।।প্রথম।।

হ্যারিসন সাহেব ছিলেন সেই সময় কলকাতার আয়কর কমিশনার। একদিন তিনি এলেন মেদিনীপুরে। কি করবেন? স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র অভিযোগ করেছেন । উপর তলা থেকে কড়া হুকুম আছে।

মেদিনীপুরের কিছু মহকুমায় গ্রামে গঞ্জে ব্যবসায়ীদের ওপর অন্যায় হারে কর নির্ধারণ করা হয়েছে । এ কথা শুনে বিদ্যাসাগর মশাই বাঙালি আফিসারকে নিয়মানুসারে কর ধার্য করতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি সে অনুরোধে কর্ণপাত করলেন না । তখন পুরো ঘটনাটি বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের দৃষ্টিগোচর করা হলো ।

ফলত ,বর্ধমানের কালেকটর হ্যারিসন সাহেবকে মেদিনীপুরের আয়কর কমিশনারের দায়িত্ব দিয়ে অভিযোগটির সত্যতা বিচার করার নির্দেশ দান করা হল। হ্যারিসন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ব্যবসায়ীদের খাতা পরীক্ষা করে অভিযোগের যথার্থতা নির্ধারণ করতে থাকেন। তার এই সরেজমিন, তদন্ত ইত্যাদি কাজের সময় বিদ্যাসাগর মশাই ছিলেন সঙ্গে । সেই সময় তার দুই সহস্রাধিক অর্থ ব্যয় হয়েছিল এবং কলকাতার কাজেও বেশ ক্ষতি হয়েছিল ।

এই সময় একদিন হ্যারিসন চিঠি পেলেন। স্বয়ং বিদ্যাসাগরের মাতা ভগবতী দেবী চিঠি পাঠিয়েছেন। দুপুরে তাঁর গৃহে মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রণ। সশ্রদ্ধায় হ্যারিসন উপস্থিত হলেন বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের গৃহে।

হ্যারিসন পাত পেড়ে সানন্দে মধ্যাহ্নভোজন সারেন। ভগবতী দেবী সামনে বসে তাকে যত্ন করে খাওয়ান। খাওয়ার সময় এবং পরে নানা বিষয়ে তাদের কথা হয়। বিদেশি, পরপুরুষ বলে তার সম্মুখে আসতে বা কথা বলতে ভগবতী দেবী কোন সংকোচ বোধ করেননি। তার মনের মধ্যে কোথাও দেওয়াল তৈরি হয়নি ।

আরো একজন সাহেব ছিলেন। তার নাম ছিল হাডসন ।তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী। প্রতিকৃতি অঙ্কনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। বিদ্যাসাগরের তৈলচিত্র তিনি নিজে এঁকে দিয়েছিলেন এবং কোন পারিশ্রমিক নিতে তিনি রাজি হননি। বিদ্যাসাগরের প্রতি তার শ্রদ্ধা নিবেদন করেই সেই ছবি ছিল।

বিদ্যাসাগরের বড় ইচ্ছা হল হডসনকে দিয়ে তাঁর মা জননীর প্রতিকৃতি আঁকাবেন। তাতে করে হডসনেরও কিছু লাভ হবে। বিদ্যাসাগর মাকে বললেন, ” মাগো, এক পটো সাহেব এসেছেন। তিনি চমৎকার ছবি আঁকেন। তাকে দিয়ে তোমার একখানা ছবি আকাবো ভাবছি। “

ভগবতী দেবী রাজি হলেন না ….”ছবি! ছবি কি করে হবে? ছিঃ ছিঃ…” বিদ্যাসাগর বললেন, ” তোমার ছবি আমার কাছে থাকবে। যখন ইচ্ছে আমি তখন দেখবো ।মা বললেন , ” আমি পটো সাহেবের সামনে বসতে পারব না।” বললেন বটে, তবে শেষে রাজিও হলেন। তবে কৌশলে দায় ছেলের দিকেই ঠেলে দিলেন , “তোর যা ইচ্ছে তাই কর ….বাপু, নিন্দে হলে লোকে তো আমার নিন্দে করবে , তোর নিন্দে করবে । “

যাইহোক ,সাহেবের সামনে ভগবতী দেবী এসেছিলেন । শিল্পী একখানি অপরূপ ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর জননীকে চাক্ষুষ দেখেননি। তিনি ছবির একটি লিথো প্রিন্ট দেখেছিলেন ।ছবি দেখে তার উপলব্ধির কথাটুকু বড় চমৎকার ছিল , ” অধিকাংশ প্রতিমূর্তি অধিক দেখিবার দরকার হয় না, তাহা যেন মুহুর্তের মধ্যে নিঃশেষিত হইয়া যায়। কিন্তু ভগবতী দেবীর এই পবিত্র মুখশ্রীর গভীরতা এবং উদারতা বহুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া শেষ করিতে পারা যায় না ।”

ভগবতী দেবীর এই সংস্কারমুক্ত মানসিক গঠন রূপ পরিগ্রহ করেছিল সমাজে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যে এসে হয়তো মানুষ মনে করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল , ভগবতী দেবীর প্রভাবে বাল্য কৈশোর থেকে বিদ্যাসাগর সংস্কারমুক্ত সাহসী মানসিক গঠন ও দৃষ্টিভঙ্গি পেতে শুরু করেছিলেন।

ভগবতী দেবীর পিতা রামকান্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী ব্যক্তি । তিনি ব্যাকরণ ও স্মৃতিশাস্ত্রতে অসম্ভব পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।সেই কারণে তাকে তর্কবাগীশ উপাধি দান করা হয়েছিল। স্বগ্রাম হুগলি জেলার গোঘাটে তাঁর একটি চতুষ্পাঠী ছিল ।সেখানে বহু ছাত্র পাঠঅধ্যয়ন করতেন । তিনি তার দুই কন্যা ও স্ত্রী সঙ্গে সুখে কালাতিপাত করছিলেন।

কিন্তু এমন সময় তন্ত্র সাধনায় রামকান্তের আগ্রহ সৃষ্টি হয় । ফলে অধ্যয়নেরপরিবেশ বিঘ্নিত হতে থাকে এবং ক্রমশ ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকে ও সংসার যাত্রা ভঙ্গ হতে থাকে। কিন্তু রমাকান্তর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। যেহেতু রমাকান্তর কোন অভিভাবক স্থানীয় কেউ ছিলনা, সেহেতু তার শ্বশুর গ্রামবাসী পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশ তার দুই দৌহিত্রি, কন্যা ও জামাতাকে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন।

পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশের অবর্তমানে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পরম সমাদরে কন্যা লক্ষ্মী ও ভগবতী কে নিয়ে মাতা গঙ্গাদেবী ভ্রাতৃপরিবারে কালাতিপাত করতে থাকেন। মায়ের মাতুলালয়কেই বিদ্যাসাগর নিজ মাতুলালয় বিবেচনা করতেন। উচ্চশিক্ষার নিমিত্ত কলকাতা গমন কালে এই গ্রামে প্রথম রাত্রি অতিবাহিত করেছিলেন।

মাতুলালয় অবস্থান ভগবতী দেবীর কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল । মামার বাড়ির পরিবেশ, জীবন আদর্শ ভগবতীদেবীর চরিত্র ও মানসিকতা গঠনের সহায়ক হয়েছিল । সে সময় স্ত্রীলোকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না । এই সুযোগে এদেশে বিশেষ ভাবে প্রসারিত হয়েছিল ভগবতীপুতত্রের এর উদ্যোগে ।সে অবশ্য পরবর্তী কালের কথা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও তিনি বালিকা বয়সে শিখে গিয়েছিলেন কিভাবে পরের জন্য কল্যাণ চিন্তা করতে হয় ।প্রতিবেশীদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হয়, দেখতে হয়, চলতে হয় ,বলতে হয় । এমন সুচিন্তিতজ সদ্ব্যবহার পরিসর সেই বালিকা বয়সে তিনি অর্জন করেছিলেন । সুশীলতা, শিষ্টাচার, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ , বিনয় ইত্যাদি সামাজিক বন্ধনের প্রধান উপায় হয়- সে শিক্ষা বাল্য হৃদয় অঙ্কুরিত হয়েছিল…

ক্রমশঃ

দুর্গেশনন্দিনী

পরবর্তি অংশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.