প্রতিবেদন লেখার সময় সর্বশেষ খবর দমদম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি-র প্রধান কার্যালয়ে তৃণমূলি দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়েছে। কেমন ছিল সেই হামলার ধরন? দুপুর নাগাদ কার্যালয়ে একা ছিলেন বিজেপির উত্তর-শহরতলী সাংগঠনিক জেলা সম্পাদক চণ্ডীচরণ রায়। দুষ্কৃতীরা আচমকা বাইক চড়ে এসে ঢুকে পড়ে ওই কার্যালয়ে। শাটার নামিয়ে চণ্ডীবাবুর ওপর চলে নৃশংস মার। রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর আর গভীর ক্ষত নিয়ে তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। এধরনের শুষ্ক পরিসংখ্যানের কোনও শেষ নেই। এই ঘটনার দুদিন আগেই পুরুলিয়া জেলায় বিজেপি কর্মী শিশুপাল সহিসকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল গাছে। সকলেরই জানা, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর ঠিক একই কায়দায় আরও দু’জন বিজেপি কর্মী ত্রিলোচন মাহাত, দুলাল মাহাতকে একইভাবে খুন করেছিল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। গাছে দেহ ঝুলিয়ে আত্মহত্যার গল্প দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল।
ভোটের হানাহানি বাংলায় নতুন কিছু নয়। বাম আমলেও এই ধরনের সন্ত্রাস হয়েছে, তখন ছিলশ্মশানের নীরবতা। ভোটের আগের দিন গ্রামকে গ্রাম পুরুষশূন্য করে দেওয়া হতো, বিরোধী দলের কর্মীদের গুম করা হতো, ভোটের দিন বাম-কর্মীকেই বিরোধীদের এজেন্ট সাজিয়ে বুথে বুথে বসিয়ে চলত অবাধ ছাপ্পা। সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব তখন ছিল না, ইলেকট্রনিক মিডিয়া অত্যন্ত দুর্বল, থাকার মধ্যে প্রিন্ট মিডিয়া। হাতে গোনা দু-একটি বাদ দিয়ে অধিকাংশ প্রিন্ট মিডিয়াই বামেদের তাঁবেদারি করতো। ফলে সিপিএমের বৈজ্ঞানিক রিগিং আর সন্ত্রাসের কাহিনি তৎকালীন সময়ে সেভাবে জানা যেত না। উদয়ন নাম্বুদিরি ‘বেঙ্গলস নাইট উইথআউট এন্ড’ বইতে এধরনের নানা তথ্য ঠাসা রয়েছে।
সুতরাং তৃণমূল জমানার সন্ত্রাস বাম আমলের তুলনায় নতুন কিছু নয়। কিন্তু রাজনৈতিক চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের চরিত্রেও বদল এসেছে। বাম আমলে বিরোধী বলতে সব বিরোধীকেই এক মাপকাঠিতে মাপা হতো। ‘৭৭ থেকে মূল বিরোধী ছিল কংগ্রেস। তবে এই দলটাতেও প্রচুর রাজনৈতিক গুণ্ডা। ছিল, যারা সময়ে অসময়ে সিপিএমের হয়ে ভাড়া খেটে দিত অর্থাৎ বিরোধী আন্দোলনকে সাবোটেজ করত। পরবর্তীকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই যাদের ‘তরমুজ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। মজার কথা, সব জেনে বুঝেও তিনি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীনই এই তরমুজদের দলে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এবং যে কারণে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসতে তাকে আরও দশবছর অপেক্ষা করতে হয়।
বিরোধীদের ওপর হানাহানিটা তাই বাম জমানায় কৌশলগত অঙ্গ ছিল। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তার দলীয় তরমুজরা নিরাপদে ছিল। ১৯৯৯-২০০০ সালে মেদিনীপুর বা আরামবাগে বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করলে, ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শ্মশানের শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল ওই সমস্ত এলাকায় বিরোধী কর্মীদের নিকেশ করে। বাম আমলের সঙ্গে এই আমলের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের চিত্রটার তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে, ‘হাড় হিম করা’ সন্ত্রাসের কোনও পরিবর্তন না হলেও ভোট মেটার পরে দলবদলের করুণ চিত্রটা আগের জমানায় অন্তত ছিল না।
শ্মশানের শান্তিতে গণতন্ত্র এভাবে প্রকাশ্যে অন্তত লাঞ্ছিত হতোনা, যেটা বর্তমান সময়ে হচ্ছে। বিরোধীদের মধ্যে তরমুজ জাতীয় কোনও চরিত্র তৈরির দরকার তাই শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুভব করেননি (যদিও কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে তার ডিক্টেটরশিপের দৌলতে তৃণমূলে এখন কুমড়ো, অর্থাৎ বাইরে সবুজ ভেতরে গেরুয়া, শ্রেণীর রাজনীতিকের উদ্ভব হয়েছে)। হাজারো সন্ত্রাসেও যে বিরোধীরা ভাগ্যবলে উতরে যাচ্ছে ভোটের পর তাদের তৃণমূলি ঝান্ডা ধরিয়ে দাও, ব্যস মোটামুটি সন্ত্রাসের বিকল্প সমাধান এটাই। সিপিএমের আর যাই থাক, নীতি-আদর্শের একটা বালাই ছিল, অন্তত ওপর ওপর, তাই তৃণমূল বা কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থীকে তাদের জার্সি পরতে না।
তৃণমূলের সেসব বালাই নেই, কংগ্রেসের গুন্ডারা জার্সি বদলে আগেই তাদের দলে ঢুকে পড়ে ছিল। ২০১১-র পর সিপিএমের হার্মাদরা। আর মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময়ে নকশাল, জেহাদি ইত্যাদি দুষ্কৃতীরা। তাই সামগ্রিক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস একটি দুষ্কৃতীদের আশ্রয়দাতা দলে পরিণত হয়েছে, বাম-কংগ্রেসের কোমর ভেঙে দিয়ে। অন্যদিকে ২০১৪-মোদী ঝড়ের পর থেকেই বাঙ্গলায় বিজেপির প্রভাব বাড়ছে। আর এস এসের সৌজন্যে বিজেপি আগাগোড়াই গোটা দেশের সঙ্গে সঙ্গে এরাজ্যেও ‘পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স’-এর চরিত্র বজায় রেখেছে, তা সে পাক-নকশাল দালাল বাজারি মিডিয়া যতই তাকে কালিমালিপ্ত করবার চেষ্টা করুক না কেন।
ফলে তৃণমূল যেমন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুষ্কৃতী দলে রূপান্তরিত হয়েছে, এরাজ্যেও বিজেপিও তেমনি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের দৌলতে দুষ্কৃতীদের হাত থেকে মুক্তির দিশারি হয়ে উঠেছে। তাই তৃণমূলের হামলায় যাবতীয় শিকার মূলত বিজেপি কর্মীরাই হচ্ছেন। সিপিএমকংগ্রেসের সংগঠন নেই কেন, কেন তারা বিরোধীর আসন দখল করতে পারছে না, মমতা ব্যানার্জির এনিয়ে দীর্ঘশ্বাসের শেষ নেই। আসলে গলদটা তিনিই করে ফেলেছেন। বিরোধী রাজনীতির সর্বস্ব কুক্ষিগত করার জন্য সিপিএম-কংগ্রেস উভয় দলেই তিনি হাঁড়ির হাল করে দিয়েছেন। সিপিএম কংগ্রেসের বর্তমান অস্তিত্ব সাইনবোর্ড মাত্র। এই বিরোধী শূন্য পরিসরে মমতার একমাত্র ভয়ের কারণ বিজেপি। এই কথাটি বোঝার জন্য বিশাল রাজনীতির তাত্ত্বিক হওয়ার দরকার নেই। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যাবে, দিল্লিতে মমতার দুর্ধর্ষ মোদী-বিরোধিতা কি কেবলই তখত দখলের তাগিদে?
পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিয়াল্লিশটা আসন পেলেও যে দিল্লি বহুদূর তা সে যত অপরিণত রাজনৈতিক মস্তিষ্কই মমতার হোক না কেন, তা তিনি জানেন না, তা হতে পারে না। ফেডারেল ফ্রন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে গদি দখলের স্বপ্ন তিনি দেখতেই পারেন, কিন্তু অখিলেশের হাত ধরার আগে তার পিতৃদেব মুলায়মের দু’দুবার বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষত কি এত দ্রুতই ভুলবেন মমতা? মাঝে মধ্যেই তিনি আওড়ান। দিল্লির তখতের প্রতি তার কোনও লোভ নেই। কথাটা যত মিথ্যেই হোক, বাস্তবতাটা মমতা নিশ্চয়ই বোঝেন? তাহলে মোদীর বিরুদ্ধে সবাইকে একজোট করা, দিল্লিতে তীব্র মোদী বিরোধী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা, অনেকটা বাংলায় একদা বাম-বিরোধী হিসেবে নিজেকে যেমন তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এসব কীসের তাগিদে? কারণ মমতা খুব ভালোভাবেই জানেন যার জোরে তিনি দিল্লির বুকে এই ধরনের মাতব্বরি করতে পারছেন, সেই পশ্চিমবঙ্গে তাঁর গদি টলটলায়মান। বাম-বিরোধিতার মরীচিকা দিয়ে উন্নয়ন বিহীন পশ্চিমবঙ্গে তার রাজ্যপাট আর বজায় রাখা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের আত্মার সঙ্গে একাত্ম হতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজ্যেও বিকল্প হিসেবে একমাত্র বিজেপিকেই বেছে নিতে চাইছে। মমতার মুসলমান তোষণের পথেও একমাত্র কাঁটা বিজেপি। হিন্দুদের নজর ঘোরাতে তাই তিনি যতই রামনবমী করুন আর যাই করুন, এক গলা গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বললেও গ্রামে-গঞ্জে মুসলমানদের হাতে অত্যাচারিত হিন্দুদের ভবি ভুলবে না। জেহাদি মুসলমানদের খুশি করতে তিনি মোদীর সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সুর চড়ালে তা যে রাজ্যবাসী ভালোভাবে নেয়নি তা মমতা। ভালোভাবেই জানেন।
সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছে এবারে তৃণমূল ৪০শতাংশের কম ভোট পেতে পারে, বাস্তবটা যে আরও করণ তা মমতা জানেন। সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশে ভোট হলে তৃণমূলের ৪২-এর স্বপ্নে যে সংখ্যাটা নিমেষে বদলে ২৪ হয়ে যেতে পারে, বা তারও কম এটা মমতার না বোঝার কোনও কারণ নেই। আর এই জিনিস একবার হলে ২০২১-এবিরোধী দলের। মর্যাদা পাবার মতো আসনও যে তার জুটবে।
, এটা তার থেকে ভালো আর কে জানে? তৃণমূল দলটাই এরপর থাকবে কিনা, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তো তা নিয়েও সন্দিহান।
তাই বিজেপি নেত্রী তথা রাজ্যসভার সাংসদ রূপা গাঙ্গুলি থেকে শুরু করে সাধারণ বিজেপি কর্মীদের ওপর তৃণমূলি দুষ্কৃতীদের হামলা খোদ রাজ্য-প্রশাসনের মদতপুষ্ট, কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রতি মমতার অসংবেদনশীল আচরণেও এরই প্রতিফলন লক্ষণীয়। আসলে। মমতা ভয় পেয়েছেন, তাই ভয় কাটাতে তাকে ভয় দেখাতে হচ্ছে। বিজেপির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের কিছু নমুনা
• ডুয়ার্সে রূপা গাঙ্গুলির গাড়িতে হামলা, আহত দেহরক্ষী।
• পুরুলিয়ায় শিশুপাল সহিসকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া।
• জগদ্দলে দুই বিজেপি কর্মীকে মেরে হাত-মুখ ফাটিয়ে দেওয়া।
• দমদম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রধান কার্যালয়ে ভাঙচুর, গুরুতর আহত সাংগঠনিক জেলা সম্পাদক চণ্ডীচরণ রায়।
• বাঁকুড়ায় দলীয় পতাকা লাগাতে গিয়ে একাধিকবার আক্রান্ত বিজেপি কর্মীরা।
• আসানসোলে আক্রান্ত বিজেপিকর্মীরা, গুরুতর জখম দুই।
• সাঁইথিয়ায় বোমাবাজি বিজেপি সমর্থকদের বাড়িতে।
• বর্ধমানের অন্ডালে দেওয়াল লিখতে গিয়ে গুলি বোমা চলল বিজেপির কর্মীদের ওপর।
• আরামবাগের খানাকুলে বিজেপির বুথ সভাপতি রাজকুমার ঘোড়ুইয়ের বাড়ি ভাঙচুর।
• সিউড়িতে বিজেপির সাইকেল র্যালিতে হামলা।
• বনগাঁয় বিজেপি কর্মীদের পিটিয়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা।
• বীরভূমের লোকপুর, দুবরাজপুরে দলীয় প্রার্থীর প্রচারে গিয়ে তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত বিজেপি কর্মীরা।
• হাওড়ায় বিজেপি কর্মীর ওপর নির্যাতন।
এগুলি সামান্য কয়েকটি নমুনা মাত্র। এবং প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি আরও এধরনের ঘটনা ঘটবার আশঙ্কা। পুরো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হলে তৃণমূলি সন্ত্রাসের ‘মহাভারত’ লিখতে হয়।
অভিমন্যু গুহ
2019-04-28