অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালেই বাংলার শেষ হিন্দু রাজা হিসাবে যার খোঁজ মেলে তিনি লক্ষ্মণ সেন। হলায়ুধ, ধোয়ী, শরণদের নিয়ে কাব্য চর্চা করে দিন কাটছিল তার। কবি জয়দেব পরে রাজ সভায় যোগদান করে সভার শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়ক হন। জয়দেব গোস্বামী রচিত গীতগোবিন্দম্ বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গনে একটা পরিবর্তন প্রায় নিঃশব্দে এনে দেন। বাংলা ঘেঁষা সংস্কৃতে রচিত জয়দেবের এই অমর সুললিত কাব্যগ্রন্থটি বঙ্গ সংস্কৃতি জাগরণের প্রথম দীপশিখা।
জয়দেবের পর রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, প্রণয়, বিবাহ, রাগ অনুরাগ, অভিসার আর মিলন ও বিচ্ছেদ নিয়ে ব্রজবুলি ভাষায় গান বেঁধে ফেললেন মৈথিলি কোকিল বিদ্যাপতি। বাংলার নানুরে রজকিনী কন্যা রামীকে সঙ্গে নিয়ে আদ্যন্ত বাঙ্গালি ছেলে চণ্ডীদাস পদ রচনা করলেন খাঁটি বাংলা ভাষায়। বাংলা গানের ইতিহাস বাঙ্গালি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে চণ্ডীদাসকে অমর করে রেখেছে তার অমর সৃষ্টিকে মর্যাদা দিয়ে।
এরপরই বাঙ্গালির হৃদয় আর্তি উন্মোচিত করে বাংলায় ঐতিহাসিক দুঃসময়ের অন্ধকার ভেদ করে দিব্য সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে উদ্ভাসিত হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। অখণ্ড বাংলার প্রথম গণসংগঠক প্রাণবন্ত এই পুরাণপুরুষের অনুপ্রেরণায় বঙ্গভূমে গীতগোবিন্দ বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের পদাবলী মূর্ত হয়ে উঠল বাঙ্গালির কীর্তন আসরে ঘরে ঘরে।
পরবর্তীকালে তৈরি হলো মঙ্গলকাব্য, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, শিবায়ন গীতি বা রামায়ণী গান। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হলো কথকতা গান, কবি গান, কবির লড়াই। ওই সময়ে তরজা গান বাংলার গৌড়বঙ্গে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করল।
সময় এগিয়ে চললো। ততদিনে বাংলা সংগীত অঙ্গনে প্রকাশমান হলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, সংগীত শিল্পী। বাংলা গানের ধারায় এক আশ্চর্য সংযোজন হলো। তাঁর গানে— ঈশ্বর, ধর্ম, দেশ, কাল, সমাজ, মানুষ, সমকাল ভাবী কাল অদ্ভুতরূপে ধরা দেয়। একই সঙ্গে প্রেম, বিরহ, মিলন ও বিচ্ছেদ মূর্তিমন্ত হয়ে ওঠে। ছয় ঋতু প্রকাশ পায়। লোকে বলতো রবিবাবুর গান। অভিজাতদের অন্তঃপুর থেকে সাধারণের আঙিনায় ছড়িয়ে পড়ল রবীন্দ্র সংগীত।
বাংলা গানের আর এক সমসাময়িক দিকপতি কাজী নজরুল ইসলাম। কবির রাগাশ্রয়ী বাংলা গান বাঙ্গালির ঘরে ঘরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাঙ্গালির সম্পদের ভাণ্ডারে রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুল গীতি সম্ভবত ব্যক্তি নাম পরিচয়ে সংগীত হিসাবে শেষ সংযোজন।
কিন্তু রুচি বদলের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক চেতনা ও বদলায়। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে অসামান্য সব সুরকার গীতিকার শিল্পীকুল বাংলা গানে নতুন আধুনিক গানের ধারাকে পুষ্ট করেছেন। শত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে আটের দশকের প্রথমদিক অবধি বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ। সেই সময় বাংলামায়ের কোলে জন্ম নিয়েছে দেশবিখ্যাত শিল্পী। গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুরকার-গীতিকার সলিল চৌধুরী, মান্না দে, সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও কত কত নাম।
তবে শুধু আধুনিক গানই নয়, বাংলা লোকসংগীত ও বাংলা গান দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বাঙ্গালিকে সমৃদ্ধ করছে। বাউল গান পথ থেকে উঠে এল শহরের অভিজাত মঞ্চে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের লোকসংগীত ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, টুসু, ভাদু, মনসা, ঝুমুর, গম্ভীরা, জারি, সারি গান, চটকা, মৈষালি, বিয়ের গান, বৃষ্টির গান, ঝাপান, মনসা ভাসান, বোলান গান, রামায়ণী গান, হাপু গান, পৌষলক্ষ্মী বন্দনা, পাঁচালী গান ইত্যাদি লোক সংগীতে বহু ধারা বহু শিল্পীকে প্রতিষ্ঠা দেয়। কিন্তু গত তিন চার দশকে বাংলা গানের জগতে পশ্চিমের জানলার ঝোড়ো বাতাসের দাপটে বন্ধ করা যাচ্ছে না। অপসংস্কৃতির গ্রাসে বাংলা গান তার নিজস্ব গতি হারিয়ে ফেলেছে। যুগের সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে আমরা অনুকরণে মেতে উঠছি। ফলে ঐতিহ্যবাহী বাংলা গানের ধারাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
ইদানীং বাঙ্গালির সংগীত জগতে নতুন বাংলা গানের ধারা চালু হয়েছে— জীবনমুখী গান। যার ভাষা চয়ন থেকে উপস্থাপনার উন্মাদনা যেন তামসিক ভাবকেই জাগিয়ে তোলে বেশি। এখানেই শেষ নয়, পাল্লা দিয়ে মাথা তুলছে বাংলা ব্যান্ডের নামে পরম্পরাকে উপেক্ষা ও কটাক্ষ করে গানের শব্দ চয়ন। একই সঙ্গে গানের কথার থেকে যন্ত্রের দাপাদাপিতে কান যেন বধির ও ঝালাপালা হয়ে উঠছে। তবুও এত অবক্ষয় সত্ত্বেও বঙ্গভূমিতে ভালো গায়ক, গীতিকার, সুরকারের অভাব নেই। আমরা তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই হেঁটে চলেছি। সুতরাং এখনই হতাশ হবার কিছু নেই।

তিলক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.