেনি। বরং যখনই তার মনে হয়েছে শক্তি প্রয়ােগ করার প্রয়ােজন আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তােয়াক্কা না করে চীন সেটাই করেছে। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে চীন তিব্বতের ওপর হামলা চালায় এবং গােটা তিব্বত দখল করে নেয়। ১৯৬২ সালে পঞ্চশীল নীতি ভঙ্গ করে চীন ভারতের লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের ওপর আক্রমণ চালায় এবং আকসাই চীন অঞ্চল যা পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর এবং বর্তমান লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার ৩৭৪৪ বর্গকিলােমিটার এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৭৯ সালে ফেব্রুয়ারি মার্চে চীন ভিয়েতনামের ওপর হামলা চালায়। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে চীনা সেনা চাইনিজ পিপলস্ ভলেন্টিয়ার আর্মির নামে কোরিয়া যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল। ১৯৭৯ সালের পর কোনাে বড়াে সংঘর্ষে নিজেকে না জড়ালেও যুদ্ধের হুমকি, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি চীনের প্রতিরক্ষা ও বিদেশনীতির এক অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য থেকে গেছে। চীন তার নিজের ব্যাখ্যা করা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে শক্তি প্রয়ােগ করতে পিছুপা হয় না।শক্তি প্রয়ােগের হুমকি প্রায় সব সময়েই থাকে চীনের নীতিতে। উহান করােনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট দেখা দিলেও (বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এর জন্য চীনের দিকেই আঙুল তুলছে) চীন কেবল দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলেই নয়, তার বাইরেও শক্তিপ্রদর্শন চালিয়ে যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী সব দেশের আপত্তি উপেক্ষা করে চীন দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলের স্পার্টলি ও প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জকে তার প্রশাসনিক ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘােষণা করেছে। ভিয়েতনাম বা ফিলিপিনস কূটনৈতিক উপায়ে চীনের কার্যকলাপকে চ্যালেঞ্জ করলেও চীন তাকে গুরুত্ব দেয়নি। কোভিড-১৯ হােক বা না হােক চীনের দীর্ঘময়াদি কৌশলগত লক্ষ্য হলাে চীন সাগর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিজের পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই অঞ্চলের সমস্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপগুলির ওপর ধীরে ধীরে থাবা বসিয়ে চীন তার সামরিক অবস্থানকে মজবুত করার দিকে এগােচ্ছে।

তবে শুধু দক্ষিণ চীন সাগর নয়, চীনের আগ্রাসী সামরিক কার্যকলাপে তাইওয়ান, জাপান, এমনকী দক্ষিণ কোরিয়াও চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হয়েছে। চীনের একটি এয়ার ব্রাস্ট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ তাইওয়ান ও জাপানের কাছ দিয়েই মহড়া চালিয়েছে। তাইওয়ানের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ অভিযােগ করেছে, চীন দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে একটি এয়ার ডিফেন্স আইডেনটিফিকেশন জোন স্থাপন করতে চাইছে। এ বছর এখনাে পর্যন্ত ছ’বার চীনের যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের খুব কাছ দিয়ে যাতায়াত করেছে। ফলে তাইওয়ানের নিরাপত্তার পক্ষে এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ চীন তাওয়ানকে স্বাধীন দেশ বলে মানে না। তাইওয়ানের ‘রেনিগেড প্রভিন্স’ আখ্যা দিয়ে তাকে মূল চীনের অঙ্গীভূত করাকে (প্রয়ােজনে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করে) চীন তার জাতীয় কর্তব্য বলে মনে করে। এ বছর মার্চ মাসে ওয়াইনাইন সাবভিল্যান্স এয়ারব্রাস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার এয়ার ডিফেন্স আইডেনটিফিকেশন জোনকে একাধিকবার লঙ্ঘন করার কারণে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের ফাইটার জেটগুলিকে চরম সতর্কতামূলক অবস্থানে প্রস্তুত রাখতে বাধ্য হয়েছিল।

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টরগুলােতে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনের কার্যকলাপ দেখে বােঝা যাচ্ছে যে, এই অঞ্চলে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি জিইয়ে রাখাকে এক সামরিক কৌশলগত নীতি হিসেবেই গ্রহণ করেছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলাে চীন সম্পর্কে কখনােই দৃঢ় নীতি গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৫০ সালে চীন তার সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে তিব্বত দখল করে নেয়। ভারতের তৎকালীন সরকার অদ্ভুতভাবে তা মেনে নেয়। চীনের তিব্বত দখল যে সামরিক-কৌশলগত দিক দিয়ে ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল নেহরু তা বুঝতে চাননি। ১৯৫০ সালে ভারতের সামনে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার সুযােগ থাকলেও নেহরু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার অজুহাতে তা গ্রহণ করতে চাননি। কমিউনিস্ট চীনের উত্থান এবং তার আগ্রাসী মনােভাবে আশঙ্কিত আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমি দেশগুলি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতকেই চাইছিল। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ কেবল এদেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে সুউচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতাে না, এ দেশকে গােটা এশিয়ার সামরিক ও ভূ-কৌশলগত ক্ষেত্রে এক অনন্যস্থানে অধিষ্ঠিত করতাে। কিছু জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির নেতা হওয়ার স্বপ্নে মশগুল নেহর কাছে। এদেশের জাতীয় স্বার্থ কখনােই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ১৯৫৪ সালে ভারত ও চীন পঞ্চশীল নীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। পঞ্চশীলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল পরস্পরের ভূখণ্ডগত ঐক্য, সংহতি ও সার্বভৌমিতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। কিন্তু এর ঠিক আট বছর পরেই ১৯৬২ সালে চীন পঞ্চশীল নীতির উল্লঙ্ঘন করে জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ এলাকা এবং অরুণাচল প্রদেশের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় প্রস্তুতিহীন ভারতকে দেখতে হয়েছিল এদেশের ৩৭২৪৪ বর্গকিলােমিটার এলাকা বিশিষ্ট আকসাই চীন চীনের দখলে চলে গেল। ১৯৬৩ সালে চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় ৫০০০ বর্গকিলােমিটার এলাকা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে চীনকে দান করে দেয়। আকসাই চীন এলাকা ভারতের হাতছাড়া হওয়ার পর প্রবল সমালােচনায় বিদ্ধ নেহরু বলেছিলেন, ‘আকসাই চীনে একটা ঘাসও জন্মায় না। অথচ সামরিক কৌশলগত বিষয় নিয়ে সামান্য জ্ঞান আছে এমন যে কোনাে মানুষই বলবে যে আকসাই চীনের দখল চীনকে কৌশলগতভাবে কতখানি এগিয়ে রেখেছে।

চীন মনে করে এশীয় মহাদেশে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা ভারত। ফলে মুখে বন্ধুত্বের কথা বললেও চীনের নীতি হলাে ভারতে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলা। যে দেশের সঙ্গে ভারতের শত্রুতা, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় করে ভারতকে চাপে রাখা (যেমন পাকিস্তান)। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে ভারত-বিরােধী মনােভাব তৈরি করা যেমন বার্মা (মিয়ানমার), শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ। প্রতিবেশী দেশগুলির কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলােতে সামরিক বা বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালিয়ে ভারতকে চাপে রাখা (যেমন বার্মার কোকো দ্বীপে চীনের উপস্থিতি শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরে চীনের কার্যকলাপ)। এই সবই করা হয় এই লক্ষ্যে যাতে ভারত আঞ্চলিক রাজনীতিতেই আটকে যায়, একটি এশীয় বা বিশ্বশক্তি হিসেবে তার উত্থান না ঘটে।

বাৰ্টিল লিনটার তার বই ‘চায়নাজ ইন্ডিয়া ওয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন যে ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে চীন যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। কারণ চীনের অভ্যন্তরে গ্রেট লিপ ফরােয়ার্ড কর্মসূচি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। সেখান থেকে দৃষ্টি সরাতেই ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণ করে চীন। ২০২০ সালে উহান। করােনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ চীনের বিশ্বাসযােগ্যতার ওপর বড়াে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে। কোভিড-উত্তর বিশ্ব ব্যবস্থায় চীন থেকে বিভিন্ন দেশ যদি তাদের বিনিয়ােগ সরিয়ে আনতে থাকে তবে চীনের উন্নয়ন মডেল একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বে বিভিন্ন দেশ বিশেষত উন্নত দেশগুলি বিশ্বব্যাপী করােনা ভাইরাস সংক্রমণের জন্য চীনের কাছে। জবাব চাইতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে কি ভারত সীমান্তে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক কার্যকলাপ বাড়িয়ে কৃত্রিম উত্তেজনা সৃষ্টি করছে চীন? ভারত যাতে আমেরিকা-সহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলির সঙ্গে একযােগে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে সেই কারণে কি ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল? এই যুক্তিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে চীনকে মনে রাখতে হবে, এটা ১৯৬২ সাল নয়। আর দেশের শাসনভার কংগ্রেসের হাতে নেই। ভারত সীমান্তে চীন যখন তার সামরিক পরিকাঠামাে মজবুত করছিল এদেশের একের পর এক সরকার তখন চুপ করে ছিল। চীনের বিরদ্ধে পরিকাঠামাে উন্নয়নে প্রথম উদ্যোগ নেয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার। নরেন্দ্র মােদীর নেতৃত্বাধীন সরকার চীন সীমান্তে ব্যাপক পরিকাঠামাে উন্নয়ন করে চলেছে। লাদাখে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত লাদাখের দৌলতবেগ ওলডি অঞ্চলে সেনা ও বিমান নিয়ে যেতে পেরেছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী জি-সেভেন দেশগুলির গােষ্ঠীতে ভারতের সদস্যপদ পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই ১৯৬২-র মতাে অ্যাডভেঞ্চার নিতে গেলে বিপদে পড়বে চীনই। কারণ বর্তমান ভারত এক নতুন ভারত। এই ভারত অনেক শক্তি ধরে। বিশ্বও তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

বিমল শঙ্কর নন্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.