একসঙ্গে বেজে ওঠে শাঁখ, আরতির ঘণ্টা বাজে প্রায় পাঁচশো মন্দিরে, বাংলার বিস্ময় সিউড়ির ‘মন্দির নগরী’ করিধ্যা

গোধূলির মরচে ধরা আলো তখনও ফুরিয়ে যায়নি। ধীরে ধীরে তাতে সন্ধের আঁচ লেগেছে। গ্রামের পথে পা দিয়েই থমকে গেলেন ভিন রাজ্যের কয়েকজন পথিক। গোটা গ্রাম যেন সন্ধ্যা-আরতিতে মেতে উঠেছে। একসঙ্গে বেজে উঠেছে কয়েকশো শাঁখ। কাঁসর, ঘণ্টার আওয়াজের সঙ্গে মহিলা কণ্ঠের উলুধ্বনি। কোনও বড় পুজো হচ্ছে কি গ্রামে? ভাবতে ভাবতে গোটা গ্রাম ঘুরে পথিকরা অবাক। ছোট্ট একটা গ্রামের দিকে দিকে মন্দির। সেখান থেকেই ভেসে আসছে শাঁখ, ঘণ্টার আওয়াজ। প্রদীপ, আরতি, ধূপ-ধুনোর গন্ধে গ্রামজুড়ে যেন উৎসবের আবহ।

মন্দিরময় গ্রাম বা মন্দির-গ্রাম “করিধ্যা” সত্যিই বাংলার বিস্ময়। সিউড়ি থেকে রাজনগর যাওয়ার পথে একটেরে ছোট্ট গ্রামটার আর বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। নেহাতই ছাপোষা একটি গ্রামকে পরিচিতি দিয়েছে শতাধিক মন্দির। গ্রাম জুড়েই মন্দির। পথ চলতে রাস্তার বাঁকে, অলিতে-গলিতে পাশাপাশি, গা ঘেঁষা মন্দির। গ্রামের প্রায় সব বাড়ির সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে মন্দির। সিউড়ির করিধ্যার তাই আর এক নাম ‘মন্দির-নগরী।’

‘‘বীরভূমের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রাম এই করিধ্যা,’’ গ্রামেরই এক বাসিন্দার কথায়, করিধ্যার বয়স প্রায় ৩০০ বছর। একসময় জঙ্গলে ঘেরা জনপদ এখন মন্দির-গ্রাম। গ্রামে মন্দিরের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নয় নয় করে ৫০০। তার বেশি হতে পারে, কম নয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, অধিকাংশই শিব মন্দির। কালী, দুর্গা ও অন্যান্য দেবদেবীর মন্দিরও রয়েছে। তবে সংখ্যায় কম।

শিব মন্দিরের আধিক্য হলেও সবচেয়ে প্রাচীন কিন্তু কালী মন্দির, গ্রামের বর্ষীয়ান মোড়লের দাবি এমনটাই। কেন এত মন্দিরের ছড়াছড়ি তার সঠিক কারণ অবশ্য কারওর জানা নেই। তবে এইসব মন্দির ঘিরে চালু আছে নানা গল্পকথা। গ্রামের বর্ষীয়ানদের অনেকে বলেন, বিভিন্ন সময় স্বপ্নাদেশ পেয়ে নাকি তৈরি হয়েছিল এইসব মন্দির। অনেকে আবার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের কথায়, একসময় বর্গির আক্রমণ ঠেকাতে নাকি মন্দির বানাতে শুরু করেছিলেন গ্রামবাসীরা। অর্থাৎ শত্রুদের হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার সেরা উপায় ছিল এইসব মন্দির।
ইতিহাস বলছে, প্রায় ৩০০ বছর আগে মারাঠা সেনাদের আক্রমণে বীরভূমের রাজনগর তখন লণ্ডভণ্ড। ঘরে ঘরে হাহাকার। রাজনগর যাওয়ার জন্য অশ্বারোহী সেনাদের পার হতে হত করিধ্যা। ছোট্ট গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় যথেচ্ছভাবে লুঠপাট চালাত বর্গিরা। ভাঙচুর করা হত বাড়িঘর। এই আক্রমণ ঠেকাতে গ্রামবাসীরা একটা উপায় বার করেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল মারাঠারা শৈব। তাই যে সব বাড়ি থেকে ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি ভেসে আসবে, সেখানে হামলা করবে না তারা। গ্রামের জমিদার বাড়িতে প্রথম তৈরি হয় শিব মন্দির। সেই থেকে প্রত্যেক বাড়িতে শিব মন্দির বানানো শুরু হয়। এই ভাবে ধীরে ধীরে গোটা গ্রাম ছেয়ে যায় মন্দিরে।

‘মন্দির নগরী’ মায়ানমারের বাগান :

মন্দির-গ্রাম করিধ্যার সঙ্গে মায়ানমারের ‘মন্দির নগরী’ বাগান-এর আশ্চর্য মিল। মান্দালয়ের এই শহরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দু’তিন হাজার বৌদ্ধ মন্দির, মঠ, স্তূপ। লক্ষ লক্ষ পর্যটকদের ভিড়ে ‘মন্দির শহর’ বাগান-এর আকর্ষণই আলাদা। ৯-১৩ শতকে এখানে গড়ে উঠেছিল পাগান সাম্রাজ্য। বাগান ছিল তারই রাজধানী শহর। সেই সময় শহরজুড়ে তৈরি হয়েছিল ছোট, বড় মিলিয়ে প্রায় ১০,০০০ মন্দির, মঠ।

বাগান হয়ে উঠেছিল মায়ানমারের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র, পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মের এক সমৃদ্ধ পীঠস্থান। বর্তমানে সেই সব মন্দির, মঠের বেশিরভাগই ভগ্নপ্রায় বা সংস্কারের অভাবে হারিয়ে গেছে। তবে এখনও শহরের আনাচ কানাচে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য লাল টেরাকোটার বৌদ্ধ মঠ। টিলোমিনোলো, আনন্দপায়া, ধামাইয়ানগি, থাটবিনিয়ুর মতো হাজার হাজার মঠ দেখতে পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ে।

বাগান-এর মতো ঝাঁ চকচকে না হলেও ছোট্ট গ্রাম করিধ্যাকে ‘মন্দির নগরী’ বলতেই বেশি ভালোবাসেন স্থানীয়রা। বর্তমানে গ্রামে প্রায় হাজার দুয়েক মানুষের বাস। সকলে মিলে মিশে মন্দিরগুলির দেখাশোনা করেন। সংস্কারের অভাবে বেশিরভাগ মন্দিরই ভগ্নপ্রায়। পর্যটন মানচিত্রে এখনও সে ভাবে জায়গা করে নেয়নি সিউড়ির করিধ্যা। অনেকের কাছে করিধ্যার নাম এখনও অজানা। তবু মন্দির ঘিরে বিশ্বাসটা এখনও অটুট। ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে মাঝে মাঝে দরবার করি আমরা। মন্দিরগুলি সংস্কার করলে আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য অনেক বাড়বে,’’ গ্রামবাসীদের দাবি এমনটাই। (সৌজন্য “ওয়াল”ওয়েব পোর্টাল)

চৈতালী চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.