মেদিনীপুর জেলার মানুষের কাছে দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল এক নতুন যুগের ভোর। আর সেই স্বপ্ন কে পূরণ করতে গিয়ে প্রাণ গেছে ২০৭ জনের । বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময়ে ৩ জনের, অসহযোগ আন্দোলনে ১,আইন অমান্য ( দ্বিতীয় পর্যয়ে )২০ জন, ভারত ছাড়ো ১২৪ ।পুরুষ ২০১ জন ( হিন্দু ১৯৯ জন , মুসলিম ২ জন )মহিলা ৬ জন । মেদিনীপুরের সংগ্রামের ইতহাস এ জেলার মানুষের লড়াকু মানসিকতারই পরিচয় বহন করে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে মেদিনীপুরের মাটি বরাবরই নতুন দিশা দেখিয়েছে।
আইন অমান্য চলাকালীন মেদিনীপুর থেকে বুলেটিন প্রকাশিত হয় । তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো —সতীসদর পরিষদ ১৯২৯,কাঁথিবার্তা ১৯৩০,ধূমকেতু ১৯৩০,বিদ্রোহী ১৯৩০,সত্যাগ্রহ ১৯৩১,রণভেরী ১৯৩২,নন্দীগ্রাম বুলেটিন ১৯৩২।
মেদিনীপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিপ্লবীদের হাতে কিংসফোর্ডকে হত্যার ব্যর্থ প্রয়াসের প্রতিক্রিয়ায় সারা বাংলা জুড়ে ব্রিটিশ সরকার তল্লাশীর নাম করে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচারের চরম সীমা ছড়িয়ে যায়। কেবল মাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে বহু মানুষ গ্রেপ্তার হয়। ৩রা মে ১৯০৮ মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার মিঃ কার্নিশ জেলা জুড়ে ব্যাপক খানাতল্লাশী শুরু করেন। উপেন্দ্রনাথ ঘোষ , কালিদাস মহাপাত্র, শীতলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং পিয়ারীলাল দাসের বাড়িতে পুলিশী অভিযান চালানো হয়। হনুমানজীর মন্দিরে তল্লাশী চালানো হয়। গ্রেপ্তার হলেন সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যোগজীবন ঘোষসত্যেন্দ্রনাথ বসু , জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং সন্তোষকুমার দাশ। ২৮শে আগস্ট ১৯০৮ মেদিনীপুর শহরে গোপপ্রসাদ এবং নাড়াজোলার রাজা নরেন্দ্রলাল খানের বাড়ি শিরোমণি দেবদাসে করণের বাড়ি ও মেদিনীবান্ধব পত্রিকার অফিসেও পুলিশ তল্লাশী চালায়। প্রায় ১৫৪ জনকে ( জমিদার ২৮,উকিল ১৭,মোক্তার ৫,ডাক্তার ৬,ব্যবসায়ী ২০,সরকারি কর্মচারী ২১,ছাত্র ২৮ এবং অন্যান্য ২৯ জন )গ্রেফতার করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ওয়েস্টনকে হত্যা করবার এক মিথ্যা অভিযোগ এনে জেলার সেশন আদালতে ” মেদিনীপুর বোমা মামলা ” রজু করা হয় । এই মামলায় ১৯০৯ শেষ পর্যন্ত যোগজীবন ঘোষ , সন্তোষ কুমার দাশ এবং সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ১০ থেকে -৭ বছর দ্বীপান্তর হয় ।
এছড়া বর্জন মূলক কর্মসূচি পালন হয়েছিল মেদিনীপুর জেলায় বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনায়। হাইকোর্টের আইন ব্যবসা পরিত্যাগকারী প্রথম আইনজীবী হলেন মেদিনীপুরের বীরেন্দ্র শাসমল । তাঁর পথ অনুসরণ করে জেলায় বহু আইনজীবী আদালত বর্জন করেছিলেন। হাইকোর্টে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ছাড়াও আইন ব্যবসা পরিত্যাগ করেন সাতকড়িপতি রায় । জেলায় বিভিন্ন আদালত যাঁরা বর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আইনজীবী ছিলেন ১৭ জন , মোক্তার ৩ জন , এবং ১ জন মহুরি।
মেদিনীপুরই প্রথম ‘ ইউনিয়ন বোর্ড ‘ প্রতিরোধ আন্দোলন করে। ১৯২১ সালের মে মাসে কাঁথি ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদারী টাক্স দেওয়া বন্ধ করে।
১৯০২ সালে মেদিনীপুরে প্রথম গুপ্তসমিতি তৈরি করেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু তাঁকে সাহায্য করেছিল তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং হেমচন্দ্র কানুনগো। সিস্টার নিবেদিতা ১৯০৩ সালে মেদিনীপুরে এসেছিলেন ওই একই বছরের শেষের দিকে এসেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।

১৯০৫ সালের লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণায় অন্যান্য জেলার সঙ্গে মেদিনীপুরেও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ১৬ ই অক্টোবর ‘ অশৌচ দিবস ‘ পালিত হয় । ইতিমধ্যেই সত্যেন্দ্রনাথের গঠিত ‘ ‘ন্যাশন্যাল ভলান্টিয়ার কোর ‘তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছিল । সেই সময় হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বাধীন গুপ্ত সংস্থা বি .ভি নামে পরিচিতি ছিল মেদিনীপুরে এই বি.ভি দলের সদস্যরা ৩ জন জেলাশাসক কে হত্যা করে -পেডি হত্যা ৭ ই এপ্রিল ১৯৩১ ,ডগলাস হত্যা ৩০ শে এপ্রিল ১৯৩২,বার্জ হত্যা ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩। ডগলাস কে হত্যার জন্য তরুণ বিপ্লবী প্রদ্যোত ভট্টাচার্য্যর ফাঁসি হয় ১২ ই জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে এই ডগলাসকে হত্যার জন্য বি.ভি র ৩৩ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয় ।
বার্জ কে হত্যার জন্য ১৯৩৪ সালে ২৫ শে অক্টোবর ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায়ের ফাঁসি হয় এবং পরের দিন ২৬ শে অক্টোবর ফাঁসি হয় নির্মলজীবন ঘোষের । অনাথ বন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন দত্ত বার্জের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হয় এই দুজনই বার্জকে গুলি করে হত্যা করে। এছড়া নন্দদুলাল সিং , সুকুমার সেনগুপ্ত , শান্তিগোপাল সেনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় ।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা সম্পর্কে দুটি মন্তব্য স্মরণযোগ্য । ঐতিহাসিক আবুল ফজল ‘ আইন ই আকবরী ‘ তে মেদিনীপুরকে বলেছিলেন ” বাংলার বারুদখানা “।আবার মেদিনীপুর সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মন্তব্য ‘ it is the land of revolt ‘ অর্থাৎ বিদ্রোহের দেশ বা পীঠস্থান । বাস্তবে দুটি মন্তব্যই সুপ্রাযোজ্য।

সৌমেন ভৌমিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.