সুতোয় বোনা তাঁদের স্বপ্ন। সুতোর উপর সুতো বুনে চলে গল্প, গান, কথা আর তৈরি হয় এক একটা ফ্যাব্রিক। মুখে হাসি ফোটে শিল্পীদের। বিষ্ণুপুরের সেই সনাতনী ফ্যাব্রিক এখন মৃতপ্রায়। জৌলুস হারিয়ে অন্ধকারে শিল্পীরা।
ভোট আসে ভোট যায়। কিন্তু দিন বদলায় না বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত বালুচরি শিল্পীদের। আগামী ১২ মে বাঁকুড়ার দুই কেন্দ্রে ভোট। ভোটের মরসুমে কেমন আছেন শিল্পীরা? “পরিশ্রম আছে, কিন্তু বেতন নেই। যেন জেলখানায় বন্দি,” বললেন এক শিল্পী। অন্যজনের কথায়, “আমার পরবর্তী প্রজন্মকে কিছুতেই এই পেশায় আসতে দেবো না।”
মেশিনে বোনা আধুনিক লিনেন, শিফনের যুগে কি তাহলে দর কমলো বালুচরির? অথচ বিষ্ণুপুরের বালুচরি, স্বর্ণচরী শাড়ির কদর জগৎবিখ্যাত। কখনও রংবাহারি মখমলি শাড়ির আঁচলে নিপুণ ফোঁড়, কখনও জমকালো বুটিদার বালুচরির সারা অঙ্গে নল-দময়ন্তী, কালীয়দমন, মৈনাক পর্বত, স্যমন্তক মণির পৌরাণিক উপকথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন নকশায় বালুচরিকে সমৃদ্ধ করেছেন শিল্পীরা। শাড়িতে এঁকেছেন টেরাকোটা মন্দিরের কারুকৃতি, মিশিয়েছেন নকশিকাঁথার সৌন্দর্য। একটা সময় বাংলার বালুচরির গৌরবগাথা ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপেও।
বদলাতে থাকা সময়ের প্রভাব পড়ে বালুচরির নিজ অঙ্গেও। নীল, লাল, বেগুনি, খয়েরি উজ্জ্বল পটভূমিতে পৌরাণিক গল্পগাথার বদলে জায়গা করে রোজকার জীবনের নানা টুকরো টুকরো ছবি। সূক্ষ কাজের বুননেই তার মহিমা। কিন্তু সে সব দিন অতীত। বিষ্ণুপুরের বর্ষীয়ান শিল্পীদের কথায়, বালুচরির চারটি ভাগ, বুটি, কলকা, পাড় ও চিত্র। চিত্র আঁকা ও কুঞ্জ নকশায় ভরাট বালুচরি একসময় পাল্লা দিত বেনারসিকেও। পঞ্চাশের দশকে মল্লভূম বিষ্ণুপুরে পুনর্জন্ম হয় বালুচরির। বিখ্যাত হয় জ্যামিতিক প্যাটার্ন, কাশী বালুচরি, মধুমালতী, রূপশালি, মীনাকারি, দোআঁচলা ও রামধনু বালুচরি।
যে বালুচরি একসময় ছিল বিষ্ণুপুরের গৌরব তাকে বাঁচাতে কোনও উদ্যোগ নেয়নি সরকার, অভিমানভরে এমনটাই জানিয়েছেন শিল্পীরা। দিনভর পরিশ্রমের মজুরি মাত্র ৩০০-৩৫০ টাকা। সরকারি উদ্যোগে একবার তাঁত যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, তবে সেটাও বর্তমানে অকেজো।
“সরকারি সুযোগ সুবিধা একটি বিশেষ গোষ্ঠী কুক্ষিগত করে রেখেছে। সাধারণ, আর্থিকভাবে দুর্বল শিল্পীরা অনেকাংশেই সেই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত,” দাবি বেশিরভাগ বালুচরি শিল্পীদেরই। ভোট নিয়ে তাই তাঁরা বেশি উৎসাহিত নন। অন্ন জোটানোই যেখানেই দুর্বিষহ, সেখানে ভোট নিয়ে মাতামাতি করার সময় নেই শিল্পীদের। অন্ধকার ঘুপচি ঘরেই তাই একটানা শাড়ির উপর নকশা বুনে চলেছেন তাঁরা। মনে আশা, একদিন ঠিক পুরনো গৌরব ফিরে পাবে বিষ্ণুপুরের সনাতনী এই শিল্প।