লিঙ্গ পুরাণের গল্পঃ স্বর্গে শিবলিঙ্গের প্রথম আবির্ভাব ও শিবরাত্রির প্রথম পূজা
স্বর্গে প্রথম যেদিন যে-তিথিতে অন্ধকারে আলোর দিশা নিয়ে শিব জ্যোতির্লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেই তিথিটিই হল ‘শিব চতুর্দশী বা শিবরাত্রি’। যখন সৃষ্টির কাজ শুরু হয়নি, চারিদিক নিকষ অন্ধকার, ব্রহ্মাণ্ড জলে থই থই করছিল; তখন শিবের ইচ্ছেয় প্রথম বিষ্ণু আর ব্রহ্মার আবির্ভাব হল। আবির্ভাবের পর দুজন শুধু দুজনকেই দেখলেন, আর কাউকে দেখতে পেলেন না। কথায় কথায় সেই দুজনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল ঝগড়া, কে আগে এসেছেন, কে ভগবান, কে বড়, কে শ্রেষ্ঠ—তাই নিয়ে। তখন চরাচর ব্যাপ্ত স্বয়ম্ভু শিব মনে মনে হাসলেন। দুই দেবতার হাতাহাতি হয় এমন অবস্থা যখন দাঁড়াল, তখন তাঁদের মাঝখানে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে শিবের আবির্ভাব হল। বিচ্ছুরিত আলোর পুঞ্জের মতো সেই লিঙ্গ। আকাশবাণীর মধ্য দিয়ে শিব দুই দেবতাকে বললেন, হে দেবতাদ্বয়, আপনারা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবেন না। আপনাদের মধ্যে এই জ্যোতির্লিঙ্গের আদি বা অন্ত যিনি খুঁজে বার করতে পারবেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ, তিনিই বড় বলে বিবেচিত হবেন।
বিষ্ণু ও ব্রহ্মা তখন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁরা জ্যোতির্লিঙ্গ কি, কে—এসব কিছু না ভেবেই সেই জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ব্রহ্মা লিঙ্গের আদি খুঁজতে উপরে উঠতে লাগলেন, বিষ্ণু গেলেন নীচের দিকে অন্ত খুঁজতে। কিন্তু কয়েক লক্ষ বছর ধরে তাঁরা নিরন্তর সেই জ্যোতিপথে গমণ করেও আদি বা অন্ত কিছুই খুঁজে পেলেন না। তখন হতাশ হয়ে তাঁরা ফিরে এলেন আবার যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেইখানে। বিষ্ণু এসে মাথা নীচু করে বললেন যে, তিনি অন্ত খুঁজে পাননি। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মোহ ব্রহ্মাকে এমন পেয়ে বসেছিল যে, ব্রহ্মা মিথ্যে বললেন। বললেন যে, তিনি আদি খুঁজে পেয়েছেন!
শিব এই মিথ্যেকথা শুনে খুব রেগে গেলেন। রুদ্রমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন, বললেন, তিনি শিব, তিনি স্বয়ম্ভু, তিনিই সৃষ্টির কারণ, তিনিই ধ্বংসের নিমিত্ত, তিনিই ঈশ্বর, তিনিই আদি এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ! তাঁর জ্যোতির্ময় লিঙ্গরূপের কোন আদি ও অন্ত নেই। তা অনাদি, তা অনন্ত। যখন সৃষ্টি ছিল না তখনও তা ছিল, যখন সৃষ্টি থাকবে না, তখনও তা থাকবে! নিজের স্বরূপটি চিনিয়ে দিয়ে তিনি ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন, দেবতা হয়েও মিথ্যে বলার জন্য দেবতা হিসেবে কোনদিন গেরস্তের ঘরে ব্রহ্মা পূজ্য হবেন না! কখনই জগতপূজ্য হবেন না!
শিবের সেই দারুণ মূর্তি দেখে ও শাপবাক্য শুনে কেঁপে উঠলেন ব্রহ্মা। শিবের কাছে বার বার ক্ষমা চাইলেন তাঁর ভুলের জন্য। অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে কৃপাপ্রার্থী হয়ে শিবের শরণ নিলেন। বিষ্ণু তাঁকে স্তবগানে ভজনা করে পূজা করলেন। এই হল শিবের প্রথম পূজা। সেই প্রথম শিব চতুর্দশী তিথি। শিব তাঁদের ভজনায় তুষ্ট হয়ে সৃষ্টির প্রয়োজনে ব্রহ্মাকে ভার দিলেন প্রজা বা জীব সৃষ্টির আর বিষ্ণুকে দিলেন জীবের পালনের ভার। সত্যভাষণের জন্য বিষ্ণুর প্রতি আগে থেকেই তিনি তুষ্ট ছিলেন, তাই তাঁকে এরসঙ্গে দিলেন জগতের পূজ্য হয়ে ওঠার আশীর্বাদ।
শিব পুরাণের গল্পঃ মর্ত্যে শিবরাত্রিতে প্রথম শিবপূজা প্রচলনে ভুজবলের গল্প
ভুজবল নামে এক মহা ধুরন্ধর চোর ছিল। সে গেরস্তের চোখের সামনে থেকে কখন যে কি চুরি করে নিত, কেউ টেরটিও পেত না। আজ এর ঘরে সে চুরি করে, কাল তার ঘরে। চোখের সামনে বাটি-ঘটি-টাকাকড়ি এই আছে, এই নেই! এতো মহা জ্বালা! রোজ রোজ লোকে আর কাঁহাতক সহ্য করে। একদিন কোনরকমে তাকে হাতেনাতে ধরে আচ্ছা করে ঘাকতক দিয়ে নিয়ে গেল রাজার কাছে। রাজাকে বলল, হয় একে রাজ্যছাড়া করুন মহারাজ, নয় আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার আজ্ঞা দিন! এমন চোরকে নিয়ে তো আর পারা যায় না!
বামাল ধরা পড়েছে যখন, তখন বিচার পেতে দেরি হল না। রাজা ভুজবলকে রাজ্য থেকে দূর করে দিলেন। তাকে হুঁশিয়ারি দিলেন, রাজ্যের ধারেকাছে দেখতে পেলেই কিন্তু মুণ্ডুটি নামিয়ে দেওয়া হবে, মনে থাকে যেন!
মনে থাকবে না মানে! মুণ্ডু সামলে ভুজবল সেই যে রাজ্য ছেড়ে পালাল, আর ফিরেও তাকাল না। অনেক পথ পেরিয়ে নতুন এক রাজ্যের সীমানায় এসে প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে সে কোনোরকম ঢুকে পড়ল সে-দেশে। ঢুকে তো পড়ল, কিন্তু খাবে কি! খেটে খাওয়া তো তার ধাতে নেই। সে দেখল সে-দেশের মানুষের আছে বেশ বড় বড় ফলের বাগান। ফল তো চুরি করাই যায়। কিন্তু শুধু ফল খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। তাই সে রাতের বেলায় ফল চুরি করে দিনের বেলায় বাজারে বেচে, আর সে টাকায় চালডাল কিনে আনে। নিজের হাতে রেঁধে খায়। এমনি করে তার দিন যায়।
এক রাতে ফল চুরি করতে সে উঠেছে গাছে। বেলের বাগানে বেল গাছ। ফাল্গুন মাস, গাছের পাতায় অল্প অল্প শিশির। রাতের অন্ধকারে সে বুঝতেই পারেনি যে, বেলগাছের নীচে পাতা আছে শিবের ছোট্ট একটি লিঙ্গ। আর কপালগুণে সেদিন ছিল শিব চতুর্দশী তিথি! কিন্তু সে তিথি বা শিবের সঙ্গে তার তো কোন লেনদেন নেই। তাই, সে বেশ নিশিন্তে গাছ থেকে ইচ্ছেমতন ফল পেড়ে নেমে চলে গেল। সে জানলই না, তার ফল পাড়ার সময় হাতের চাপে গায়ের চাপে একটি একটি করে বেলপত্র আর ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের জল পড়েছে শিবলিঙ্গে। তাতেই পরম তুষ্ট হয়েছেন শিব আর তার অজান্তেই হরণ করেছেন ভুজবলের এতদিনের চুরির সমস্ত রকম পাপ। শিব ছাড়া ভুজবল কেন আর কেউই জানল না তার সেই অঢেল পূণ্য অর্জনের কথা!
তারপর একদিন যখন সে মারা গেল কালের নিয়মে, তখন তাকে যেতে হল শেষ বিচারের আশায় যমের দরবারে। সেখানে তার জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে যম তো অবাক, চিত্রগুপ্ত অবাক! ভুজবলের মতো দাগি একটা চোর কিনা একরাত্রির শিবপূজার ফলে অর্জন করে ফেলেছে অক্ষয় স্বর্গবাসের অধিকার! এই খবর সমস্তলোকে ছড়িয়ে পড়তেই শিবের মহিমা আর ভুজবলের সুকৃতিতে ধন্য ধন্য পড়ে গেল এবং সেই থেকে মর্ত্যধামে শুরু হল যথানিয়মে শিবরাত্রিতে অক্ষয় পূণ্যকামনায় শিবের বিশেষ পুজো।